মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ও সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে ব্যয় সংকোচন করতে চায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
সরকারের পরিকল্পনা ও শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ সোমবার সাংবাদিকদের আরও জানিয়েছেন, যেসব প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা কম, বাস্তবায়নের শুরুর দিকে হলে কিছুটা আর্থিক ক্ষতি হলেও সেসব প্রকল্প বন্ধ করে দেওয়া উচিত।
একনেক সভায় অনুমোদনের অপেক্ষায় থাকা রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া প্রকল্পগুলো ছাঁটাই করা হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
ঢাকার শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভার পরে সাংবাদিকদের এসব কথা জানান উপদেষ্টা।
এর আগে গত ১৩ আগস্ট জনজীবন ও কর্মসংস্থানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে তালিকা তৈরির নির্দেশ দিয়েছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।
পরিকল্পনা ও শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ দেশের অর্থনীতির সব ক্ষেত্রে সংস্কারের ওপর গুরুত্বারোপ করে সাংবাদিকদের বলেন, “কিছু কিছু ক্ষেত্রে এখনই সংস্কারের প্রয়োজন। সামষ্টিক অর্থনীতির সঙ্গে পরিকল্পনা ও উন্নয়ন ব্যয়ের সরাসরি সম্পর্ক আছে।”
অর্থনীতির সাবেক এই অধ্যাপক সরকারি ব্যয় সংকোচনের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতির চাপ কমিয়ে আনার কথা উল্লেখ করে বলেন, “এখন আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করা ও মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনাই বড় বিষয়।
“সেখানে সরকারি ব্যয় সংকোচন কী করে করা যায় এবং ব্যয় সংকোচন করতে গেলে উন্নয়ন ব্যয়টাই সবচেয়ে নমনীয় করতে হবে। যাতে বেশি করে ঘাটতি বাজেট না হয় এবং মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা যায়।”
পুরো অর্থনীতির ব্যবস্থাপনায় প্রকল্প ব্যয় ও উন্নয়ন ব্যয়ের বড় ভূমিকা আছে মন্তব্য করে উন্নয়ন ব্যয় সংকোচনে প্রকল্প কমিয়ে খাতটিতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার আগ্রহ প্রকাশ করেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা।
তিনি বলেন, “পরিকল্পনা কমিশনের প্রত্যেকটি প্রকল্পের সঙ্গে আগের প্রশ্নটাই জড়িত যে, প্রত্যেকটি প্রকল্পযাচাই-বাচাই করা অত্যন্ত প্রয়োজন। কারণ এই মুহূর্তে প্রকল্পগুলোর যা অবস্থা- এটা এক ধরনের বিশৃঙ্খল অবস্থা। এখানে অনেকগুলো বিশৃঙ্খলা আছে।”
বিদেশি অর্থায়নপুষ্ট প্রকল্পে ‘বিশেষ সমস্যার’ কথা উল্লেখ করে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, “বিদেশি অর্থায়নে অনেক বড় বড় অনেক প্রকল্প আছে। সেখানে ওদের সাথে যে বোঝাবুঝি হয়েছে সেখানে অনেক অসুবিধা আছে।
“অনেক দাতাসংস্থার প্রতিশ্রুত অর্থের বড় একটা অঙ্ক এখন ব্যবহার করা যাচ্ছে না। কাজেই সেটাকে কীভাবে ছাড় করিয়ে নেওয়া যায়- সেটা একটা বিষয়। তাহলে আমাদের বৈদেশিক আর্থিক সমস্যার সমাধান হবে।”
তিনি বলেন, “আবার যে প্রকল্পগুলো আছে যেটা শুরুই হয়নি। কিছু আছে মাঝ পথে। কিছু আছে প্রায় সমাপ্তির পথে। আবার এক ধরনের প্রকল্প হলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে নিজেদের নির্বাচনী এলাকার জন্য। এখনও অপেক্ষমান অনেক প্রকল্প আছে, অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে– এগুলোকে আবার যাচাই-বাছাই করতে হবে।
“যেসব প্রকল্পের আসলেই কোনও অগ্রাধিকার নেই এবং এগুলো আসলেই কতটুকু সুবিধা বয়ে আনে এটা আমাদের অত্যন্ত দ্রুতগতিতে মূল্যায়ন করতে হবে এবং এগুলো ছাঁটাই করতে হবে।”
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, “যেগুলো চলমান প্রকল্প আছে, এগুলোর মধ্যেও চলমান থাকলেই যে রেখে দিতে হবে- এমন কোনও কথা নাই। যেসব প্রকল্প এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে আছে, এগুলোকে যদি মনে হয় যে অত্যন্ত অপচয়মূলক এবং এগুলো দিয়ে আসলেই কোনও লাভ হবে না, তখন কিছুটা ব্যয় সহ্য করে হলেও এগুলোকে থামিয়ে বাদ দিয়ে দেওয়ায় ভালো। এগুলোর জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা দ্রুত করতে হবে।
পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেন, “আমি প্রকল্প বিশৃঙ্খলার কথা এজন্য বলছি যে আমরা জানি আমাদের বড় বড় প্রকল্পগুলো- এগুলোতে যে নকশা ব্যয়, সময়সীমা- এগুলোতে প্রচণ্ড ধরনের অনিয়ম আছে। এই অনিয়ম কিছুটা আমাদের অদক্ষতার জন্য; আর কিছুটা হলো ঠিকাদারদের যোগসাজশে।
“সরকারের অনেক কাজের অনেক বড় ধরনের অনেক বড় দুর্নীতি আছে। যেমন অনেক অবকাঠামো প্রকল্প অনেক কম খরচে হতে পারত। উপযুক্ত মূল্যায়নের অভাবে, উপযুক্ত বাস্তবায়নের অভাবে এবং নকশার কাঠামোতেই অনেক ত্রুটি আছে। এ কারণেই বহুবার একটি প্রকল্পের নকশা পরিবর্তন করতে হয়। এগুলোর ব্যয় বৃদ্ধি হয়, সময় বৃদ্ধি করতে হয়- যেটা অত্যন্ত অপচয়মূলক।”
পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেন, “বাংলাদেশের অনেক বড় বড় প্রকল্পের যে খরচ হয়েছে বিশ্বের মধ্যে তা সবচেয়ে বেশি। এরকম অনেক উদাহরণ সবাই জানে।
”অনেক প্রকল্প আছে মন্ত্রণালয় থেকে আসে, এই প্রকল্পগুলো আসলে কী উদ্দেশ্যে করা হয়, এগুলো আসলেই কোনও প্রয়োজনে আসবে কিনা- সেদিকে না তাকিয়ে করা হয়।”
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ মনে করেন, এখানে দেশীয় ঠিকাদারদের রাজনৈতিক একটা প্রভাব আছে।
“যে কারণে দেখা যায়, কত যে কমপ্লেক্স তৈরি হলো, অবকাঠামো তৈরি হলো- কিন্তু সেটার ব্যবহার নেই বছরের পর বছর। পড়ে আছে”, বলেন তিনি।
পরিকল্পনা উপদেষ্টা বলেন, “এভাবে আর কোনও প্রকল্প না হয় সেটার দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। আর যে প্রকল্পগুলোর অবকাঠামো হয়ে গেছে- এগুলোতে অন্তত কিছু জনবলের জন্য বরাদ্দ দিয়ে এগুলোকে চালু করা যায় কি না সেটাও দেখতে হবে। খুব স্বল্প সময়ে এগুলো করতে হচ্ছে। কারণ একনেকের মিটিংয়ে এগুলো চলে আসবে।
“আমরা পুরো সামষ্টিক অর্থনীতি নিয়ে যে কৌশল এগুচ্ছি তাতে করে এই প্রকল্প ব্যবস্থাপনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এখানে প্ল্যানিং কমিশনের একটি বিরাট দায়িত্ব আছে। প্ল্যানিং কমিশনের সাথে অর্থ মন্ত্রণালয় এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) একজোট হয়ে সমন্বয় করে এটা করা হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথেও সমন্বয় করা দরকার। কারণ মূল্যস্ফীতির সাথেও এটার সম্পর্ক আছে।”
তিনি বলেন, “সুখের বিষয় যে নতুন উপদেষ্টা পরিষদে যারা আছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরসহ অনেক কর্মকর্তা আছেন, একযোগে কাজ করার মতো একটা টিম আছে আমাদের। সেটা অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় আমরা যে যে মন্ত্রণালয়েই থাকি না কেন পুরো অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা একটা সমন্বিতভাবে করার ব্যবস্থা এই অন্তর্বর্তী সরকারের আছে।”