ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র নিয়ে সৃষ্ট ধূম্রজালের মধ্যে তার পদত্যাগপত্র নিয়ে নতুন তথ্য দিয়েছেন প্রবীণ সাংবাদিক মতিউর রহমান চৌধুরী।
রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে উদ্ধৃত করে তিনি জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগের কোনও দালিলিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বহু চেষ্টা করেও রাষ্ট্রপতি সেই পদত্যাগপত্র পেতে ব্যর্থ হয়েছেন।
ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা গত ৫ আগস্ট ভারত যাওয়ার পর দেশে আওয়ামী লীগের ছন্নছাড়া অবস্থার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে থাকা তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় একাধিক ভিডিও বার্তা দেন; সংবাদমাধ্যমে কথা বলেন। তিনি দাবি করেন, তার মা পদত্যাগ করেননি। পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সময় পাননি।
পদত্যাগপত্র নিয়ে গুঞ্জনের মধ্যে নীরবতা ভাঙেন শেখ হাসিনাও। ক্ষমতাচ্যুত করার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের মতো বিদেশি শক্তিগুলো রয়েছে বলে অভিযোগও করেন তিনি।
শেখ হাসিনা পদত্যাগপত্র নিয়ে আগ্রহ-কৌতুল থাকলেও সেই পদত্যাগপত্র পাওয়া যায়নি আজও। মাঝে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি পদত্যাগপত্রের ছবি ছড়িয়ে পড়লেও তার সত্যতা কেউ নিশ্চিত করতে পারেনি।
যার কাছে শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র থাকার কথা, তিনিও অনেক খুঁজে সেটা পাননি বলে ঘটনার প্রায় আড়াই মাস পর মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে।
‘উনি তো কিছুই বলে গেলেন না’ শিরোনামে এই ‘নেপথ্যের গল্প’ প্রকাশিত হয়েছে ‘জনতার চোখ’ নামের রাজনৈতিক ম্যাগাজিনে গতকাল ১৯ অক্টোবর।
প্রতিবেদনে প্রবীণ এই সাংবাদিক রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে তার কথোপকথন তুলে ধরেছেন। মতিউর রহমান চৌধুরী প্রতিবেদন শুরু করেছেন এভাবে-
“ক্ষমতাচ্যুত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন কি করেন নি এই নিয়ে বিতর্ক এখনো জারি রয়েছে। হয়তো অনেক দিন থাকবে। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় একাধিকবার দাবি করেছেন শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেননি। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান মিডিয়ার সামনে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের খবর জানিয়েছিলেন।
“প্রশ্ন উঠেছে প্রধানমন্ত্রী যদি পদত্যাগ করে থাকেন তাহলে সেটা গেল কোথায়? কারও কাছে এই প্রশ্নের জবাব নেই। তিন সপ্তাহ ধরে অনুসন্ধান চালিয়েছি। খোঁজ নিয়েছি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগেও। যেখানটায় প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের পদত্যাগপত্র থাকার কথা। কোথাও নেই। শেষ পর্যন্ত বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্ট সাহাবুদ্দিনের মুখোমুখি হলাম। অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে তিনি আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন।”
মতিউর রহমান চৌধুরী জানিয়েছেন, রাষ্ট্রপতিকে তাকে স্যার ডাকতে নিষেধ করেন। আলাপচারিতায় একসঙ্গে সাংবাদিকতায় আসার; বাংলার বাণীতে কাজ করা স্মৃতি স্মরণ করেন তারা।
মানবজমিন সম্পাদক বলেছেন, আবেগঘন সেই পরিবেশ স্বাভাবিক হতেই ‘প্রশ্ন করলাম আপনার কাছে কি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগপত্রটা আছে?
“জবাবে রাষ্ট্রপ্রধান বলেন, আমি শুনেছি তিনি পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু আমার কাছে কোনো দালিলিক প্রমাণ নেই। বহু চেষ্টা করেও আমি ব্যর্থ হয়েছি। তিনি হয়তো সময় পাননি।
“৫ই আগস্ট সকাল সাড়ে দশটায় বঙ্গভবনে ফোন এলো প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন থেকে। বলা হলো, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গভবনে আসবেন মহামান্য প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য। এটা শুনেই প্রস্তুতি শুরু হলো বঙ্গভবনে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ফোন এলো তিনি আসছেন না।”
রাষ্ট্রপতি সেই অস্থির সময়ে কী করেছিলেন, পদত্যাগপত্রের খোঁজ নিতে কী করেছিলেন সেকথা জানিয়েছেন বলে মতিউর রহমান চৌধুরী তার প্রতিবেদনে বলেছেন।
“রাষ্ট্রপতি বলেন, চারদিকে অস্থিরতার খবর। কী হতে যাচ্ছে জানি না। আমি তো গুজবের ওপর নির্ভর করে বসে থাকতে পারি না। তাই সামরিক সচিব জেনারেল আদিলকে বললাম খোঁজ নিতে। তার কাছেও কোনো খবর নেই। আমরা অপেক্ষা করছি। টেলিভিশনের স্ক্রলও দেখছি। কোথাও কোনো খবর নেই। এক পর্যায়ে শুনলাম, তিনি দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। আমাকে কিছুই বলে গেলেন না। যা সত্য তাই আপনাকে বললাম।”
“যাই হোক, সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার যখন বঙ্গভবনে এলেন তখন জানার চেষ্টা করেছি প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন কি না? একই জবাব। শুনেছি তিনি পদত্যাগ করেছেন। মনে হয় সে সময় পাননি জানানোর। সব কিছু যখন নিয়ন্ত্রণে এলো তখন একদিন মন্ত্রিপরিষদ সচিব এলেন পদত্যাগপত্রের কপি সংগ্রহ করতে। তাকে বললাম, আমিও খুঁজছি। এক পর্যায়ে প্রেসিডেন্ট বললেন, এ নিয়ে আর বিতর্কের কিছু নেই। প্রধানমন্ত্রী চলে গেছেন এটাই সত্য। তারপরও কখনো যাতে এ প্রশ্ন না উঠে সে জন্য সুপ্রিম কোর্টের মতামত নিয়েছি।
“প্রেসিডেন্টের পাঠানো রেফারেন্সের প্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ ৮ই আগস্ট এ সম্পর্কে তাদের মতামত দেন।
এতে বলা হয়, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সাংবিধানিক শূন্যতা দূর করতে এবং নির্বাহী কার্যক্রম সুন্দরভাবে পরিচালনার উদ্দেশ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা যেতে পারে। প্রেসিডেন্ট অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টামণ্ডলীকে শপথবাক্য পাঠ করাতে পারবেন বলে আপিল বিভাগ মতামত দেন।”
৫ আগস্ট বাংলাদেশ ছেড়ে ভারত যাওয়ার সময় শেখ হাসিনার সঙ্গে ছিলেন ছোট বোন শেখ রেহানা। সেদিন বিকেলে জাতির উদ্দেশে ভাষণে সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন। রাতে জাতির উদ্দেশে ভাষণে রাষ্ট্রপতিও একই কথা বলেন।
তবে ১০ আগস্ট বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনার ছেলে জয় বলেন, “মায়ের পরিকল্পনা ছিল একটি বিবৃতি দেবেন এবং নিজের পদত্যাগপত্র জমা দেবেন।
“কিন্তু ঠিক সেসময় আন্দোলনকারীরা প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের দিকে মিছিল নিয়ে এগোতে শুরু করে” উল্লেখ করে তিনি বলেন, “সেখানে তার হাতে আর সময় ছিল না। এমনকি আমার মা তার জিনিসপত্র গোছানোরও সময় পাননি। তাই সংবিধান অনুযায়ী, তিনি এখনও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।”
৫ আগস্টের ভাষণে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের ঘোষণাও দেন সেনাপ্রধান। এরপর ভেঙে দেওয়া হয় সংসদ। শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করে ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়।
এ প্রসঙ্গে জয় বলেন, প্রধানমন্ত্রীর আনুষ্ঠানিক পদত্যাগ ছাড়া যে তত্ত্বাবধায়ক (অন্তর্বর্তী) সরকার গঠিত হয়েছে তা আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যায়। বাংলাদেশে গণতন্ত্র ফিরলে শেখ হাসিনাও ফিরবেন বলে জানান তিনি।
এদিকে শেখ হাসিনা ভারতে যাওয়ার পর দেশটির সংবাদমাধ্যম দ্য প্রিন্ট জানিয়েছিল, দলীয় সমর্থকদের উদ্দেশে দেওয়া বার্তায় তিনি তার পদত্যাগের প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন।
তবে পরে জয় জানান, তার মা এই ধরনের কোনও বার্তা দেননি।