সম্প্রতি মঙ্গোলিয়ায় সফর করেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এসময় মঙ্গোলিয়া কর্তৃপক্ষ তাকে লাল গালিচা সংবর্ধনা দেয়। এমনটি রাশিয়ার সঙ্গে বিমান জ্বালানি সরবরাহ ও রেল যোগাযোগ সংক্রান্ত একটি সহযোগিতা চুক্তিও হয়।
অথচ কথা ছিল, মঙ্গোলিয়ার কর্তৃপক্ষ পুতিনকে গ্রেপ্তার করবে। এর কারণ উল্লেখ করে প্রতিবেদন করেছে একাধিক আন্তর্জাতিক মিডিয়া।
২০২৩ সালের মার্চে পুতিনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি)। আর মঙ্গোলিয়া হলো এই আদালতের সদস্য রাষ্ট্র। ফলে পুতিন যখন মঙ্গোলিয়ার মাটিতে পা রাখেন, তখনই তাকে গ্রেপ্তার করা হবে, এমনটাই চেয়েছিলেন অনেকে।
২০২২ সালে ইউক্রেনে অভিযানের পর রাশিয়া দেশটির যেসব এলাকা দখল করেছে সেখান থেকে অনেক শিশুকে ধরে রাশিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয় বলে অভিযোগ উঠে। আর সেই অভিযোগেই পুতিনের বিরুদ্ধে ওই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছিল। যদিও রাশিয়া সেই অভিযোগ অস্বীকার করে।
আইসিসি কারও বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলে এর সদস্য দেশগুলো সেই আসামিদের আটক করতে চুক্তিবদ্ধ। কিন্তু পুতিন ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মঙ্গোলিয়ায় অবস্থান করে বিনা বাধায় রাশিয়ায় ফিরে যান।
আইসিসি কি এবং কেন গুরুত্বপূর্ণ
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল জাতিসংঘের রোম সংবিধির মাধ্যমে, যা ১৯৯৮ সালে স্বাক্ষরিত এবং ২০০২ সালে কার্যকর করা হয়। এই স্থায়ী আন্তর্জাতিক আদালতে গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ এবং আগ্রাসনের অপরাধের জন্য দায়ীদের বিচার করা হয়।
বিশ্বব্যাপী ন্যায়বিচারের জন্য লড়াই করা অ্যাকটিভিস্টরা এটিকে একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক হিসাবে দেখেন। কারণ এর মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধের জন্য দায়ীদের জবাবদিহি করার একটি আইনি প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠিত হয়।
আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে আইসিসিকে শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে দেখা হয়। কোনও দেশের জাতীয় আদালত যদি কোনও গুরুতর অপরাধের বিচার করতে অনিচ্ছুক বা অক্ষম হয় তাহলে “পরিপূরকতার নীতির” অধীনে আইসিসি তার এখতিয়ার ব্যবহার করতে পারে।
২০০২ সাল থেকে আইসিসি বিশ্বব্যাপী ৫০ জনের বেশি ব্যক্তিকে বিভিন্ন অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত করেছে, যাদের বেশিরভাগই আফ্রিকান। ২১ জনকে নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগে আইসিসির কারাগারে পাঠানো হয়েছে। ১০ জনকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে এবং চারজনকে খালাস দেওয়া হয়েছে।
এর সদস্য কারা
আইসিসির সদস্য ১২৪টি রাষ্ট্র। তবে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া, ভারত ও ইসরায়েলের মতো কিছু দেশ আইসিসির সদস্য নয়। এই দেশগুলো জাতীয় সার্বভৌমত্ব, রাজনীতিকরণ এবং তাদের সামরিক বাহিনীকে টার্গেট করা সহ আদালত সম্পর্কে বিভিন্ন উদ্বেগের কথা উল্লেখ করেছে।
২০১৬ সালে রাশিয়া রোম সংবিধি থেকে তার স্বাক্ষর প্রত্যাহার করে নেয়। কারণ আইসিসি ২০১৪ সালে রাশিয়ার ক্রিমিয়া আক্রমণকে অবৈধ বলে ঘোষণা করে এবং জোরপূর্বক দখলদারিত্ব হিসাবে চিহ্নিত করে।
মঙ্গোলিয়ার কর্তৃপক্ষ পুতিনকে কেন গ্রেপ্তার করেনি
মঙ্গোলিয়া ২০০৩ সালে আইসিসির সদস্য হয়েছিল। এরপর ২০২৩ সালে এরডেনেবালসুরেন দামদিন নামের একজন মঙ্গোলিয়ান বিচারক আইসিসির বর্তমান বিচারকদের প্যানেলে যোগদান করেন।
পুতিনের সফরের আগে গত ৩০ আগস্ট আইসিসির মুখপাত্র ফাদি এল আবদুল্লাহ একটি বিবৃতি দেন। এতে তিনি বলেন, “মঙ্গোলিয়াকে ‘রোম সংবিধিতে স্বাক্ষরকারী একটি রাষ্ট্র পক্ষ’ হিসেবে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাসহ সব বিষয়ে আইসিসিকে সহযোগিতা করতে হবে।
এরপর ইউক্রেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং আইসিসিও পুতিনকে মঙ্গোলিয়ায় প্রবেশ করতে না দিতে বা তাকে গ্রেপ্তার করার আহ্বান জানায়। কিন্তু মঙ্গোলিয়া সেই আহ্বানে সাড়া না দিয়ে পুতিনকে লাল গালিচা সংবর্ধনা দেয়।
মঙ্গোলিয়ান সরকারের একজন মুখপাত্র দ্য পলিটিকোকে জানান, তাদের দেশ রাশিয়ার শক্তির উপর নির্ভরশীল। তাই তারা রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনকে গ্রেপ্তার করতে পারবে না।
ওই মুখপাত্র বলেন, “মঙ্গোলিয়া তার ৯৫ শতাংশ পেট্রোলিয়াম পণ্য এবং ২০ শতাংশের বেশি বিদ্যুৎ কাছের প্রতিবেশি দেশ থেকে আমদানি করে। আমাদের এবং আমাদের জনগণের অস্তিত্ব নিশ্চিতে এই তেলের সরবরাহ গুরুত্বপূর্ণ।”
আইসিসির সীমাবদ্ধতা হলো তার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা কার্যকরে কোনও সদস্য রাষ্ট্রকে বাধ্য করার ক্ষমতা নেই। আইসিসির কোনও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বাস্তবায়নের বিষয়টি পুরোপুরি এর সদস্য রাষ্ট্রের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে।
মঙ্গোলিয়ার পরিণতি কী হতে পারে
বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ সংস্থা পুতিনকে গ্রেপ্তারে ব্যর্থ হলে পরিণতি সম্পর্কে মঙ্গোলিয়াকে সতর্ক করেছিল।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল মঙ্গোলিয়ার নির্বাহী পরিচালক আলতানতুয়া বাতদর্জ বলেছেন, “মঙ্গোলিয়া যদি প্রেসিডন্ট পুতিনের জন্য ক্ষণস্থায়ী নিরাপদ আশ্রয়ও দেয় তাহলে দেশটি কার্যকরভাবে আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে সবচেয়ে গুরুতর অপরাধের জন্য দায়মুক্তি দেওয়ার সহযোগী হয়ে উঠবে।”
নিউইয়র্কভিত্তিক হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সিনিয়র আন্তর্জাতিক বিচার পরামর্শদাতা মারিয়ান এলেনা ভিগনোলি বলেন, “আইসিসির আসামি পুতিনকে স্বাগত জানানো শুধুমাত্র রাশিয়ান বাহিনীর অপরাধের অনেক শিকারের প্রতি অবমাননাই হবে না। বরং এই গুরুত্বপূর্ণ নীতিকেও ক্ষুন্ন করবে যে, যত শক্তিশালীই হোক না কেন, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়।”
পুতিনের সফরের আগে আইসিসির বিবৃতিতে এল আবদুল্লাহ আরও বলেন, “কোনও রাষ্ট্রের অসহযোগিতার ক্ষেত্রে আইসিসির বিচারকরা সেই বিষয়ে একটি অনুসন্ধান চালাতে পারেন। সেই রাষ্ট্রপক্ষের পার্লামেন্টকে অবহিত করতে পারেন। এরপর পার্লামেন্ট যা ভালো মনে করে, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে।”
তবে রাশিয়ার প্রেসিডেন্টকে গ্রেপ্তার না করায় মঙ্গোলিয়ার বিরুদ্ধে ঠিক কীভাবে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হতে পারে তা স্পষ্ট নয়।
একটি সম্ভাবনা হল আইসিসি থেকে মঙ্গোলিয়ার বিচারককে অপসারণ করা এবং রোম সংবিধির স্বাক্ষরকারী এবং অনুসমর্থনকারীদের তালিকা থেকে দেশটিকে সরিয়ে দেওয়া।
পুতিনের সফর থেকে রাশিয়া কী পেতে চেয়েছিল
ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেন, “প্রেসিডেন্টের সফরের সবদিক সাবধানে প্রস্তুত করা হয়েছিল।” আর ব্লুমবার্গ পুতিনের সফরের আগে জানিয়েছিল, সফরের সময় পুতিনকে গ্রেপ্তার করা হবে না, রাশিয়াকে এই নিশ্চয়তা দিয়েছিল মঙ্গোলিয়া।
ওয়াশিংটনভিত্তিক সেন্টার ফর ইউরোপিয়ান পলিসি অ্যানালাইসিসের ফেলো এলেনা দাভলিকানোভা লিখেছেন, রাশিয়া এই সফরকে ‘আইসিসিকে উপহাস করার জন্য’ ব্যবহার করছে।
দাভলিকানোভা লিখেছেন, “পুতিন এই সফরের মধ্য দিয়ে রাশিয়ার সীমান্তের ভেতরে কুরস্ক অঞ্চলে ইউক্রেনের হামলা থেকে সবার নজর অন্যদিকে ঘুরানোর চেষ্টা করেন। এছাড়া তার এই সফর দেশে ও বিদেশে শক্তিশালী নেতা হিসাবে পুতিনের ভাবমূর্তি বজায় রাখার সহায়ক একটি উপায়ও।”
তিনি আরও বলেন, পুতিনের সফর আইসিসি এবং ভবিষ্যতে যুদ্ধাপরাধের বিচারের যে কোনও সম্ভাবনাকে দুর্বল করতে সহায়ক হতে পারে। ইউক্রেনে রুশ বাহিনীর আগ্রাসনের অপরাধের বিচারের জন্য একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন নিয়ে বিভিন্ন দেশ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মধ্যে আলোচনা চলছে। তার মধ্যেই পুতিনের এই সফর।
তবে, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সাবেক পরিচালক কেনেথ রথ বলেছেন, পুতিনের মঙ্গোলিয়া সফর ছিল ‘দুর্বলতার লক্ষণ’। সোশাল মিডিয়া এক্সে এক পোস্টে রথ বলেন, পুতিন শুধু রাশিয়ার ছায়ায় বসবাসকারী ৩৪ লাখ জনসংখ্যার একটি দেশেই ভ্রমণ করতে পারেন।
এর আগে কি এমন কিছু ঘটেছে
আইসিসির গ্রেপ্তারি পরোয়ানার কারণে ২০২৩ সালে পুতিন দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে পারেননি। কারণ আইসিসি দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসার সরকারের উপর পুতিনকে সেদেশে গেলে আটক করার জন্য চাপ প্রয়োগ করেছিল।
এর আগে ২০১৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা তৎকালীন সুদানের প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরকে দেশটিতে সফরের সময় গ্রেফতারে ব্যর্থ হওয়ায় সমালোচনার মুখে পড়ে।
গত জুনে আইসিসির প্রধান কৌঁসুলি করিম খানের সমালোচনার পরে আইসিসির প্রতি ‘অটুট সমর্থন’ প্রকাশ করা ৯৪টি দেশের যৌথ বিবৃতিতে মঙ্গোলিয়াও স্বাক্ষর করেছিল।
করিম খান ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুসহ দুই ইসরায়েলি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন করেছিলন।
তিনি বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও তার প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ত এবং হামাসের সর্বোচ্চ নেতা ইসমাইল হানিয়া, গাজা শাখার প্রধান ইয়াহিয়া সিনওয়ার ও সামরিক শাখা কাস্সাম ব্রিগেডের প্রধান মোহাম্মদ দিয়াব ইব্রাহিম আল-মাসরি বা মোহাম্মদ দেইফের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন করেন।
ইসরায়েলে হামাসের হামলা এবং এর প্রতিক্রিয়ায় গাজায় চলমান যুদ্ধে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে এ আবেদন জানান তিনি।
করিম খান হামাসের তিন শীর্ষ নেতার পাশাপাশি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনেন। কিন্তু এতে যুক্তরাষ্ট্র তার কড়া সমালোচনা করে।
তথ্যসূত্র: রেডিও ফ্রি ইউরোপ, রেডিও লিবার্টি