আর্জেন্টিনার বুয়েন্স এইরেসে জন্ম হোর্হে মারিও বার্গোগলিও বা পোপ ফ্রান্সিসের। যার জন্ম আর্জেন্টিনায় তার রক্তে ফুটবল থাকবে না, হয় নাকি? পোপ ফ্রান্সিসও ছিলেন ফুটবলের একনিষ্ঠ ভক্ত। শৈশবে খেলতেন বুয়েন্স এইরেসের রাস্তায়। ছিলেন গোলরক্ষক। তার প্রিয় ক্লাব ছিল সান লরেঞ্জো।
এই ক্লাবের খেলা দেখতে শৈশবে বাবার সঙ্গে গ্যালারিতে যেতেন নিয়মিতই। শুধু গ্যালারি নয়, পুরোহিত হওয়ার পর সান লরেঞ্জোর লকার রুমেও ছিল তার অবাধ যাতায়াত। ক্লাব কর্তারাও ফুটবলারদের ‘আশীর্বাদের’ জন্য পাঠাতেন তাকে। তিনি ছিলেন ক্লাবের আজীবন সদস্যও (নাম্বার ৮৮,২৩৫)।
বিপত্তি বাঁধে ১৯৯৮ সালে। সেবার সান লরেঞ্জোর কোচ নির্বাচিত হন আলফিও বাসিলে। ২০০৬ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের কোচ থাকা বাসিলে প্রথম দিন স্যান লরেঞ্জোর খেলোয়াড়দের সঙ্গে পরিচয়ের সময় ড্রেসিংরুমে দেখেন পুরোহিত হোর্হে মারিও বার্গোগলিকে। তাকে দেখে ক্লাব প্রেসিডেন্ট ফের্নান্দো মিয়েলোরে কাছে বাসিলে জানতে চান, ‘‘এই পুরোহিত কে?’’
ফের্নান্দো মিয়েলো বলেছিলেন, ‘‘দেখ কোচ, সে ভালো একজন পুরোহিত। প্রতি ম্যাচের আগেই খেলোয়াড়দের আশীর্বাদ দিতে আসে লকার রুমে।’’ এরপর তেলেবেগুনে জ্বলে আলফিও বাসিলে বলেছিলেন, ‘‘তিনি যদি এখানে নিয়মিতই আসেন তাহলে তোমরা আমার কাছে এসেছো কেন (কোচের দরকার কী)? এই খেলোয়াড়রা কাউকে হারাতে পারবে না। পুরোহিতকে এখনই বের কর লকার রুম থেকে, সে অপয়া। আমি লকার রুমে কোনো পুরোহিত দেখতে চাই না। আর চাই না আমার থেকে কেউ খেলোয়াড়দের মনোযোগ সরিয়ে দিক।’’
বেচারা মারিও বার্গোগলি, তখনই বেড়িয়ে যান প্রিয় ক্লাবের লকার রুম থেকে। এরপর ২০১৩ সালে তিনি হন রোমান ক্যাথলিক চার্চের পোপ। তার পোপ হওয়ার বছরই সান লরেঞ্জো জিতেছিল প্রিমিয়ারের শিরোপা পরের বছরই ক্লাবটি প্রথমবার জিতে কোপা লিবার্তাদোরেস। তখন বলা হচ্ছিল এটা ‘পোপের অলৌকিক প্রভাব’!
২০১৪ সালে একটা রেস্টুরেন্টে দেখা হয়েছিল সান লরেঞ্জোর সাবেক প্রেসিডেন্ট ফের্নান্দো মিয়েলো আর কোচ বাসিলের। মিয়েলো প্রথম প্রশ্নই করেন, ‘‘তুমি কী জানো এখন পোপ কে?’’ জবাবে হাসতে হাসতে বাসিলে বলেছিলেন,‘‘এটা সবাই জানে। কিন্তু তাকে আমি লকার রুমে থেকে বের করে দিয়েছিলাম, এটা জানে কতজন, হা, হা, হা।’’
পোপ ফ্রান্সিসের সঙ্গে দেখা করেছিলেন ডিয়েগো ম্যারাডোনা। তার খেলার ভক্ত ছিলেন ফ্রান্সিস। তিনি ভক্ত ছিলেন লিওনেল মেসিরও। ২০২৩ সালে ইতালিয়ান ‘আরএআই’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারের সময় তার কাছ থেকে জানতে চাওয়া হয়েছিল, সেরা কে, মেসি না ম্যারাডোনা?
এর জবাবে সবাইকে অবাক করে পোপ ফ্রান্সিসের জবাব ছিল, ‘‘আমি এই তালিকায় আরও একজনকে যোগ করতে চাই, তিনি পেলে। এই তিনজনের খেলাই সবচেয়ে বেশি অনুসরণ করেছি আমি।’’
পেলে, ম্যারাডোনা আর মেসিকে নিয়ে সেই সাক্ষাৎকারে পোপ ফ্রান্সিস বলেছিলেন, ‘‘আমি পোপ হওয়ার পরের বছর আমার সাথে দেখা করতে এসেছিল ম্যারাডোনা। দারুণ খেলোয়াড় ও কিন্তু মানুষ হিসেবে ব্যর্থ হয়েছে। মেসি ভীষণ সৎ আর ভদ্র। আমার হৃদয়ে একজনের নাম গেঁথে আছে তিনি পেলে। এই তিনজনের মধ্যে আমার কাছে গ্রেটেস্ট জেন্টেলম্যান পেলে।’’
পেলের সঙ্গে দেখা হওয়ার কথাও উল্লেখ করেছিলেন পোপ ফ্রান্সিস, ‘‘একবার বুয়েন্স এইরেসে যাওয়ার পথে পেলের সঙ্গে দেখা হয়েছিল আমার। অনেক কথা বলেছি। পেলে ভীষণ হৃদয়বান। তবে পেলে, ম্যারাডোনা, মেসি-তিনজনই কিংবদন্তি।’’
পোপ হওয়ার পাঁচ মাস পর আর্জেন্টিনা ও ইতালির প্রীতি ম্যাচের আগে ভ্যাটিকানে লিওনেল মেসিকে অভ্যর্থনা দিয়েছিলেন পোপ। মেসি জাতীয় দলের স্বাক্ষরিত জার্সি ও উপহারসামগ্রী দিয়েছিলেন পোপকে।
সেই পোপ ফ্রান্সিস আজ পাড়ি জমিয়েছেন না ফেরার দেশে। ধর্ম, সংস্কৃতি ও খেলাধুলার অসাধারণ সমন্বয় ঘটানো সেই পোপের মৃত্যুতে আজকের (সোমবার) সব ধরনের খেলা স্থগিত করা হয়েছে ইতালিতে। এর মধ্যে আছে ইতালিয়ান শীর্ষ ফুটবল লিগ সিরি ‘এ’র চারটি ম্যাচও।