হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির মৃত্যু দেশটিকে নতুন এক মোড়ে দাঁড় করিয়েছে। এই মৃত্যু দেশটির ক্ষমতাবলয়ে দ্বন্দ্ব তৈরি করবে, এমনটা মনে করছেন অনেকে।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সংবিধানের ১৩১ ধারা অনুসারে, মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগে প্রেসিডেন্ট মারা গেলে প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট অস্থায়ী প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করবেন। তবে তাকে সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার অনুমোদন পেতে হবে।
মতাদর্শে কট্টরপন্থী রাইসি ছিলেন সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির আস্থাভাজন। ক্যান্সারে আক্রান্ত ৮৫ বছর বয়সী খামেনির উত্তরসূরি ধরা হতো রাইসিকে। কিন্তু রাইসির মৃত্যুর ফলে প্রেসিডেন্ট ও সর্বোচ্চ নেতার পদ দুটি নিয়ে দেশটির ক্ষমতাবলয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হতে পারে, এমন আশঙ্কা অনেকের।
দেশটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মোখবারের নাম সামনের সারিতে। তাকেও খামেনির আস্থাভাজন ধরা হয়। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ও দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার ব্যাপারে তার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে ইরানের ক্ষমতা বলয়ের মধ্যে।
ইরানের খুজেস্তান প্রদেশের দেজফুল শহরে ১৯৫৫ সালে জন্ম মোখবারের। আশির দশকে ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময় ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পসের (আইআরজিসি) মেডিকেল ইউনিটের কর্মকর্তা ছিলেন তিনি। ২০২১ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাইসি জয়ী হলে মোখবারকে ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
এক্ষেত্রে ক্ষমতাবলয়ে নেতৃত্ব প্রশ্নে দ্বিতীয় যে নামটি সামনে আসছে, তিনি হলেন খামেনির ছেলে মোজতবা খামেনি। ইরানের অভ্যন্তরীণ বাসিজ সশস্ত্র গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ তার হাতে। ২০০৯ সালের নির্বাচনে বিক্ষোভকারীদের কঠোর হাতে দমনের অভিযোগ আছে এই গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে।
অনেকে বলছেন, রাইসির মৃত্যুতে মোজতবার রাস্তা পরিষ্কার হয়ে যাবে। এই ঘটনা তাকে তার বাবার উত্তরসূরি হিসেবে তালিকায় এক নম্বরে নিয়ে আসতে পারে।
খামেনির সন্তান হিসেবে দেশটির ক্ষমতাবলয়ে মোজতবা বেশ সুবিধা ভোগ করেন। রাইসির প্রেসিডেন্ট হওয়াকেও তার সর্বোচ্চ পদে যাওয়ার পরীক্ষা বা মহড়া হিসেবেও দেখছিলেন অনেকে। কিন্তু মোজতবাও তার বাবার মৃত্যুর পর দেশের শীর্ষ পদটি পেতে চান। এতে তাদের দুজনের মধ্যে চাপা বিরোধ তৈরি হয়। রাইসি দীর্ঘদিন ধরেই আইআরজিসির প্রিয় ব্যক্তি।
দেশটির সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ তথা ধর্মীয় নেতৃত্বের অনেকেই মোজতবার পক্ষে। এজন্য তারা তাকে প্রভাবশালী ধর্মীয় বিদ্যায়তনে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগও দেন। অথচ তার পাণ্ডিত্যের শক্ত কোনও প্রমাণপত্র ছিল না। খামেনির ছেলেকে গ্রহণ করে ধর্মীয় বিদ্যায়তন প্রেসিডেন্ট রাইসির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকেই উস্কে দেয়।
মোজতবা খামেনির উত্তরাধিকারের সমর্থকরা যুক্তি দেন যে, শিয়া মুসলিম ঐতিহ্য ইমামতের ধারণায় বংশগত নেতৃত্বের অনুমতি দেয়। তবে ধর্মীয় বিশেষজ্ঞরা এর বিরোধিতা করে বলেন, ইমামদের মনোনীত করেন সৃষ্টিকর্তা। যেখানে সর্বোচ্চ নেতা জনগণের প্রতিনিধিদের দ্বারা নির্বাচিত হন, সেখানে বংশগতভাবে কেউ ক্ষমতা যেতে পারে না।
প্রেসিডেন্ট হিসাবে মোজতবার সম্ভাবনা থাকলেও পারিবারিক উত্তরাধিকার রাজনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে। কারণ প্রথমে খোমেনি এবং পরে খামেনিও যুক্তি দিয়েছিলেন, ইসলামি বিপ্লবের পর শাহদের শাসনামলের মতো বংশপরম্পরাগত শাসন তথা রাজতন্ত্র অবৈধ। কারণ তাদের পারিবারিক শাসন-শোষণ উৎখাতের জন্যই বিপ্লব হয়েছে। ফলে এখন ফের ইরানি জনগণের কাছে বংশগত নেতৃত্ব মানা কঠিন হবে।
এমন পরিস্থিতিতে ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পরের প্রথম বছরগুলোর একটি বিতর্ক ফের শুরু হতে পারে। তখন বলা হয়েছিল, ইসলামী প্রজাতন্ত্রের কোনও একক সর্বোচ্চ নেতার প্রয়োজন নেই। ইরানের সংবিধানও সর্বোচ্চ নেতৃত্বের জন্য একটি পরিষদ গঠনের অনুমতি দেয়। ফলে খামেনি মারা যাওয়ার পর প্রতিদ্বন্দ্বীতা শুরু হলে রাষ্ট্র যুক্তি দেখাতে পারে, খোমেনি ও খামেনি আর দশজন সাধারণ মানুষের মতো ছিলেন না। তারা প্রজ্ঞা ও সদগুণের শিখরে পৌঁছেছিলেন।
প্রেসিডেন্ট পদের জন্য তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে নাম আছে পার্লামেন্টের স্পিকার মোহাম্মদ-বাঘার গালিবাফের। আইআরজিসির সাবেক জেনারেল ও তেহরানের প্রাক্তন মেয়র গালিবাফ একাধিকবার খামেনির রোষ থেকে বেঁচে গেছেন। গালিবাফ প্রেসিডেন্ট হতে পারেন, কিন্তু তিনি সর্বোচ্চ নেতা হতে পারেন না কারণ তিনি ধর্মগুরু নন।
এখন দুটো সম্ভাবনা সামনে আসছে। হয় একটি নতুন নির্বাচন ডাকা হবে, অথবা খামেনির নির্দেশনায় সংকটের সময় নির্বাচন এড়াতে কাউন্সিল একজনকে বেছে নেবে। এতে অবশেষে দীর্ঘদিন ধরে প্রেসিডেন্ট পদ প্রত্যাশী গালিবাফের ইচ্ছাও পূরণ হতে পারে।
নতুন প্রেসিডেন্ট নিয়োগ প্রক্রিয়া
রাইসির মৃত্যুই পদে থাকা অবস্থায় ইরানের কোনও প্রেসিডেন্টের প্রথম মৃত্যু নয়। এর আগে ১৯৮১ সালে প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ-আলী রাজাইও পদে থাকা অবস্থায় নিহত হন। তাকে হত্যা করেছিল মোজাহেদিন-ই খালক নামের একটি সংগঠন।
ইসলামি প্রজাতন্ত্রটির সংবিধানে সাধারণভাবে বলা আছে, মেয়াদ শেষের আগেই কোনও প্রেসিডেন্ট মারা গেলে, ‘নতুন একজন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করা হবে।’ কিন্তু এর পদ্ধতি কী হবে তা সুনির্দিষ্টভাবে বলা নেই।
১৯৮১ সালে প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ-আলি রাজাইর মৃত্যুর পর নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য জনগণের ভোটের আয়োজন করা হয়েছিল। কিন্তু ১৯৮৯ সালে সংবিধান সংশোধন করে সেই ক্ষমতা কার্যত সর্বোচ্চ নেতার হাতে তুলে দেওয়া হয়। বর্তমান সংবিধানে নতুন নির্বাচনের বাধ্যবাধকতা নেই।
প্রেসিডেন্ট মারা গেলে বা দুই মাসের বেশি সময় ধরে তার দায়িত্ব পালনে অক্ষম হলে প্রথমে নতুন প্রেসিডেন্ট বাছাই করার জন্য একটি কাউন্সিল গঠন করা হবে। কাউন্সিলটি গঠন করবেন ভাইস প্রেসিডেন্ট, পার্লামেন্টের স্পিকার ও প্রধান বিচারপতি। এরপর তারা যাচাই-বাছাই করে সর্বোচ্চ নেতার কাছে নতুন প্রেসিডেন্টের নাম প্রস্তাব করবেন।
তার মানে কার্যত সর্বোচ্চ নেতা আলী খামেনিই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবেন। দেশটির সর্বোচ্চ নেতা সংসদের সম্মতি ছাড়াই সরাসরি প্রধান বিচারপতিও নিয়োগ করেন। বর্তমান প্রধান বিচারপতি গোলাম-হোসেন মোহসেনি-ইজেই খামেনির অনুগত সৈনিকের মতো।
হাল ছাড়বে না আইআরজিসি
রাইসির মৃত্যুর পর আইআরজিসি তাদের পক্ষ থেকে একজন নতুন ব্যক্তিকে খুঁজে বের করবে। ১৯৮৯ সালে আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির মৃত্যুর পর আয়াতোল্লাহ আলী খামেনি তুলনামূলক দুর্বল প্রার্থী হিসেবে উঠে এসেছিলেন। কারণ অনেকেই তাকে দুর্বল হিসেবে দেখেছিল, যদিও একেবারে অযোগ্য ছিলেন না তিনি।
তবে ক্ষমতার অগ্নিপরীক্ষায় খামেনি টিকে গেছেন এবং নিজেকে দীর্ঘদিন ধরে শাসনকারী একজন নেতায় রূপান্তরিত করেন। যারা তাকে ক্ষমতার শিখরে তুলেছিল তাদেরই তিনি খুব সাবধানতার সঙ্গে নির্মূল করেছেন, যাতে তারা তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে। তবে বর্তমানে আইআরজিসির অনেক ক্ষমতা। ফলে আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়া কঠিন হবে।
প্রেক্ষাপট
রবিবার হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি ও তার সহযাত্রীদের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির কর্তৃপক্ষ। রবিবার দেশটির পূর্ব আজারবাইন প্রদেশে একটি প্রকল্পের উদ্বোধন শেষে ফেরার পথে দুর্গম বন ও পাহাড়ি অঞ্চলে বাজে আবহাওয়ার মধ্যে এই দুর্ঘটনা ঘটে।
রাইসির সঙ্গে আরও মারা গেছেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আবদুল্লাহিয়ান, পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের গভর্নর মালেক রাহমাতি এবং ওই প্রদেশে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির মুখপাত্র আয়াতুল্লাহ মোহাম্মদ আলী আলে-হাশেম।
রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টারটির বিধ্বস্তের ঘটনাকে এখন পর্যন্ত দুর্ঘটনা বলা হচ্ছে। তবে ইরানি জনগণ এই ঘটনাকে হত্যাকাণ্ড বলে ভাবতে পারে। কারণ এমন এক সময়ে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে, যখন ইসরায়েলের সঙ্গে ইরানের উত্তেজনা চলছে। উভয় দেশ একে অপরকে হামলার ঘটনাও ঘটেছে।
রাইসির মৃত্যুতে আপাতত ইরানের ক্ষমতাবলয়ে নতুন এক অধ্যায় শুরু হবে। এটি ইসলামি প্রজাতন্ত্রটিকে কয়েক মাস ধরে গ্রাস করবে। এর মধ্য দিয়ে শুধু রাইসির-পরবর্তী যুগের জন্য নয়, পাশাপাশি খামেনি-পরবর্তী সময়ের জন্যও মঞ্চ তৈরি হবে।
তথ্যসূত্র : মিডল ইস্ট ফোরাম, আল জাজিরা, মিডল ইস্ট মনিটর