এবার উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী হতে জামানত রাখতে হবে ১ লাখ টাকা। অথচ একাধিক উপজেলা নিয়ে গঠিত সংসদীয় আসনে ভোট করতে হলে জামানত রাখতে হয় ২০ হাজার টাকা।
স্থানীয় সরকার নির্বাচন আচরণ বিধিমালা ও নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালায় একগুচ্ছ পরিবর্তনের ফলেই মূলত তৃণমূলের ভোটে জামানত সংসদের ভোটের চেয়ে পাঁচ গুণ বেড়ে গেছে। হঠাৎ করে জামানতের পরিমাণ এত বাড়ানোয় তা নিয়ে প্রশ্নও উঠেছে।
৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন শেষ করেই চারধাপে উপজেলা ভোট করার সিদ্ধান্ত জানায় কাজী হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন ইসি। পাশাপাশি স্থানীয় সরকারে নির্বাচনী আচরণ বিধিমালা ও নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালায় একগুচ্ছ পরিবর্তনও আনা হয়।
এসব পরিবর্তনের ফলে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হতে আগে ১০ হাজার টাকা জামানত লাগলেও আসন্ন নির্বাচনে লাগবে এক লাখ টাকা। ভাইস চেয়ারম্যান পদে জামানত ৫ হাজার টাকা থেকে ১৫ গুণ বেড়ে হয়েছে ৭৫ হাজার টাকা।
অন্যদিকে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২ (আরপিও) অনুযায়ী, সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের জামানত ২০ হাজার টাকা।
ঝিনাইদহ-১ আসনের সংসদ সদস্য আবদুল হাইয়ের মৃত্যুতে সেখানে উপনির্বাচনের তফসিল ঘোষণা নিয়ে বৃহস্পতিবার ইসির বৈঠকে দুই জামানতের অঙ্কের এই পার্থক্যের বিষয়টি সামনে আসে। এদিনের বৈঠকে ১৫২ উপজেলায় ভোটের দিনক্ষণও ঠিক হয়।
জামানতের টাকা ভোটের পর ফেরত পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। নতুন বিধিমালা অনুযায়ী, উপজেলার নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের ১৫ শতাংশ না পেলে জামানতের টাকা আর ফেরত মিলবে না।
অন্যদিকে সংসদসহ স্থানীয় সরকারের অন্য নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের আট ভাগের এক ভাগ ভোট না পেলে জামানত বাজেয়াপ্ত হয়।
কোন যুক্তিতে বৃদ্ধি
ইসি কর্মকর্তারা বলছেন, মূল্যস্ফীতি হিসাব করে মূলত নতুন জামানতের অঙ্ক নির্ধারণ করা হয়েছে। কারণ আগের চেয়ে টাকার মান কমেছে। ধাপে ধাপে অন্যান্য ভোটেও জামানতের অঙ্কে পরিবর্তন আসবে।
এক কর্মকর্তা বলেন, উপজেলা ভোটের আচরণবিধি ও নির্বাচন পরিচলন বিধিমালার খসড়া যখন আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলো, তখনই কমিশন এর একটি ব্যাখ্যা দিয়েছিল। সেখানে বলা হয়েছিল, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সত্যিকার অর্থে আগ্রহী নন এমন প্রার্থীদের নির্বাচন থেকে দূরে রাখতেই জামানতের অঙ্ক বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
পরে মন্ত্রণালয় সেই সিদ্ধান্তে কমিশনের সঙ্গে সম্মতি দিলে তা বিধি আকারে পাস হয়।
উপজেলা ভোট ও সংসদ নির্বাচনে দুই ধরনের জামানতের বিষয়টি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হচ্ছে কি না- প্রশ্নে নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “উপজেলার ভোট তো ফ্রেশ ভোট। ঝিনাইদহ-১ আসনে যে ভোট, সেটা তো দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের উপ-নির্বাচন। আইন অনুযায়ী ভোটের জামানত ২০ হাজার লাগবে।”
এখন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ আরপিও পরিবর্তন করা যাবে না বলেও জানান তিনি।
‘অযৌক্তিক-অস্বাভাবিক’
দুই নির্বাচনে জামানতের এই বিপুল পার্থক্যকে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মত আসছে। আবার স্থানীয় সরকার নির্বাচনে জামানত বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন।
উপজেলা পরিষদে চেয়ারম্যান পদে জামানত এক লাখ টাকা করার কোনও যৌক্তিকতা দেখছেন না স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এটা না বাড়াতে বহুবার বলেছি। বাড়ানোর কোনও যৌক্তিকতা নেই। এখন এমপিদেরটা বাড়াক। এক লাখ টাকা করার দরকার ছিল কী?”
নির্বাচনী ব্যয় বাড়ার সঙ্গে জামানতের টাকা বাড়ানোর যে যুক্তি নির্বাচন কর্মকর্তারা দিয়ে থাকেন, সেই বিষয়ে অধ্যাপক তোফায়েল বলেন, “নির্বাচনে তো পাঁচ কোটি টাকা খরচ হয়। তাহলে কি পাঁচ কোটি টাকা জামানত নেবে?”
উপজেলা ও সংসদ নির্বাচনের জামানতের অঙ্কের বিশাল পার্থক্যকে ‘অত্যন্ত দুঃখজনক’ বলছেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এটাকে স্বাভাবিক বলা অন্যায় হবে।”
সংবিধানের প্রসঙ্গ টেনে রফিকুল বলেন, “সংবিধানে বলা আছে, বাংলাদেশের নাগরিক এবং ২৫ বছর হলে সে নির্বাচন করতে পারবে। কিন্তু এখন আপনার কাছে যদি ১ লাখ টাকা না থাকে, তাহলে আপনি ভোট করতে পারবেন না। তাহলে তো এটা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলো।”
নিজের উপজেলার প্রসঙ্গ টেনে সাবেক এই কমিশনার বলেন, “আমি একজন উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যানকে চিনি যার জামানতের পাঁচ হাজার টাকাও জনগণ জোগাড় করে দিয়েছিল। এখন জামানত এক লাখ টাকা হয়ে গেলে সেটা কি জোগাড় করে দেওয়া সম্ভব?”
কোন নির্বাচনে কত জামানত
সংসদ নির্বাচন : গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২ এর ১৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে নগদ অথবা ব্যাংক ড্রাফট, পে- অর্ডার, ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে ২০ হাজার টাকা মনোনয়নপত্রের সঙ্গে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে জমা দিতে হয়। একটি নির্দিষ্ট কোডে ট্রেজারিতে এই টাকা জমা দিতে হয়।
সংসদ নির্বাচনের ম্যানুয়াল অনুযায়ী, জমা দেওয়া অর্থ ফেরত দেওয়ার প্রয়োজন হলে রিটার্নিং কর্মকর্তার স্বাক্ষর ও সিলমোহরে অনুমোদন নিতে হবে।
সিটি করপোরেশন : স্থানীয় সরকারের (সিটি করপোরেশন) নির্বাচন বিধিমালা অনুসারে, মেয়র নির্বাচনের ক্ষেত্রে পাঁচ লাখ ভোটার সম্বলিত নির্বাচনী এলাকার জন্য ২০ হাজার টাকা। ১০ লাখ ভোটার হলে ৩০ হাজার টাকা। ১০ লাখ থেকে ২০ লাখ ভোটার হলে ৫০ হাজার টাকা। ২০ লাখের বেশি ভোটার হলে জমা দিতে হবে ১ লাখ টাকা।
কাউন্সিলর প্রার্থীদের ক্ষেত্রে ১৫ হাজার ভোটারের ওয়ার্ডের জন্য ১০ হাজার টাকা, ৫০ হাজারের বেশি ভোটারের ওয়ার্ডের জন্য ৫০ হাজার টাকা। সংরক্ষিত কাউন্সিলর প্রার্থীকে দিতে হয় ১০ হাজার টাকা।
পৌরসভা : মেয়র পদে ২৫ হাজার ভোটার সম্বলিত পৌরসভায় জামানত সর্বনিম্ন ১৫ হাজার টাকা। ১ লাখের বেশি ভোটার হলে সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকা। কাউন্সিলর পদে প্রার্থী হতে জামানত লাগে ৫ হাজার টাকা।
উপজেলা পরিষদ : চেয়ারম্যান পদে ভোট করতে হলে এক লাখ টাকা। ভাইস চেয়ারম্যান পদে ভোট করতে হলে ৭৫ হাজার টাকা। নারী সদস্যদের ক্ষেত্রে পাঁচ হাজার টাকা।
ইউনিয়ন পরিষদ : চেয়ারম্যানের ক্ষেত্রে পাঁচ হাজার টাকা, সাধারণ ও সংরক্ষিত ওয়ার্ডে সদস্যদের জন্য এক হাজার টাকা।