চার্লস নন বরং ডায়ানার ঘোড়দৌড়ের প্রশিক্ষক মেজর জেমস হিউইট ছিলেন তার ছোট সন্তান প্রিন্স হ্যারির আসল বাবা। এমন জল্পনা ব্রিটেনে চলছিল বহু বছর ধরেই।
মূলত কিছু ট্যাবলয়েড ম্যাগাজিন ও পত্রিকা ১৯৯০-র দশকের মাঝামাঝি সময়ে এই গুঞ্জন উসকে দিয়েছিল। প্রিন্সেস ডায়ানা তখনও বেঁচে। তবে তিনি কখনও এনিয়ে মুখ খোলার প্রয়োজন মনে করেননি। বিচ্ছেদের পর ১৯৯৭ সালে প্যারিসে এক গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যান তিনি।
গুঞ্জনটি উঠেছিল জেমস হিউইটের সঙ্গে হ্যারির কিছু মিল থাকায়। যেমন হিউইটের চুলের উজ্জ্বল লাল রঙ ও ত্বকের হালকা বাদামি রঙের ছোট ছোট দাগ প্রিন্স হ্যারির মধ্যেও দেখা যায়।
তবে ডায়ানার মৃত্যুর পর জেমস হিউইট নিজেই একে একটি গুজব বলে উড়িয়ে দেন।
সম্প্রতি বিষয়টি ফের আলোচনায় এসেছে ডায়ানার হেয়ার স্টাইলিস্ট রিচার্ড ডাল্টনের স্মৃতিকথার সূত্রে।
রিচার্ড ডাল্টন তার নতুন বই ‘ইটস অল অ্যাবাউট হেয়ার’ এ বিতর্কটির ওপর নতুন করে আলোকপাত করেছেন। এমনকি প্রয়াত রাজবধূর সঙ্গে তার বন্ধুত্বের বিষয়টিও তুলে ধরেছেন।
ডাল্টন ফক্স নিউজ ডিজিটালকে বলেছেন, “এটা (হিউইটের হ্যারির বাবা হওয়া) সম্ভব নয়।
“এটা বিশ্বাস করা কঠিন। কারণ ডায়ানা হিউইটের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ানোর আগেই হ্যারির জন্ম হয়েছিল। আমি মনে করি না, এটা কোনোভাবে সম্ভব।”
তার বক্তব্যের সমর্থনে ডাল্টন যুক্তি দেখিয়ে বলেন, এমনকি প্রিন্সেস ডায়ানার ভাই-বোনদেরও উজ্জ্বল লাল চুল ছিল।
ডাল্টনের দাবি অনুযায়ী, হ্যারি তার চুলের রঙ পেয়েছেন তার মায়ের বংশধারা থেকে। তার ভাষ্যে, লাল চুল স্পেনসার পরিবারের একটি বৈশিষ্ট্য।
“হ্যারি এবং স্পেন্সার পরিবারের সদস্যদেরও লাল চুল আছে। ডায়ানার ভাই আর্ল চার্লস যখন কলেজে ছিলেন তখন তারও উজ্জ্বল লাল চুল ছিল।”
ডায়ানার ভাইও তখন ডাল্টনের কাছেই চুল কাটাতেন।
ডায়ানার বোন সারার চুলও উজ্জ্বল লাল, যখন তার আরেক বোন জেন ‘কম বেশি ডায়ানার মতোই রঙের’ ছিলেন।
তার বইয়ে ডাল্টন বলেছেন, হিউইটকে হ্যারির বাবা বলে দাবি করা প্রতিবেদনগুলো দেখে খুব বিরক্ত হতেন ডায়ানা।
বলা হচ্ছে, ১৯৮৪ সালে হ্যারির জন্মের দুই বছর পর ১৯৮৬ সালে ডায়ানা ও হিউইটের মধ্যে প্রথম দেখা হয়। আর তারা প্রেমের সম্পর্কে জড়ান আরও তিন বছর পরে ১৯৮৯ সালে।
ডাল্টন তার বইয়ে লিখেছেন, প্রিন্স হ্যারির জন্ম হয়েছিল জেমস হিউইটের সঙ্গে ডায়ানার দেখা হওয়ার অনেক আগে। তাদের দুজনের মধ্যে যে প্রেমের সম্পর্ক ছিল ১৯৮৯ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত।
ডায়ানা যখন হিউইটের কাছ থেকে ঘোড়ায় চড়ার প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করে, তখন বিষয়টি ডাল্টনকে বিভ্রান্ত করেছিল। কারণ তিনি জানতেন, ডায়ানা ঘোড়ায় চড়া পছন্দ করেন না।
ডাল্টন লিখেছেন, “আমি তাদের সম্পর্কের বিষয়ে কিছুই জানতাম না এবং তাদের কোনও দেখা-সাক্ষাতেও জড়িত ছিলাম না। শুধু ডায়ানার চুল কাটার সময় তার কাছ থেকে তার নতুন প্রেমের গল্প শুনতাম।
“ডায়ানা যখন তার প্রেমিক সম্পর্কে কথা বলতেন, তখন তিনি মাঝে মাঝে ঘাবড়ে যেতেন, কারণ এটি তার কাছে নতুন ছিল। তবে, আমাদের সেই প্রেক্ষাপটটি মনে রাখা দরকার, যার কারণে এটি ঘটেছিল।”
ডাল্টনের ভাষায়, যুবতী ডায়ানা ছিলেন প্রেমের কাঙাল, কিন্তু তা তিনি পাচ্ছিলেন না চার্লসের কাছে। চার্লসের কাছে ডায়ানা ছিলেন শুধু তার উত্তরাধিকারী জন্ম দেওয়ার ‘মেশিন’। আর সেই কারণেই ডায়ানা অন্য সম্পর্কে ঝুঁকে পড়েন।
ডাল্টন লিখেছেন, “জেমস হিউইটকে দেখে আমার মন খারাপ হয়েছিল। কারণ সেও আদতে ডায়ানাকে ভালোবাসেনি। সেও তার লেখা বইয়ে স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দেয় যে, তার কাছে এই সম্পর্কটি ছিল একটি বিজয়, ভালোবাসার বিষয় নয়।
“তিনি ডায়ানাকে তার সবচেয়ে দুর্বল অবস্থায় পেয়েছিলেন। ওই সময়টাতে তার সঙ্গে ডায়ানার দেখা না হলে ডায়ানা হয়তো অন্য কারও সঙ্গে সম্পর্কে জড়াতেন।
তবে ডাল্টন মনে করেন, চার্লসই ছিলেন ডায়ানার আসল প্রেম, কিন্তু সেখান থেকে সাড়া পাননি তিনি।
ডাডাল্টন তার বইটি লিখতে দ্য প্রিন্সেস ডায়ানা মিউজিয়ামের কিউরেটর রেনা প্ল্যান্টের কাছ থেকেও সহায়তা নিয়েছিলেন। হ্যারির পিতৃ পরিচয় নিয়ে গুঞ্জন ডায়ানার মারাত্মক ক্ষতি করেছে বলে তারও মত।
প্ল্যান্ট ফক্স নিউজ ডিজিটালকে বলেন, “তিনি প্রকাশ্যে এসে কিছু বলতে পারেননি। অথচ এই সমস্ত গুজব চারপাশে চলছিল। তিনি সংবাদপত্র এবং এই সমস্ত গল্পের শিকার হয়ে অনেক যন্ত্রণা ভোগ করেছেন।”
প্ল্যান্ট উল্লেখ করেন, ডায়ানা ডাল্টনের বন্ধু ব্রিটিশ ব্রডকাস্টার অ্যান ডায়মন্ডের মতো হতে চেয়েছিলেন। জনসাধারণের কাছে যে কোনও সংবাদ দেওয়ার জন্য তার একটি পাবলিক প্ল্যাটফর্ম ছিল।
ডাল্টন ফক্স নিউজ ডিজিটালকে বলেন, “ডায়ানা বলতেন, ওহ, আমি যদি তার সম্পর্কে ক্ষতিকারক কিছু লেখার সময় আপনার বন্ধুর মতো হতে পারতাম। তিনি এটি টিভিতে ঠিক রাখতে পারেন।”
প্রিন্স হ্যারি তার আত্মজীবনীমূলক বই স্পেয়ারেও এই বিস্ফোরক বিষয়টি নিয়ে লিখেছেন। গত বছরের জানুয়ারিতে বইটি প্রকাশিত হয়।
বইয়ে হ্যারি লিখেছেন, “এই গুজবটি ছড়ানোর একটি কারণ ছিল আমার উজ্জ্বল লাল চুল। তবে আরেকটি কারণ ছিল লোকের ধর্ষকাম বা অন্যকে পীড়ন করে সুখলাভের মানসিক বিকার।
“ট্যাবলয়েডের পাঠকরা এই ধারণাটি পছন্দ করেছিলেন যে, প্রিন্স চার্লসের কনিষ্ঠ পুত্র প্রিন্স চার্লসের নিজের পুত্র নয়। সম্ভবত একজন যুবরাজের জীবন হাস্যকর ভেবে তারা নিজেদের জীবন নিয়ে সুখ লাভ করত।”
গত বছর হ্যারি তার ফোন হ্যাক করার মতো বেআইনি কৌশল ব্যবহার করে তথ্য সংগ্রহের অভিযোগে ডেইলি মিররের বিরুদ্ধে মামলা করেন। যুক্তরাজ্যের ট্যাবলয়েডটি তাদের অন্তত ১৫টি নিবন্ধে হ্যারির ফোন হ্যাক করে সংগ্রহ করা তথ্য ব্যবহার করেছে।
মামলাটির বিচার চলাকালে হ্যারি স্বীকার করেন, তার জন্ম নিয়ে ট্যাবলয়েডগুলোর ওই গুজব ছড়ানোর ফলে বছরের পর বছর ধরে তার জীবনের অনেক ক্ষতি হয়েছে।
গএক লিখিত বিবৃতিতে হ্যারি বলেন, “অনেক সংবাদপত্রে একটি গুজব প্রকাশিত হয়েছিল যে, আমার জৈবিক পিতা ছিলেন জেমস হিউইট। তিনি এমন একজন ব্যক্তি, যার সঙ্গে আমার জন্মের পর আমার মায়ের সম্পর্ক হয়েছিল।”
হ্যারি বলেন, “সংবাদপত্রগুলোতে এই গুজবটি ছড়ানোর সময়, আমি আসলে সচেতন ছিলাম না যে আমার জন্মের আগ মূহূর্ত পর্যন্ত আমার মায়ের সঙ্গে মেজর হিউইটের দেখাই হয়নি।
“সেই সময়ে, যখন আমার বয়স ১৮ বছর এবং মাত্র ছয় বছর আগে আমার মাকে হারিয়েছিলাম, এই ধরনের গালগল্পগুলো আমার জন্য খুব ক্ষতিকারক ছিল।”
“তারা ক্ষতিকর, নিচু এবং নিষ্ঠুর ছিল। গল্পের পেছনের উদ্দেশ্য নিয়ে আমার মধ্যে সবসময় প্রশ্ন জাগত। আমি নিজেকে প্রশ্ন করতাম, সংবাদপত্রগুলো কি জনসাধারণের মনে সন্দেহ তৈরি করতে আগ্রহী, যাতে আমাকে রাজপরিবার থেকে বিতাড়িত করা হয়?”
২০২৩ সালের শেষদিকে হ্যারি মিরর গ্রুপের বিরুদ্ধে তার ফোন হ্যাকিং মামলায় জিতেছেন। তাকে ১ লাখ ৮০ হাজার ডলারের বেশি ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছিল।
হ্যারি তার স্মৃতিকথা ‘স্পেয়ার’ এ বর্ণনা করেছেন, কীভাবে তার বাবা চার্লসও একবার এই গুজব নিয়ে তার সঙ্গে ‘দুঃখজনক’ রসিকতা করেছিলেন।
“বাবা গল্প বলা পছন্দ করতেন এবং এটি তার সেরা গুণগুলোর মধ্যে একটি। তিনি সবসময় দার্শনিকতার বিস্ফোরণ দিয়ে শেষ করতেন। একবার বললেন, ‘আমি সত্যিই ওয়েলসের প্রিন্স কি না, কে জানে? আমি তোমার আসল বাবাও কি না, কে জানে?’”
“একথা বলে তিনি হাসতে থাকেন, যদিও এটি কোনও মজার রসিকতা ছিল না,” লিখেছেন হ্যারি।
২০০২ সালে জেমস হিউইট নিজেও এই গুজবের বিরুদ্ধে কথা বলেন। তিনি বলেছিলেন, “আমার হ্যারির বাবা হওয়ার কোনও সম্ভাবনাই ছিল না। সংবাদপত্রগুলোর স্বার্থটা কী, তা আমি বুঝতে পারি। কিন্তু ডায়ানার সঙ্গে আমার সম্পর্ক শুরু হওয়ার সময় হ্যারি ইতিমধ্যেই হাঁটতে শুরু করেছিল।”
২০১৭ সালে অস্ট্রেলিয়ার একটি টিভি শোতেও আরও একবার বিষয়টি নিয়ে তিনি কথা বলেন। তিনি হ্যারির বাবা হতে পারেন কি না- প্রশ্ন করা হলে হিউইট জোর দিয়ে বলেন, “না, আমি নই। ট্যাবলয়েডগুলো তাদের কাটতি বাড়ানোর জন্য এই গুজব ছড়ায়।”
তথ্যসূত্র : ফক্স নিউজ