Beta
মঙ্গলবার, ৮ অক্টোবর, ২০২৪
Beta
মঙ্গলবার, ৮ অক্টোবর, ২০২৪

মেয়াদ শেষের আগেই বিদায় নেন যে সিইসিরা

সাবেক সিইসিরা
সাবেক সিইসি (বাঁ থেকে)- বিচারপতি এম এ আজিজ, বিচারপতি সুলতান হোসেন খান, বিচারপতি এ কে এম সাদেক ও বিচারপতি আবদুর রউফ।
Picture of খাইরুল বাশার

খাইরুল বাশার

মেয়াদ পাঁচ বছর, তার আড়াই বছর গড়াতেই পদত্যাগ করে বিদায় নিলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তিনি একাই নন, তার সহকর্মী অন্য চার নির্বাচন কমিশনারও পদত্যাগ করেছেন।

মেয়াদ শেষের আগে বাংলাদেশের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশনে পদত্যাগের নজির এটাই প্রথম নয়, এর আগে পাঁচজন সিইসিকে মেয়াদ শেষের আগেই বিদায় নিতে হয়েছিল।

তাদের তিনজন পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে গ্রহণযোগ্যতার সঙ্কটে বিদায় নিয়েছিলেন। সরকারের কাজে অসন্তোষ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন একজন। একজন বিদায় নিয়েছিলেন স্বাস্থ্যগত কারণে।

স্বাধীনতার পর এই পর্যন্ত বাংলাদেশে ১৩ জন সিইসির দায়িত্বে এসেছিলেন। অনেককে সময়ের আগে বিদায় নিতে হলেও ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত হয়ে আছেন বিচারপতি এ কে এম নুরুল ইসলাম। সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসাবে ৮ বছর দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

এইচ এম এরশাদ সরকার আমলে ১৯৯০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি চতুর্থ সিইসি হিসাবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন বিচারপতি সুলতান হোসেন খান। ওই বছরেরই শেষে গণআন্দোলনের এরশাদ সরকারের পতনের পর নির্বাচন কমিশনও ঢেলে সাজানো হয়। তাতে পদত্যাগ করে বিদায় নিতে হয় দেশের চতুর্থ সিইসি সুলতান হোসেনকে।

ফলে এক বছরও পদে ছিলেন না সুলতান হোসেন। তিনিই প্রথম সিইসি, যার দায়িত্বকালে কোনও ভোট হয়নি।

নব্বইয়ের গণআন্দোলনের পর ক্ষমতায় আসা বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন অস্থায়ী সরকারের সময় সিইসি পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন বিচারপতি আবদুর রউফ। তার অধীনেই ১৯৯১ সালে নির্বাচন হয়েছিল।   

তবে জাতীয় নির্বাচনের পর মাগুরা ও মিরপুরের দুটি উপনির্বাচন নিয়ে তিনি নিজেই অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। এর প্রতিক্রিয়ায় ১৯৯৫ সালের ১৮ এপ্রিল পদত্যাগ করে চলে যান তিনি।

বিচারপতি রউফ বিদায় নেওয়ার পর দেশের ষষ্ঠ সিইসি হিসাবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন বিচারপতি এ কে এম সাদেক। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচন তার সময়ই হয়েছিল।

আন্দোলনের চাপে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসার পর বিচারপতি সাদেককে বিদায় নিতে হয়। তিনিও নিজের মেয়াদের এক বছর পূর্ণ করতে পারেননি।

বিচারপতি সাদেক বিদায় নেওয়ার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে সিইসি পদে প্রথম আমলা হিসাবে নিয়োগ পান আবু হেনা। তিনি চার বছর পর স্বাস্থ্যগত কারণে পদত্যাগ করেছিলেন।

২০০৫ সালে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে সিইসি পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন বিচারপতি এম এ আজিজ। ভোটার তালিকা নিয়ে ব্যাপক বিতর্কের পর রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে জরুরি অবস্থা জারির পর তাকে পদত্যাগ করে বিদায় নিতে হয়েছিল। দুই বছর দায়িত্ব পালনকালে কোনও নির্বাচন করতে পারেননি তিনি।

নির্বাচন কমিশনে নিয়োগে আইন হওয়ার পর ২০২২ সালে সেই আইনে প্রথম নিয়োগ পান কাজী হাবিবুল আউয়াল। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হয় তার নেতৃত্বে।

সেই নির্বাচনে গঠিত আওয়ামী লীগ সরকার আট মাসের মধ্যে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে বিদায় নিলে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। এতে সাংবিধানিক সংকটের বিষয়টি তুলে ধরার পর আউয়াল নেতৃত্বাধীন ইসির সবাই একযোগে পদত্যাগ করলেন। দুই বছর ছয় মাস দায়িত্বে ছিলেন তারা।

নির্বাচন ভবন। ফাইল ছবি

শুরু থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত সিইসির দায়িত্বে যারা এসেছিলেন, তারা সবাই ছিলেন উচ্চ আদালতের বিচারক। আবু হেনাই প্রথম এই পদে আসেন বিচারাঙ্গনের বাইরে থেকে।

সাবেক সচিব কাজী হাবিবুল আউয়াল দেশের ত্রয়োদশ ইসির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তার সময়ের চারজনকে নিয়ে দেশে নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেন মোট ৩১ জন।

ইদ্রিস কমিশন: স্বাধীন বাংলাদেশে বিচারপতি মো. ইদ্রিসের নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশনের যাত্রা শুরু হয়েছিল। ১৯৭২ সালের ৭ জুলাই তিনি সিইসি পদে নিয়োগ পান। পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্ণ করে তিনি ৭ জুলাই ১৯৭৭ সালে অবসরে যান।

১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করে এই কমিশন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৯৩টি আসনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছিল। এই নির্বাচনে ১১টি আসনে প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। এ নির্বাচনে ভোটের হার ছিল ৫৪ দমশিক ৯ শতাংশ।

নুরুল ইসলাম কমিশন: ১৯৭৭ সালের ৮ জুলাই দ্বিতীয় প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসাবে দায়িত্ব পান বিচারপতি এ কে এম নুরুল ইসলাম। বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদে দায়িত্ব পালন করে

১৯৮৫ সালের ১৭ ফ্রেব্রুয়ারি বিদায় নেন তিনি।

তার নেতৃত্বে ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। ৩০০ আসনের মধ্যে জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি ২০৭টি আসন পায়। ৫১ দশমিক ৩ শতাংশ ভোটার এ নির্বাচনে ভোট দেয়।

মাসুদ কমিশন: বিচারপতি এ টি এম মাসুদ তৃতীয় সিইসি হিসাবে দায়িত্ব পান ১৯৮৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি। তিনি এই পদে ছিলেন ১৯৯০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।

তার নেতৃত্বে ১৯৮৬ সালে তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং ১৯৮৮ সালের চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই দুই নির্বাচনেই বিজয়ী হয় জাতীয় পার্টি।

১৯৮৬ সালে ৭ মে তৃতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। জাতীয় পার্টি ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৫৩টিতে জয়ী হয়। ভোটের হার ছিল ৬১ দশমিক ১ শতাংশ। ১৯৮৮ সালে ৩ মার্চ চতুর্থ সংসদ নির্বাচন হয়। এই নির্বাচন বর্জন করেছিল অধিকাংশ দল। জাতীয় পার্টি ৩০০ আসনের মধ্যে ২৫১টিতে জয়ী হয়। ভোটের হার ছিল ৫২ দশমিক ৫ শতাংশ।

সুলতান কমিশন:  ১৯৯০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি চতুর্থ সিইসি হিসেবে দায়িত্ব নেন বিচারপতি সুলতান হোসেন খান। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদ ক্ষমতা ছাড়ার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পরে ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১০ মাসের মেয়াদে কোনও নির্বাচন করতে হয়নি তাকে।

রউফ কমিশন:  দেশের পঞ্চম সিইসি হিসাবে দায়িত্ব বিচারপতি আবদুর রউফ দায়িত্ব নেন ১৯৯০ সালের ২৫ ডিসেম্বর। ১৯৯১ সালের পঞ্চম জাতীয় নির্বাচন হয় তার নেতৃত্বে।

নির্বাচনে বিএনপি ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৪০টিতে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। ভোটের হার ছিল ৫৫ দশমিক ৪ শতাংশ।

মাগুরা ও মিরপুরের দুটি বিতর্কিত উপনির্বাচনের পর ১৯৯৫ সালের ১৮ এপ্রিল পদত্যাগ করেন আবদুর রউফ।

সাদেক কমিশন: বিচারপতি এ কে এম সাদেক ১৯৯৫ সালের ২৭ এপ্রিল ষষ্ঠ সিইসি হিসাবে নিয়োগ পান। এই কমিশনের অধীনেই হয় ১৯৯৬ সালের বহুল আলোচিত ও বিতর্কিত ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন হয়। অধিকাংশ দলের বর্জনের মধ্যে অনুষ্ঠিত সেই নির্বাচনে ভোটের হার ছিল ২১ শতাংশ।

আন্দোলনের চাপে বিএনপি সরে দাঁড়ালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসার পর ১৯৯৬ সালের ৬ এপ্রিল বিদায় নেন বিচারপতি এ কে এম সাদিক।

হেনা কমিশন: সাবেক আমলা আবু হেনা ১৯৯৬ সালের ৯ এপ্রিল সিইসির দায়িত্ব নেন। ২০০০ সালের ৮ মে পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করেন তিনি।

১৯৯৬ সালের ১২ জুন সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় আবু হেনার নেতৃত্বে। নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৪৬টি আসনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। বিএনপি পেয়েছিল ১১৬ আসন। এই নির্বাচনে ভোটের হার ছিল ৭৫ শতাংশ।

সাঈদ কমিশন: ২০০০ সালের ২৩ মে দেশের অষ্টম সিইসি হিসাবে দায়িত্ব নেন সাবেক সচিব এম এ সাঈদ। ২০০৫ সালের ২২ মে পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে সাঈদ কমিশন।

এই কমিশনের অধীনে ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তাতে ১৯৩টি আসনে জয়ী হয় বিএনপি। আওয়ামী লীগ পায় ৬২টি আসন।

আজিজ কমিশন: ২০০৫ সালের ২৩ মে সিইসির দায়িত্ব নেন বিচারপতি এম এ আজিজ। ব্যাপক রাজনৈতিক টানাপড়েনের মধ্যে ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি নবম জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন তিনি। কিন্তু এর মধ্যে জরুরি অবস্থা জারির পর সেই তফসিল বাতিল হয়। তত্ত্ববধায়ক সরকার আসার পর ২১ জানুয়ারি পদত্যাগ করে বিদায় নেন বিচারপতি আজিজ।

শামসুল হুদা কমিশন:  ২০০৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি দেশের দশম সিইসি হিসাবে দায়িত্ব নেন সাবেক আমলা এ টি এম শামসুল হুদা। মেয়াদ শেষে ২০১২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বিদায় নেন তিনি।

এই কমিশনের অধীনেই ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ভোটে ৩০০টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২৩০টি আসনে জয়ী হয়। বিএনপি ৩০টি আসন পায়। নির্বাচনে ভোটের হার ছিল ৮৭.১৩ শতাংশ।

বৃহস্পতিবার নির্বাচন ভবনে সংবাদ সম্মেলন করে পদত্যাগের ঘোষণা দেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

রকিব কমিশন : ২০১২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি সিইসির দায়িত্ব নেন কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ। পূর্ণ পাঁচ বছর মেয়াদ শেষ করে ২০১৭ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি বিদায় নেন তিনি।

রকিব কমিশনের অধীনে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। অধিকাংশ দলের বর্জনের মধ্যে এই নির্বাচনে ১৫৩ আসনে একক প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। ১৪৭টি আসনে ভোটগ্রহণ হয়। আওয়ামী লীগ ২৩৪টি আসনে জেতে। জাতীয় পার্টি পায় ৩৪টি আসন।

ভোটের হার ছিল ৪০.০৪ শতাংশ।

নূরুল হুদা কমিশন: ২০১৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সিইসির দায়িত্ব নেন কে এম নুরুল হুদা। পাঁচ বছঁর মেয়াদ শেষ করে ২০২২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি বিদায় নেন তিনি।

হুদার নেতৃত্বে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। তবে দিনের ভোট রাতে হওয়ার সমালোচনাও শুনতে হয়েছিল এই কমিশনকে। এ নির্বাচনে ভোটের হার ছিল ৮০.২০ শতাংশ।

আওয়ামী লীগ ২৫৮টি আসনে জয়ী হয়। জাতীয় পার্টি ২২টি, বিএনপি ৬টি আসনে জিতেছিল।

আউয়াল কমিশন : আইন প্রণয়নের পরসার্চ কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ২০২২ সালে  ২৭ ফেব্রুয়ারি ত্রয়োদশ ইসি গঠিত হয়।  সিইসির দায়িত্ব নেন কাজী হাবিবুল আউয়াল।

তার অধীনেই ৭ জানুয়ারি ২০২৪ সালে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। তবে বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি দল ভোট বর্জন করেন।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২২২টি আসনে জয়ী হয়, জাতীয় পার্টি (জাপা) ১১ আসন পায়।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত