রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক মামলা প্রত্যাহারের উদ্যোগ নিয়েছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
এই ধরনের মামলা চিহ্নিত করতে জেলা ও মন্ত্রণালয় পর্যায়ে দুটি কমিটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠন করেছে বলে বাসস জানিয়েছে।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট পতনের আগে দেড় দশক আওয়ামী লীগ সরকারে ছিল। তখন বিরোধী রাজনীতিকসহ ভিন্ন মতাবলম্বী অনেককে মামলা দিয়ে হয়রানির অভিযোগও ছিল।
তবে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পরও একই ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তখন রাজনৈতিক হয়রানিমূলক বিবেচনায় ৭ হাজার মামলা প্রত্যাহার হয়েছিল।
তার আগের দুই বছরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং আগের পাঁচ বছরে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে সেই মামলাগুলো হয়েছিল।
তখন সমালোচনা উঠেছিল, মামলা প্রত্যাহারের ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক বিবেচনায়ই প্রাধান্য পাচ্ছে। কারণ ওই পদক্ষেপে আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে খুনের মামলাও প্রত্যাহার করা হয়েছিল।
আবার ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত সরকার গঠনের পরও ৬ হাজারের মতো মামলা রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক বিবেচনায় প্রত্যাহার করা হয়েছিল।
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ২০০৮ সালে নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় গিয়েছিল আওয়ামী লীগ।
সরকার গঠনের পর ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার-সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি করে। তৎকালীন আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলামকে প্রধান করে গঠিত সেই কমিটি ২০১০ সালের ১০ জানুয়ারি প্রথম বৈঠক করে। ২০১৩ সালের ২২ আগস্ট হয়েছিল কমিটির শেষ বৈঠক।
২০১৪ সালের ২ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোতে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, কামরুল নেতৃত্বাধীন সেই কমিটি ৭ হাজার ১৯৮টি মামলা সম্পূর্ণ কিংবা আংশিক প্রত্যাহারের সুপারিশ করে।
কমিটির সুপারিশ করা সেই মামলাগুলোর সবই তখন প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছিল।
শেষ বৈঠকে কমিটি ৭২টি মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করে বলে তখন জানিয়েছিলেন কামরুল। তবে প্রথম আলোর অনুসন্ধানে ধরা পড়ে, সেই বৈঠকে ৯৮টি মামলা তোলার সুপারিশ করা হয়েছিল, তার মধ্যে ৪০টি খুনের মামলা। বাকি মামলার মধ্যে ছিল ধর্ষণ, দুর্নীতি, ডাকাতি, অস্ত্র মামলাও ছিল।
তখন জেলায় জেলায় কমিটি করা হয়েছিল, জেলা কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে জাতীয় কমিটি সিদ্ধান্ত নিত। তবে জেলা কমিটির সুপারিশ ছাড়াই জাতীয় কমিটি মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করেছিল বলে প্রথম আলোর অনুসন্ধানে ধরা পড়েছিল।
২০১১ সালের ১০ জানুয়ারি বাংলানিউজে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, তখন পর্যন্ত সুপারিশকৃত মামলার মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনের ৩১৪টি মামলা ছিল।
ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৪ ধারা অনুযায়ী, যে কোনও মামলার বিচারিক কাজ প্রত্যাহারের জন্য আদালতের কাছে আবেদন করা যায়। তবে দণ্ডবিধির কিংবা ব্যক্তির দায়ের করা কোনও মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করার এখতিয়ার সরকারের নেই। আবার দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলাও প্রত্যাহারের ক্ষমতা সরকারের নেই।
তবে এসব মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশের ব্যাখ্যায় কামরুল ইসলাম তখন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “জামায়াত প্রভাবিত বিগত বিএনপির জোট সরকারের আমলে ওই দল দুটির নেতা-কর্মীরা তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের হয়রানি করার জন্য অনেক ব্যক্তিগত মামলা করে। এ মামলাগুলো অবশ্যই রাজনৈতিক হয়রানির মামলা।”
তখন মামলা প্রত্যাহারের প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির নেতা, সাবেক আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমদ (বর্তমানে প্রয়াত) ২০১০ সালে বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, “রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহারের নামে সরকারদলীয় নেতা কর্মীদের নামে খুন, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের মতো মামলাগুলো প্রত্যাহার করা হচ্ছে।”
তবে ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার গঠনের পর মওদুদ যখন ছিলেন আইনমন্ত্রী, তখনও তার আগের ৫ বছরে আওয়ামী লীগের শাসনকালে করা অনেক মামলা প্রত্যাহারে একই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল।
প্রথম আলোয় ২০১৪ সালের ২ ফেব্রুয়ারির সেই প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০১-০৬ মেয়াদে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ৫ হাজার ৮৮৮টি মামলা সম্পূর্ণ প্রত্যাহার এবং ৯৪৫টি মামলা থেকে কিছু আসামিকে অব্যাহতি দিয়েছিল। ওই সময় মোট ৭৩ হাজার ৫৪১ জন আসামি এই প্রক্রিয়ায় বিচার এড়াতে পেরেছিল।
সেই প্রতিবেদনে আইনজীবী শাহদীন মালিককে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছিল, “এভাবে মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশের ফলে অপরাধীরা রাজনৈতিক পরিচয় লাভে উৎসাহী হবে।”
এবার কীভাবে হচ্ছে
রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও অন্যান্য কারণে রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও নিরীহ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ করার জন্য এবারও জেলা ও মন্ত্রণালয় পর্যায়ে দুটি কমিটি গঠন করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
তবে কোন সময়কার মামলা এই প্রক্রিয়ায় প্রত্যাহার করা হবে, সেই বিষয়ে কিছু স্পষ্ট না করে বলা হয়েছে বিভিন্ন সময় করা মামলা।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব মোহাম্মদ আবদুল মোমেনের স্বাক্ষরে একটি পরিপত্র জারি করে দুই ধরনের কমিটি গঠন করা হয়।
জেলা পর্যায়ের কমিটির সভাপতি হবে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (ডিসি), সদস্য থাকবে পুলিশ সুপার (মহানগর এলাকার জন্য পুলিশের একজন ডেপুটি কমিশনার) ও পাবলিক প্রসিকিউটর (মহানগর এলাকার মামলাসমূহের জন্য মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর) এবং সদস্য সচিব হবে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিসি)।
জেলা পর্যায়ের কমিটির কার্যপরিধি ও কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে পরিপত্রে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের জন্য আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সংশ্লিষ্ট জেলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আবেদনপত্র জমা দিতে হবে। ৭ কর্মদিবসের মধ্যে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আবেদনটি জেলার পাবলিক প্রসিকিউটরের কাছে পাঠাবেন মতামতের জন্য। তার ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে পাবলিক প্রসিকিউটর তার মতামত জানাবেন।
পাবলিক প্রসিকিউটরের (পিপি) মতামত নিয়ে ডিসি আবেদনটি ৭ কার্যদিবসের মধ্যে জেলা কমিটির সভায় উপস্থাপন করবেন। জেলা কমিটির বৈঠকে হয়রানিমূলক মামলার বিষয়টি প্রমাণিত হলে তা প্রত্যাহারের জন্য কমিটি সরকারের কাছে সুপারিশ করবে। এই সুপারিশ জানাতে হবে আবেদন পাওয়ার ৪৫ কার্যদিবসের মধ্যে।
মন্ত্রণালয় পর্যায়ের কমিটির সভাপতি হবে আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। সদস্য থাকবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব, অতিরিক্ত সচিব (আইন ও শৃঙ্খলা) ও যুগ্মসচিব (আইন) এবং আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি (যুগ্ম-সচিব পর্যায়ের নিচে নয়)। কমিটির সদস্য সচিব হবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের আইন-১ শাখার উপসচিব অথবা জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব অথবা সহকারী সচিব।
মন্ত্রণালয় পর্যায়ের কমিটির কার্যপরিধি ও কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে পরিপত্রে বলা হয়েছে, জেলা কমিটির কাছ থেকে সুপারিশ পাওয়ার পর সেগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রত্যাহারযোগ্য মামলা চিহ্নিত করে তালিকা প্রস্তুত করা হবে। এরপর মামলা প্রত্যাহারের কাজ শুরু করবে।
দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলাগুলো কমিশনের লিখিত আদেশ ছাড়া প্রত্যাহার করা যায় না বলে এসব মামলা চিহ্নিত করে তালিকা তৈরি করা হলেও সেগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত পরে নেওয়া হবে বলে বাসস জানিয়েছে।