নানা কারণে অনেকে কেন্দ্রে গিয়ে নিজের ভোটটি দিতে পারেন না। এদের মধ্যে রয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশি, কারাবন্দি, সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী, যারা কাজের সূত্রে এমন এলাকায় অবস্থান করেন, যেখানে তারা ভোটার নন কিংবা যাদের নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করতে হয় অন্য স্থানে। এসব ভোটারের জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় ভোটদানের বিধান রয়েছে। আর তা হল পোস্টাল ব্যালট।
তবে আইনি জটিলতা এবং ভোটারদের আগ্রহ না থাকায় এই পদ্ধতিতে খুব কম সংখ্যক ভোট পড়ে। এমনকি পোস্টাল ব্যালটে এখন পর্যন্ত কতগুলো ভোট গ্রহণ হয়েছে, সে সংক্রান্ত কোনও তথ্যও নির্বাচন কমিশনের কাছে নেই। কমিশনের ওয়েবসাইট এবং বিভিন্ন সংসদ নির্বাচনে কমিশন প্রকাশিত প্রতিবেদনেও পোস্টাল ব্যালটে ভোট সংক্রান্ত কোনো তথ্য পাওয়া যায় না।
নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, এখন পর্যন্ত ঠিক কতগুলো ভোট পোস্টাল ব্যালটে পড়েছে, তা তাদের জানা নেই। পোস্টাল ব্যালটের আবেদন করা হয় বলে বিভিন্ন প্রশিক্ষণের সময় তারা শুনেছেন ঠিকই, কিন্তু সঠিক তথ্য জানেন না।
যেভাবে দিতে হয় পোস্টাল ব্যালটে ভোট
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে এই বিধান চালু হয়। ভোটকেন্দ্রে যেতে অসমর্থ-এমন চার ধরনের ভোটাররা ডাকযোগে ভোট দিতে পারেন।
নিয়ম অনুযায়ী, ভোটকেন্দ্রে যেতে পারবেন না কিন্তু ভোট দিতে আগ্রহী এমন ভোটারকে পোস্টাল ব্যালট পেপারের জন্য তার নির্বাচনী এলাকার রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে আবেদন করতে হবে। আবেদনটিতে ভোটারের নাম, ঠিকানা এবং ভোটার তালিকায় ক্রমিক নম্বর উল্লেখ করতে হবে।
আবেদনপত্র পাওয়ার পর রিটার্নিং কর্মকর্তা সংশ্লিষ্ট ভোটারের কাছে পোস্টাল ব্যালট পেপার, খাম, নির্দেশনাসহ প্রয়োজনীয় কাগজ পাঠাবেন। পোস্টাল ব্যালটে ভোট দেওয়ার জন্য ব্যালট পেপারে টিক দিতে হয়। ভোটার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে ব্যালটটি নির্ধারিত খামে ভরে ইসির নির্দেশনা অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে পাঠাবেন।
রিটার্নিং অফিসার নির্দিষ্ট সময়ে পোস্টাল ভোটগুলো গণনা করে চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা করবেন।
জটিল ও দীর্ঘ প্রক্রিয়া, সময়ের অভাব, অনাগ্রহসহ নানা কারণে বাংলাদেশে পোস্টাল ভোটের বিষয়টি জনপ্রিয়তা পায়নি।
ভোটে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য ‘বিশেষ ডিভাইস’ চান ফরিদপুরের ডিসি
এক নির্বাচন কমিশনার সকাল সন্ধ্যাকে জানান, তিনি যখন এই পদে আসেননি তখন পোস্টাল ব্যালটে ভোট দিতে দেখেছেন। তবে এ সংক্রান্ত কোনও পরিসংখ্যান তার কাছে নেই।
যতদিন পর্যন্ত ইলেকট্রনিক ভোটিং ব্যবস্থা চালু করা না যাবে, ততদিন পোস্টাল ব্যালট ব্যবস্থা কার্যকর করা অসম্ভব বলে মনে করেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম।
জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের ১৭৬টি দেশে প্রায় দেড় কোটি বাংলাদেশি কর্মী কর্মরত। এছাড়া ভোটের সময় কর্মকর্তা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে নিয়োজিতসহ সবমিলিয়ে ১৫ লাখ মানুষ দায়িত্ব পালন করেন। কেবল এ দুটি হিসেবেই এক কোটি ৬৫ লাখ ভোটার নির্ধারিত দিতে ভোট দিতে পারবেন না। প্রতিবন্ধী, কারাবন্দি ও বেসরকারি চাকরিজীবীদের সংখ্যা হিসাব করলে এ সংখ্যা আরও বাড়বে।
দ্বাদশ ভোটে পোস্টাল ব্যালটের আবেদন
৭ জানুয়ারির ভোটে দেশের বেশ কয়েকটি জেলায় পোস্টাল ভোটের আবেদন জমা পড়েছে।
এর মধ্যে পিরোজপুরে ১৬৮টি। এই জেলার তিন আসনে মোট ভোটারের সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ।
পিরোজপুর জেলা নির্বাচন অফিসের উচ্চমান সহকারী রাসেল সকাল সন্ধ্যাকে জানান, যারা আবেদন করেছেন তাদের ব্যালট ডাকযোগে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
একইভাবে নরসিংদীর সাড়ে ১৮ লাখ ভোটারের মধ্যে পোস্টাল ব্যালটের আবেদন করেছেন দেড়শ জনেরও কম।
আবার যথাযথ সময়ের মধ্যে আবেদনপত্র না পৌঁছায় অনেকের কাছে ব্যালট পাঠানো যায়নি বলে জানিয়েছেন নড়াইলের জেলা প্রশাসক ও নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মোহাম্মাদ আশফাকুল হক চৌধুরী।
নির্বাচন কমিশন যা বলছে
জটিলতার কারণে অনেকে ইচ্ছা থাকলেও পোস্টাল ব্যালটে ভোট দিতে পারে না বলে মনে করেন নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “নির্বাচনে ভোটগ্রহণের কাজে প্রায় ১৫ লাখ মানুষ জড়িত থাকবে। তারাই তো ভোট দিতে পারে না। কারও ইচ্ছা থাকলেও জটিলতার কারণে দেওয়া হয় না “
এই নির্বাচন কমিশনার আরও বলেন, “প্রতীক বরাদ্দের পর ২১-২৫ দিনের মধ্যে আসনভিত্তিক ব্যালট পেপার ছাপানো হয়। এই সময়ের মধ্যে পোস্টাল ব্যালট বিদেশে পাঠানো এবং সেটি ফেরত আসা সম্ভব না। ফলে বাস্তবতা হলো, এটা সম্ভব না।”
পোস্টাল ব্যালটে ভোটদানের ক্ষেত্রে বর্তমান কমিশনের কোনও বিশেষ উদ্যোগ নেই বলে সকাল সন্ধ্যাকে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ।
পোস্টাল ব্যালটে ভোট দিলেন রাষ্ট্রপতি
তিনি বলেন, “বিদ্যমান আইনে যেভাবে আছে সেভাবেই হবে। সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
তবে এতদিন কতগুলো ভোট পড়েছে সে পরিসংখ্যান তার কাছে নেই বলেও স্বীকার করলেন সচিব। তার মতে, ব্যালট পেপার ছাপানোর পর তা ইস্যু করা, জমা নেওয়া ইত্যাদি কাজের জন্য যথাযথ সময় পাওয়া যায় না। সেকারণেই বিষয়টি সবসময় আড়ালে থেকে যায়।
দীর্ঘ ক্যারিয়ারে বেশ কয়েকটি নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করেছেন সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলী।
পোস্টাল ব্যালট পড়তে দেখেছেন কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমি যখন কাজ করেছি, তখন কিছু ভোট পড়েছে। খুবই অল্প ভোট পড়েছে। ঠিক কত ভোট পড়েছে তা বলতে পারব না। হয়ত সে সময় কম্পিউটারে রেখেছি। অবসরে যাওয়ার আগে বুঝিয়ে দিয়ে এসেছি। কিন্তু কতগুলো ভোট পড়েছিল সে হিসাব সঠিক মনে নেই।”
বিশেষজ্ঞ মত
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “পোস্টাল ব্যালট সিস্টেমটা মুখে মুখে রয়ে গেছে। এটা কোনো কাজে আসে না। এভাবে মানুষকে ভোট বঞ্চিত করা হচ্ছে। আইন পরিবর্তন করতে চাইলে সেটা তফসিলের আগে করতে হতো। এখন ইলেকশন এসে গেছে। এখন সম্ভব না। তাদের আসলে আন্তরিকতার অভাব।”
ইলেকট্রনিক ভোটিং ব্যবস্থা নিশ্চিত করা না গেলে পোস্টাল ব্যালটও কার্যকর করা সম্ভব নয় জানিয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম বলেন, “কেবল কমিশনের উদ্যোগের মাধ্যমে পোস্টাল ব্যালটে ভোটের বিষয়টি সহজ করা যায় না। অনেক ক্ষেত্রে এটা প্রয়োগ করতে হলে ভোটারদের উদ্যোগী হতে হবে। ভোটাররা উদ্যোগী না। তারা তো বাড়ির পাশে ভোটকেন্দ্র গিয়েই ভোট দিতে চান না।”
তিনি বলেন, প্রার্থিতা চূড়ান্ত হওয়ার দিন থেকে ভোটগ্রহণের দিনের তফাৎ থাকে সর্বোচ্চ ২২ দিন। রিটার্নিং কর্মকর্তা চূড়ান্ত প্রার্থীদের তালিকা কমিশন প্রেসে পাঠায়। প্রেসে প্রিন্ট দেখে চূড়ান্ত করতে লাগে অন্তত সাতদিন। সব মিলিয়ে এই ব্যালট ১২ দিন পর রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে পৌঁছায়।
এরপর ডাকযোগে ভোটারের কাছে ব্যালট পাঠাতে হয়। সেই ব্যালট হাতে পেয়ে ভোট দিয়ে আবার রিটার্নিং কর্মকতার কাছে ফেরত পাঠানো প্রায় অসম্ভব বলে মনে করেন তিনি।
পোস্টাল ব্যালটে ভোট দেওয়ার বিষয়ে খোদ নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদেরই আগ্রহ নেই।
নির্বাচনের কাজে নিয়োজিত থাকেন এমন কয়েকজন কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর সদস্য সকাল সন্ধ্যাকে বলেছেন, পোস্টাল ব্যালট সম্পর্কে তাদের ধারণা আছে। কিন্তু নিজের ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে এই ব্যালট ব্যবহারের ভাবনা কখনও মাথায় আসেনি। নিজেরাই ভোটের দায়িত্ব নিয়ে এত ব্যস্ত থাকেন যে, এর কথা মাথায় থাকে না।