চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির জন্য আগের অবস্থান থেকে সরে এসে নেতিবাচক আভাস দিয়েছে ম্যানিলাভিত্তিক উন্নয়ন সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)।
সংস্থাটি বলেছে, জুলাই-আগস্টের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সাম্প্রতিক বন্যার কারণে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ১ শতাংশে নেমে আসবে। সেইসঙ্গে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়তে পারে, তা দুই অঙ্কের উপর থাকবে। যদিও আগে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এসব সূচক নিয়ে ইতিবাচক পূর্বাভাস দিয়েছিল তারা।
এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুক (এডিও) সেপ্টেম্বর ২০২৪ প্রতিবেদনে এই পূর্বাভাস দিয়েছে এডিবি। বুধবার প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে।
গত এপ্রিলে এডিবির পূর্বাভাসে বলা হয়েছিল, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৬ শতাংশ অর্জিত হবে। তবে সেপ্টেম্বরের আভাসে ১ দশমিক ৫ শতাংশীয় পয়েন্ট কমিয়ে প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ১ শতাংশে নামিয়েছে সংস্থাটি।
গত এপ্রিলে এডিবি বলেছিল, চলতি অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশে নেমে আসবে। কিন্তু এখন এডিবি বলছে, তা হবে না। বরং মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে ১০ দশমিক ১ শতাংশে উন্নীত হবে। এর মানে, এ বছরও দেশের সাধারণ মানুষকে উচ্চ মূল্যস্ফীতির জন্য চড়া মূল্য দিতে হবে।
বুধবারের প্রতিবেদনে এডিবি বলছে, গত জুলাই ও আগস্ট মাসে দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অর্থনৈতিক কার্যক্রম বিঘ্নিত হয়েছে। তারা সঙ্গে সাম্প্রতিক বন্যার প্রভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এই দুই প্রভাবে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির গতি কমবে বলে মনে করছে সংস্থাটি।
এডিবির ধারণা, রাজস্ব ও আর্থিক নীতিতে কঠোরতা আছে, তা অব্যাহত থাকবে। এছাড়া ক্রয় ও বিনিয়োগ আরও কমবে। নেতিবাচক ঝুঁকি থাকায় সামষ্টিক অর্থনীতির পূর্বাভাস অত্যন্ত অনিশ্চিত। চলমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, ভঙ্গুর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও আর্থিক খাতের দুর্বলতা হলো এসব ঝুঁকির উৎস।
এডিবির পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈশ্বিক অর্থনীতির ধীরগতি ও অন্যান্য সামষ্টিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের কারণে চাহিদা কমবে। পণ্য ও জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়া এবং টাকার অবমূল্যায়ন হওয়ায় মূল্যস্ফীতির হার বাড়তি। তবে আমদানি-রপ্তানি কমে যাওয়ায় চলতি হিসাবের ঘাটতি কমেছে।
মূল্যস্ফীতির হার আবার দুই অঙ্কের ঘরে উঠতে পারে পূর্বাভাস দিয়েছে সংস্থাটি।
এডিবি মনে করছে, রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি, ব্যাংক ঋণের সুদ ও টাকার বিনিময় হার যথাযথ নীতির মাধ্যমে স্থিতিশীল করা এবং অর্থনৈতিক সংস্কারের ওপর সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নির্ভর করবে।
ধারাবাহিক উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক হিসাবের ওপর চাপ, আমদানি নিয়ন্ত্রণ ও বেসরকারি বিনিয়োগের ধীরগতির কারণে গত দুই অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ শতাংশের নিচে।
২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ৭৮ শতাংশ; ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ছিল ৫ দশমিক ৮২ শতাংশ।
বিদায়ী সরকারের পূর্বাভাস ছিল, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। চলমান চ্যালেঞ্জের পরিপ্রেক্ষিতে অর্থনীতিবিদরা একে ‘উচ্চাভিলাষী’ আখ্যা দিয়েছিলেন।
শেখ হাসিনার সরকারের আমলে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ দশমকি ৮৬ শতাংশ অর্জিত হয়েছিল বলে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুারো তথ্য দিয়েছিল। তৎকালীন রাজনৈতিক নেতৃত্ব এই উচ্চ প্রবৃদ্ধিকে অর্থনীতিতে বড় সাফল্য হিসেবে দেখিয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে তা কমতে থাকে বলে দাবি করা হয়।
বিশ্বের আর্থিক খাতের মোড়ল সংস্থা বিশ্বব্যাংক পূর্বাভাস দিয়েছিল, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের ৫ দশমিক ৭ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হতে পারে। আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে তা খানিকটা বেড়ে ৫ দশমিক ৯ শতাংশ হতে পারে।
গত ১২ জুলাই প্রকাশিত ‘গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এই পূর্বাভাস দিয়েছিল বিশ্বব্যাংক।
গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫ শতাংশ অর্জিত হবে বলে লক্ষ্য ধরেছিল বিদায়ী শেখ হাসিনার সরকার।
পরিসংখ্যান ব্যুরো সাত মাসের (জুলাই-জানুয়ারি) হিসাব কষে বলেছে, গত অর্থবছরে ৫ দশমিক ৮২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে।
আড়াই বছরের বেশি সময় ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব এখনও পড়ছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে। মধ্যপাচ্যের যুদ্ধের ধাক্কাও কমবেশি লাগছে। ডলারের দর বেড়েই চলেছে; ৮৬ টাকার ডলার এখন ১২০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। ডলারের এই উল্লম্ফনের নেতিবাচক প্রভাব অর্থনীতির সব খাতেই পড়ছে। দিন যতো যাচ্ছে, সংকট ততই বাড়ছে।
এমন একটি কঠিন পরিস্থিতিতে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে বলে লক্ষ্য ধরেছিল বিদায়ী আওয়ামী লীগ সরকার।
সরকারি তথ্যে বলা হয়, কোভিড-১৯ মহামারীর আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঊর্ধ্বগামী ছিল। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ। ধারাবাহিক অগ্রগতির পথ ধরে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ (ভিত্তি বছর পরিবর্তনের পর যা ৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ) প্রবৃদ্ধি অর্জন করে বাংলাদেশ, যা ছিল দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি।
তার পরের বছর কোভিড মহামারীর ধাক্কায় তা ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশে নেমে আসে। ২০২০-২১ অর্থবছরে তা আবার বেড়ে ৬ দশমিক ৯৪ শতাংশে উঠেছিল। পরের বছর ৭ শতাংশ ছাড়ালেও ২০২২-২৩ অর্থবছরে আবার ৫ দশমিক ৭৮ শতাংশে নেমে আসে।
মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের উপরে থাকবে
জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমালেও মূল্যস্ফীতি বাড়বে বলে আভাস দিয়েছে এডিবি। গত এপ্রিলে সংস্থাটি বলেছিল, চলতি অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশে নেমে আসবে। কিন্তু বুধবার প্রকাশিত প্রতিবেদনে এডিবি বলছে, তা হবে না। বরং মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘরের (১০ শতাংশ) উপরে ১০ দশমিক ১ শতাংশে উন্নীত হবে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সবশেষ তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসওয়ারি বা মাসভিত্তিক) দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি এক লাফে বেড়ে ১১ শতাংশ ছাড়িয়ে ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশে উঠেছিল; খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ।
আগস্টে তা কমে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশে নেমেছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি নেমেছে ১১ দশমিক ৩৬ শতাংশে।
আগস্ট মাসে ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ মূল্যস্ফীতির অর্থ হলো- গত বছরের আগস্ট মাসে যে পণ্য বা সেবা ১০০ টাকায় পাওয়া যেত, এই বছরের আগস্টে সেই পণ্য বা সেবা পেতে ১১০ টাকা ৪৯ পয়সা খরচ করতে হয়েছে।
গত বছরের মার্চ থেকে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৯ শতাংশের উপরে অবস্থান করছে।
এদিকে চড়তে থাকা মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে নীতি সুদহার (পলিসি রেট বা রেপো রেট) আরেক দফা বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতদিন এই হার ছিল ৯ শতাংশ। তা থেকে ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৯ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়েছে।
এছাড়া নীতি সুদের করিডরের ঊর্ধ্বসীমা ও নিম্নসীমাও বাড়ানো হয়েছে। নীতি সুদহারের ঊর্ধ্বসীমা স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটি (এসএলএফ) রেট ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ১১ শতাংশ করা হয়েছে এবং নীতি সুদহার করিডরের নিম্নসীমা স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটি (এসডিএফ) রেট ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৮ শতাংশ করা হয়েছে।
নতুন সুদের হার বুধবার (২৫ সেপ্টেম্বর) কার্যকর হবে বলে মঙ্গলবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
সবশেষ এক মাস আগে গত ২৫ আগস্ট এই নীতি সুদ হার ৮ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৯ শতাংশ করা হয়েছিল। এসএলএফ রেট ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ১০ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়েছিল। এসডিএফ রেট ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে করা হয়েছিল ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ।
তার আগে ৮ মে নীতি সুদহার ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৮ দশমিক ৫ শতাংশ করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এসএলএফ রেট ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছিল। এসডিএফ রেট ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৭ শতাংশ করা হয়।
২০২২ সালের মে মাস থেকে বেশ কয়েকবার নীতি সুদহার বাড়াল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে উদ্বেগজনক সূচক মূল্যস্ফীতির পারদ নামাতে নীতি সুদহার আরও বাড়ানো হবে বলে গত সোমবার সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা দিয়েছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর।
তিনি বলেছিলেন, “আগস্টে মূল্যস্ফীতি খানিকটা কমলেও সাড়ে ১০ শতাংশে অবস্থান করছে। এতে মানুষ খুব কষ্ট পাচ্ছে। আমাদের প্রধান অগ্রাধিকার হচ্ছে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা। আর সেজন্য এই সূচক কমানোর অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে নীতি সুদহার আরও বাড়নো হবে। চলতি সপ্তাহেই এক দফা বাড়ানো হবে। আগামী মাসে আরেক দফা বাড়ানো হবে।”
গভর্নরের ঘোষণার একদিনের মাথায় মঙ্গলবার নীতি সুদহারের পাশাপাশি এসএলএফ ও এসডিএফ রেটও বাড়ানো হয়েছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ পাওয়ার অন্যতম প্রধান শর্ত ছিল ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাজারের উপর ছেড়ে দিতে হবে। একইসঙ্গে মূল্যস্ফীতি কমাতে নীতি সুদহার বাড়াতে হবে।
সেই শর্ত পূরণের অংশ হিসেবে নীতি সুদহার বাড়িয়ে চলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সোমবার (২৩ সেপ্টেম্বর) সংবাদ সম্মেলনে গভর্নর আহসান মনসুর বলেছিলেন, “আমি আশাবাদী, মূল্যস্ফীতি মার্চ-এপ্রিলের মধ্যে একটি ভালো জায়গায় চলে আসবে। কতখানি ভালো জায়গায় আসবে সেটা হয়ত বলা যাবে না। তবে আমরা পলিসি টাইট করব, যাতে মূল্যস্ফীতি কমে আসে।
“আমাদের এখন বিনিময় হার স্থিতিশীল আছে। এছাড়া রেমিটেন্সও বাড়ছে। আশা করি, আগামীতেও বিনিময় হার স্থিতিশীল থাকবে। যদি এটা ধরে রাখা যায় তাহলে মূল্যস্ফীতি অবশ্যেই কমে আসবে।”
“তাছাড়া আমাদের বাজেটে ব্যাংক থেকে ঋণের যে লক্ষ্য রাখা হয়েছে, তা ৫০ হাজার কোটি টাকা কমানো হতে পারে। এটা হলে বেসরকারি বিনিয়োগও ঠিক হয়ে আসবে। সবমিলিয়ে আমরা যদি মূল্যস্ফীতি ৪-৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে পারি তাহলে সুদের হার আমরা কমিয়ে আনতে পারব। সে জন্য সময় দিতে হবে।”