ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর বড় ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ বিদেশে পালিয়ে গেছেন। অনেকে গা ঢাকা দিয়েছেন, কয়েকজন কারাগারে রয়েছেন। আর রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায়ও অনেকে নতুন বিনিয়োগ করছেন না।
মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে নীতি সুদহার বাড়িয়েই চলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক; উঠেছে ১০ শতাংশে। ব্যাংক ঋণের সুদের হার ১৫ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। এই উচ্চ সুদহারের কারণেও বিনিয়োগ থেকে সরে আছেন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা।
এমন পরিস্থিতিতে দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান নিয়ামক বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি অক্টোবর মাসে কমে ৮ দশমিক ৩০ শতাংশে নেমে এসেছে; যা তিন বছর তিন মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। আগের মাস সেপ্টেম্বরে এই হার ছিল ৯ দশমিক ২০ শতাংশ।
বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংক যে ‘উইকলি সিলেক্টেড ইকোনমিক ইন্ডিকেটরস’ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের চতুর্থ মাস অক্টোবরে বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণের পরিমাণ আগের বছর একই সময়ের তুলনায় ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ বেড়েছে।
২০২১ সালের জুলাইয়ে এ খাতে ৮ দশমিক ৩৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। এরপর আর কখনও তা ৯ শতাংশের নিচে নামেনি।
চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় মাস অগাস্টে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ; প্রথম মাস জুলাইয়ে এই প্রবৃদ্ধি ছিল দুই অঙ্কের ঘরে (ডাবল ডিজিট) ১০ দশমিক ১৩ শতাংশ।
রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ব্যবসায় পরিবেশে অনিশ্চয়তা আর ব্যাংক ঋণে উচ্চ সুদহারের প্রভাবে গত কয়েক মাস ধরে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি কমছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা আছে ৯ দশমিক ৮০ শতাংশ। সে হিসাবে অক্টোবরের প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১ দশমিক ৫০ শতাংশীয় পয়েন্ট কম।
কিন্তু যে মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদহার বাড়িয়ে বেসরকারি ঋণে লাগাম দিয়েছে, সেই মূল্যস্ফীতি নভেম্বরে আরও চড়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বৃহস্পতিবার মূল্যস্ফীতির হালানাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, নভেম্বর মাসে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ। আগের মাস অক্টোবরে এই হার ছিল ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ।
সেপ্টেম্বরে এই হার ছিল এক অঙ্কের ঘরে (সিঙ্গেল ডিজিট) ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। তার আগের মাস আগস্টে মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ। তারও আগে জুলাই মাসে দেশে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ, যা ছিল এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ।
অর্থনীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে যাওয়ার মানে হলো, ব্যবসা ক্ষেত্রে বিনিয়োগ কমে যাবে। সেইসঙ্গে কমবে নতুন শিল্প স্থাপন বা শিল্প সম্প্রসারণের গতি। অবধারিতভাবে তার প্রভাব পড়বে বিনিয়োগে ও কর্মসংস্থানে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের শুরু থেকেই অর্থাৎ ১ জুলাই থেকে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সারাদেশ উত্তাল হতে শুরু করে। ছাত্রদের আন্দোলনে দমন-পীড়ন-সহিংসতা শুরু হলে দেশে চরম অস্থিরতা দেখা দেয়।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে শেখ হাসিনা ভারত চলে যাওয়ার পর ৮ আগস্ট থেকে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যাত্রা শুরু হয়েছে। কিন্তু আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির খুব উন্নতি হয়নি। বাজারে জিনিসপত্রের দাম আগের চেয়েও বেড়ে গেছে। স্বস্তি ফিরছে না মানুষের মধ্যে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, ২০২২ সালের আগস্টে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ১৪ দশমিক শূন্য সাত শতাংশে উঠেছিল। এরপর থেকে কমছেই।
২০২৩ সালের মে মাসে এই প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১১ দশমিক ১০ শতাংশ। তার আগের মাস এপ্রিলে ছিল ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ। মার্চে ছিল ১২ দশমিক শূন্য তিন শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ১২ দশমিক ১৪ শতাংশ। জানুয়ারিতে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১২ দশমিক ৬২ শতাংশ।
২০২২ সালের ডিসেম্বরে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ১২ দশমিক ৮৯ শতাংশ। নভেম্বরে ছিল ১৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ। অক্টোবর, সেপ্টেম্বর ও আগস্টে ছিল যথাক্রমে ১৩ দশমিক ৯১ শতাংশ, ১৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ ও ১৪ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ।
২০২১ সালের শেষ মাস ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ দশমিক ৬৮ শতাংশ। তার আগের মাস নভেম্বরে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ দশমিক ১১ শতাংশ; অক্টোবরে ৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ আর সেপ্টেম্বরে হয়েছিল ৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ। আগস্ট ও জুলাইয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল যথাক্রমে ৮ দশমিক ৪২ শতাংশ ও ৮ দশমিক ৩৮ শতাংশ।
কোভিড-১৯ মহামারীর ধাক্কায় কমতে কমতে ওই বছরের মে মাসে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৫৫ শতাংশে নেমে এসেছিল।
বেসরকারি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ব্যাংকের নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক সভাপতি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে বাংলাদেশ ব্যাংক ধারাবাহিকভাবে সঙ্কোচনমুখী মুদ্রানীতি গ্রহণ করছে। ফলে সকল ধরনের ঋণের সুদহার বেড়ে যাওয়ায় বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধিও কমে গেছে।” এক্ষেত্রে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনেরও একটা প্রভাব পড়েছে বলে ধারণা তার।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “দেশে অস্থির পরিস্থিতি বিরাজ করছে। আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। দিন যতো যাচ্ছে, অবস্থা ততোই খারাপের দিকে যাচ্ছে। কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না। সংঘাত-নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে সবার মধ্যে ভয়-আতঙ্ক বিরাজ করছে। এমন পরিস্থিতিতে ছোট ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে -বড় ব্যবসায়ী কেউই ঠিকমতো ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারছেন না।
“অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অনুসরণ করছে। এর অংশ হিসেবে নীতি সুদহার বাড়ানো হচ্ছে। এর ফলে ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়বে—এটাই স্বাভাবিক। সব মিলিয়ে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে।”
দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি বাংলাদেশ চেম্বারের বর্তমান সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “দেশে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। সবার মধ্যে ভয়-আতঙ্ক বিরাজ করছে। সর্বত্র অনিশ্চয়তা-অস্থিরতা; কোথাও স্বস্তি নেই। এ অবস্থায় বিনিয়োগ করবে কে, ঋণ নেবে কে?
“করোনা মহামারী, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলারের দর বৃদ্ধি, মধ্যপাচ্যের যুদ্ধ—একের পর এক ধাক্কায় বেশ কিছুদিন ধরেই আমাদের অর্থনীতি চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। এরই মধ্যে ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর লেগেছে আরেক ধাক্কা। পোশাক শিল্পের অস্থিরতা আমাদের আরেক চিন্তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। ব্যাংক ঋণের সুদের হার বেড়েই চলেছে। মূল্যস্ফীতি বাড়ায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে।”
“এমনটা চলতে থাকলে আমাদের কপালে কী আছে, কে জানে” যোগ করেন তিনি।