২৪ বছর পর উত্তর কোরিয়া সফর করছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। দুদিনের সফরে বুধবার তিনি উত্তর কোরিয়ার রাজধানী পিয়ংইয়ং পৌঁছান।
এর আগে সর্বশেষ ২০০০ সালে প্রথমবার রুশ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর পুতিন উত্তর কোরিয়ায় গিয়েছিলেন। তখন দেশটির বতর্মান নেতা কিম জং উনের বাবা কিম জং ইল দেশটির ক্ষমতায় ছিলেন।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে রাশিয়ার পূর্বাঞ্চলে কিম জং উন যখন পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করেন, তখনই তিনি পুতিনকে উত্তর কোরিয়া সফরে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।
রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে, পুতিন ৯ ঘণ্টার মতো উত্তর কোরিয়ায় অবস্থান করবেন এবং এর মধ্যে কিমের সঙ্গে প্রায় দেড় ঘণ্টার একটি বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। এই সফরে দেশ দুটির মধ্যে নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক বিষয়ে কয়েকটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে পারে।
উত্তর কোরিয়ার পর রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভিয়েতনাম সফরে যাবেন এবং বাণিজ্যসহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দেশটির নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করবেন।
পুতিনের এই সফর পারমাণবিক শক্তিধর দুই দেশের মধ্যেকার সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন এক মাত্রা যোগ করবে। একই সঙ্গে বিশ্ব রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলবে। চলমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে পুতিনের এবারের সফরটি নানা কারণে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ।
রুশ প্রেসিডেন্ট এমন এক সময়ে উত্তর কোরিয়া সফলে গেলেন, যখন উভয় দেশই আন্তর্জাতিকভাবে প্রায় বিচ্ছিন্ন হওয়ার পথে। রাশিয়া দীর্ঘকাল ধরেই উত্তর কোরিয়ার শাসকদের পৃষ্ঠপোষক। যদিও এ সম্পর্ক মাঝে-মধ্যে ওঠা-নামা করেছে। তবে ২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার পর উভয় দেশ একত্রে কাজ করার নতুন কারণ খুঁজে পেয়েছে।
পুতিনের লক্ষ্য অস্ত্রের সরবরাহ বাড়ানো
ইউক্রেনে হামলার পর থেকেই রাশিয়া ক্রমশ উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় করেছে। কারণ যুদ্ধের জন্য রাশিয়ার প্রচুর অস্ত্র দরকার। পুতিনের এই সফরের প্রধান লক্ষ্যও ইউক্রেনে যুদ্ধের জন্য উত্তর কোরিয়া থেকে অস্ত্রের সরবরাহ বাড়ানো।
পুতিন গত বছরই উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়েছিলেন। কারণ তার অস্ত্রের মজুদ কমে গেছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে দুই নেতার মধ্যে একটি যুগান্তকারী শীর্ষ বৈঠক হয়। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের দাবি, ওই বৈঠকের পর উত্তর কোরিয়া থেকে প্রচুর অস্ত্র ও ক্ষেপণাস্ত্র রাশিয়ায় প্রবাহিত হয়েছে। তবে দেশ দুটি এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
পুতিনের এই সফরে দুই দেশের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র চুক্তি হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যদিও তা প্রকাশ্যে হবে না। অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সহায়তার আড়ালে হবে।
বিশ্লেষকদের মতে, ইউক্রেন যুদ্ধে টিকে থাকতে এবং জয়ী হতে হলে রাশিয়ার প্রয়োজন বিপুল পরিমাণ অস্ত্র। সম্প্রতি, যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া অস্ত্র রাশিয়ার অভ্যন্তরে ব্যবহারের জন্য ইউক্রেনকে অনুমতি দেয় ওয়াশিংটন। প্রায় একই ধরনের অনুমতি দেয় পশ্চিমা আরও কয়েকটি রাষ্ট্র।
ফলে স্বাভাবিকভাবেই সেনা অভিযান জোরদারের পাশাপাশি নিজেদের অস্ত্রের ভাণ্ডার আরও সমৃদ্ধ করার তাগিদ অনুভব করে মস্কো। এ অবস্থায় উত্তর কোরিয়ার তৈরি আর কী ধরনের অস্ত্র ভবিষ্যতে রাশিয়ায় সরবরাহ করা হবে, তা নিয়ে পুতিনের এ সফরে চুক্তি হতে পারে। এ ছাড়া যৌথভাবে অস্ত্র তৈরির বিষয়েও দুদেশের মধ্যে সমঝোতা হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের আশঙ্কা, অস্ত্র সহায়তার বিনিময়ে রাশিয়া উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র ও পারমাণবিক কর্মসূচির জন্য সহায়তা প্রদান করতে পারে। এমন পদক্ষেপ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবে নিষিদ্ধ, রাশিয়াও যার একটি সদস্য।
একইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র পিয়ংইয়ংয়ের বিরুদ্ধে রাশিয়াকে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহের অভিযোগ এনেছে। তাদের দাবি, সেসব অস্ত্র ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যবহার করেছে রাশিয়া।
বিশ্লেষকদের ধারণা, পুতিনের এই সফর শুধু কিছু সামরিক চুক্তিতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। দুই একনায়ক তাদের দেশের মধ্যে সহযোগিতা কীভাবে আরও বাড়ানো যায়, সে বিষয়েও আলোচনা করবেন।
পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে তাদের উভয়ের শত্রুতার প্রেক্ষাপটে দেশ দুটি নিজেদের মধ্যে অংশীদারত্ব আরও বাড়াবে। দুদেশের মধ্যে একটি নতুন কৌশলগত অংশীদারত্ব চুক্তি স্বাক্ষর হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
পুতিনও সফরের আগে বলেছিলেন, দুই দেশ “ইউরেশিয়ায় সমান এবং অবিভাজ্য নিরাপত্তার স্থাপত্যকে রূপ দেবে।” অর্থনীতি এবং প্রতিরক্ষায়ও দেশ দুটির মধ্যে সহযোগিতার এক নতুন যুগের সূচনা হতে পারে।
যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির প্রভাষক এডওয়ার্ড হাওয়েল বলেছেন, “সম্পর্কটি কেবল সাময়িক প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে নয়। আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, রাষ্ট্র দুটি যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমানভাবে সমন্বিত ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্ট এবং জোটবদ্ধতা তৈরি করছে।”
গত মাসে পুতিন রাশিয়ার আরেক মিত্র চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গেও দেখা করতে গিয়েছেলেন। এরপর এ মাসে কয়েকদিন আগেই মাত্র যুক্তরাষ্ট্রসহ জি সেভেন জোটের দেশগুলোর নেতারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে তাদের ঐক্যবদ্ধতা দেখাতে ইতালিতে সম্মেলনে মিলিত হয়। তারপরই পুতিনের এই উত্তর কোরিয়া সফর।
এছাড়া উত্তর কোরিয়া সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র এবং এশিয়ায় তার দুই বড় মিত্র দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের মধ্যে ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তা সহযোগিতার বিরুদ্ধেও সরব হয়েছে। সব মিলিয়ে পুতিনের এই সফর আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে।
উত্তর কোরিয়া কী চায়
সফরের আগে উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক নিবন্ধে পুতিন ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধের প্রতি অটল সমর্থন দেখানোর জন্য পিয়ংইয়ংকে ধন্যবাদ জানান। পুতিন এতে বলেন, দুটি দেশ “সম্মিলিত পশ্চিমের উচ্চাকাঙ্ক্ষার মোকাবেলা করতে প্রস্তুত।”
উত্তর কোরিয়ার সমর্থন অব্যাহত রাখার জন্য পুতিন ব্যাপকভাবে তার সফরকে কাজে লাগাবেন। এর বিনিময়ে উত্তর কোরিয়াকে রাশিয়া ঠিক কী কী সহায়তা দিচ্ছে, সে সম্পর্কে খুব কমই জানা গেছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার কর্মকর্তারা বলেছেন, উত্তর কোরিয়া রাশিয়ার কাছ থেকে খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের চালান পাচ্ছে। আর নিষেধাজ্ঞায় থাকা অর্থনীতির চাহিদার কোনও শেষ নেই। খাদ্য ছাড়াও জ্বালানি ও কাঁচামালের অভাব রয়েছে। তবে উত্তর কোরিয়া তার মহাকাশ ক্ষেপণাস্ত্র এবং পারমাণবিক কর্মসূচিকে এগিয়ে নিতেও রাশিয়ার সহায়তা চায়।
পুতিনও গত সেপ্টেম্বরের বৈঠকেই উত্তর কোরিয়ার মহাকাশ ও স্যাটেলাইট কর্মসূচি এগিয়ে নিতে রাশিয়ার সহায়তার ইঙ্গিত দিয়েছেন। সেই বৈঠক হয়েছিল রাশিয়ার একটি রকেট উৎক্ষেপণ কেন্দ্রে।
ওই বৈঠকের কিছুদিন পরই উত্তর কোরিয়া তাদের প্রথম সামরিক পুনরুদ্ধার স্যাটেলাইট ‘ম্যালিগইয়ং-১’ সফলভাবে উৎক্ষেপণ করে।
এই ধরনের স্যাটেলাইট উত্তর কোরিয়াকে তার স্থল-ভিত্তিক সামরিক সক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করবে। উদাহরণস্বরূপ, এর মাধ্যমে প্রতিপক্ষের অবস্থান আরও সঠিকভাবে শনাক্ত করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো সম্ভব হবে।
এছাড়া উত্তর কোরিয়া রাশিয়ার কাছ থেকে উন্নত অস্ত্রশসত্র এবং সেইসঙ্গে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ, পারমাণবিক চুল্লির নকশা বা সাবমেরিনের প্রযুক্তি চাইতে পারে।
তবে জাতিসংঘের সদস্য হিসেবে রাশিয়া উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচিতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সাহায্য বা অস্ত্র হস্তান্তর করতে পারে না। সেটা করলে রাশিয়ার বিরুদ্ধে জাতিসংঘও পদক্ষেপ নিতে পারবে।
তবে গত সপ্তাহে এসব বিষয়ে পশ্চিমাদের উদ্বেগ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে রুশ প্রেসিডেন্ট দপ্তরের একজন মুখপাত্র বলেছিলেন, “দেশ দুটির দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নয়নের সম্ভাবনা গভীর এবং তা অন্য কারো উদ্বেগের কারণ হওয়া উচিৎ নয়। এর বিরুদ্ধে কারো চ্যালেঞ্জ জানানোও উচিৎ হবে না।”
পশ্চিমকে ভয় দেখানোও পুতিনের উদ্দেশ্য
বিশ্লেষকদের মতে, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রের একজন নেতা পুতিনের কাছ থেকে যেকোনও সমর্থন কিমের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য আশীর্বাদ, যিনি বিশ্ব মঞ্চে গভীরভাবে বিচ্ছিন্ন।
অন্যদিকে, পুতিনের জন্যও এই সফরটি একটি সংকেত বা হুমকি পাঠানোর একটি সুযোগ, যে রাশিয়া একা নয়।
ওয়াশিংটনের সেন্টার ফর আর্মস কন্ট্রোল অ্যান্ড নন-প্রলিফারেশন এর সিনিয়র পলিসি ডিরেক্টর জন ইরাথ বলেছেন, “পুতিন দেখাচ্ছেন যে, রাশিয়ার বন্ধু আছে এবং ইউক্রেন যুদ্ধে জয়ী হতে পারবে না। কারণ রাশিয়ার অস্ত্রের সরবরাহ শেষ হবে না।”
ইরাথ বলেন, “পুতিন কিমের সঙ্গে তার সম্পর্ককে পারমাণবিক যুদ্ধের ভীতি বাড়ানোর উপায় হিসেবেও দেখতে পারেন। এই ভীতি প্রদর্শন করে তিনি ইউক্রেন ইস্যুতে রাশিয়ার শর্ত মেনে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খুঁজতে পশ্চিমকে বাধ্য করতে চাইছেন।”
গত রবিবার ইউক্রেনের ডাকা আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলনের আগে শুক্রবার পুতিন তার শান্তির শর্তগুলো তুলে ধরেছিলেন। একটি শর্ত হল ইউক্রেনের চারটি আংশিকভাবে রুশ অধিকৃত অঞ্চল থেকে ইউক্রেনীয় সেনা প্রত্যাহার করতে হবে। কিন্তু এই শর্ত কিয়েভ ও পশ্চিমারা কখনোই মানবে না।
তবে পর্যবেক্ষকরা একমত যে, এই সময়ে উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচিতে রাশিয়ার সরাসরি সাহায্য করার সম্ভাবনা কম। কারণ পুতিন বা তার ঘনিষ্ঠ অংশীদার শি জিনপিংও এই অঞ্চলে পারমাণবিক সংঘর্ষ দেখতে চান না।
কিন্তু এটাও স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, উত্তর কোরিয়া-রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান সম্পর্ক, সেইসঙ্গে রাশিয়া, চীন এবং পশ্চিমের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বিভেদ উত্তর কোরিয়ার অস্ত্র কর্মসূচি নিয়ন্ত্রণের আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টাকে প্রভাবিত করছে।
গত মার্চে উত্তর কোরিয়ার নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন নিয়ে তদন্তকারী বিশেষজ্ঞদের একটি স্বাধীন প্যানেল পুনর্নবায়নের প্রস্তাব তোলা হয়েছিল জাতিসংঘে। রাশিয়া এতে ভেটো দেয়।
চীন এতে ভোটদানে বিরত ছিল। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনও উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে আনা একাধিক প্রস্তাব আটকে দিয়েছে।
তথ্যসূত্র : সিএনএন, বিবিসি, আল জাজিরা