কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতার মাঝে যাদের চোখে গুলি লেগেছে তাদের অনেকে চিকিৎসাধীন রয়েছেন জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে। রবিবার কৌশলে রাজধানী ঢাকার আগারগাঁওয়ে অবস্থিত এই হাসপাতাল ঘুরে তাদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলতে পেরেছে সকাল সন্ধ্যা।
কথা হয়েছে এসব রোগীর স্বজনদের সঙ্গেও। এসব রোগী ও তাদের স্বজনরা সংশয়ে আছেন তাদের দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাওয়া নিয়ে। ভবিষ্যৎ নিয়ে পড়েছেন চরম অনিশ্চয়তায়।
তাদের একজন নাহিদা বেগম। তার ছেলে আল মামুন রাব্বী আছেন হাসপাতালের চতুর্থ তলায় পুরুষ ওয়ার্ডে।
নাহিদা বেগম জানান, তিনি মানুষের বাসায় কাজ করেন। অনেক কষ্ট করে ছেলেটাকে বড় করছিলেন। এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছেন। গত ১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার কলেজে গিয়েছিলেন শিক্ষকদের কাছ থেকে কিছু বিষয় বুঝে নিতে। সেখান থেকে বের হওয়ার পরপরই ছররা গুলি লাগে রাব্বীর বাম চোখে।
রাব্বী আর বাম চোখ দিয়ে দেখতে পারবেন কি না- তা নিয়ে সংশয়ে তার মা। সকাল সন্ধ্যার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে কেঁদে দেন তিনি।
চোখের পানি মুছতে মুছতে নাহিদা বেগম বলেন, “আমার ছেলেটা এইবার ইন্টার পরীক্ষা দিতাছিল। কিছু বিষয়ে কাঁচা ছিল দেইখ্যা কলেজে স্যাররা ডাকছিল। তাই ও গেছিল। বাইর হওয়ার লগে লগে কলেজের একদিকে যুবলীগ, আরেক দিকে পুলিশ। আমার পোলাটারে গুলি চালায় দিল।”
সাভারের সিএফএম কলেজের ছাত্র রাব্বী জানান সেদিনের ঘটনা।
সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “১৮ তারিখ ৯টা নাগাদ আমার প্রাইভেট ছিল কলেজে। ওই সময় তো গ্যাঞ্জাম ছিল না। ১১টার দিকে কলেজ থেকে বের হয়ে দেখি গ্যাঞ্জাম। সাভার সিটি সেন্টারের এইদিকে পুলিশ আর রেডিও কলোনি সাইডে ছিল ছাত্রলীগ।
“এদের মাঝখানে বিভিন্ন কলেজের পোলাপাইন আন্দোলন করতাছিল। ১০-১২ জন আমরা একসাথে কলেজ থেকে বের হইছি। ছাত্রলীগ আমাদের ধাওয়া দেয়। তখন আমরা দৌড় দিলে পুলিশ গুলি চালায়। আমার চোখে তখন গুলি লাগে।”
এই চক্ষু হাসপাতালে ঢুকতে নানা প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে সাংবাদিকদের। কৌশলে হাসপাতালে ঢোকার পর সকাল সন্ধ্যা রাব্বীর মতো আরও কয়েকজন রোগী ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলতে পেরেছে।
তাদের একজন মোসাম্মত মাসুদা বেগম। তিনি জানান, তাদের গ্রামের বাড়ি রংপুর। একটু বেশি আয়ের আশায় ভ্যানচালক স্বামীকে নিয়ে আসেন গাজীপুর। গাজীপুরে আসার পর তার স্বামী যুক্ত হন ঢাকা-গাজীপুর বাইপাসে ওভারব্রিজ বানানোর কাজে।
মাসুদা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমার স্বামী ২৫ বছর ধরে বাড়িতে ভ্যান চালায়। ওইখানে ইনকাম কম। তাই আমরা গাজীপুর আইছি। আমার স্বামী বাইপাসে ওভারব্রিজ আছে, ওইটা বানাতে কাম করত। শনিবার গেছে ওইখানে। ওরা কইল দেশের এই গ্যাঞ্জামে আজকে কাজ হইব না।”
“আমার স্বামী, আরও দুইজন একসাথে বাসায় ফিরতাছিল। ওই জায়গায় কোনও আন্দোলন ছিল না। আওয়ামী লীগের লোকজন আমার স্বামীকে দেখে পিটাইতে আসে। তখন আমার স্বামী দৌড় দেয়। অন্যদিকে থাকা পুলিশ একদম কাছ থেকে গুলি করে।”
মাসুদা বেগমের স্বামীর দুই চোখেই ছররা গুলি লেগেছে।
কান্না মুছতে মুছতে মাসুদা বেগম বলেন, “আমাকে ডাক্তার বলছে, আমার স্বামী আর চোখে দেখতে পারবে না। মাদ্রাজ নিয়ে যাইতে কইছে। আমি কীভাবে মাদ্রাজ নিয়া যাব? কেন আমার স্বামীকে গুলি করল? আমার স্বামী তো কোনও দোষ করে নাই। আমি এখন কেমনে চলুম?”
হাসপাতালে কথা হয় রিকশাচালক শফিকুলের সঙ্গে। তিনি থাকেন সাভার। শুক্রবার জুমার নামাজের পর বের হয়েছিলেন রিকশা নিয়ে। বাম চোখ দিয়ে আর কোনওদিন দেখতে পারবেন কিনা তা নিয়ে সংশয়ে আছেন তিনি।
শফিকুল সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “নামাজের পর গাড়ি নিয়ে বের হয়েছি। লাঙ্গলের মোড় থেকে যাত্রী নিলাম। যাচ্ছিলাম আনন্দবাজার। মাত্র গেন্ডা পার হইছি। আর দেখি ওইদিকে অনেক মানুষ খাড়ায় আছে। তখন দেখি অনেক পোলাপাইন দৌড়ে আসতাছে। দেখলাম রাস্তা ক্লিয়ার। ওইদিক থেকে ঝড়ের মতো পোলাপাইন দৌড়ে আসতাছে।
“ওই সময় আমি আর উল্টা ঘুরতে পারি নাই। পোলাপাইন পার হওয়ার পর আমি যখন রিকশা ঘুরাতে যাই তখন গুলি করে পুলিশ। পুলিশ একদম সামন থেকে গুলি করতাছিল। ছাত্রদের হাতে শুধু বাঁশ ছিল। সর্বোচ্চ ইট মারতাছিল। কিন্তু পুলিশ সেখানে গুলি মারা শুরু করে।”
তিনি আরও বলেন, “আমার বাম চোখটা ভালো হবে কিনা- তা তো এখানে কেউ বলতাছে না। দেখতে পারব, কি পারব না- তা তো কইতে পারতাছি না।”
শফিকুল তার ও পরিবারের ভবিষ্যৎ নিয়ে পড়েছেন চরম দুশ্চিন্তায়। তিনি বলেন, “আমার বাসায় ছোট দুইটা বাচ্চা আছে। আমার বউ গার্মেন্টসে চাকরি করে। সেও যাইতে পারতাছে না। এভাবে কয়দিন চলব, কীভাবে বাঁচুম এই চিন্তায় ঘুমাইতে পারি না।”
হাসপাতালে শফিকুলের সঙ্গে আছেন তার স্ত্রী নাজমা। তিনি জানান, সাড়ে ছয় বছরের ও পাঁচ বছরের দুটি সন্তান আছে তাদের। তারা সাভারের বাসায় আছে।
নাজমা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “একদিনের ছুটি নিয়ে আইছিলাম। এখন এখানে পাঁচ দিন ধরে আছি। চাকরি আছে কিনা তাও জানি না। আমার যদি এখন চাকরি চলে যায় তাহলে বাচ্চা দুইটারে দেখবে কে?”
একই অবস্থা মাদারীপুরের অনিকেরও। তিনি কাজ করতেন মাদারীপুর বিসিকে। বৃহস্পতিবার বিকাল ৫টার দিকে কারখানা থেকে বের হয়ে ফিরছিলেন বাসার দিকে।
অনিক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমি বাসার দিকে যাচ্ছিলাম। জজকোর্টের সামনে আন্দোলন চলছিল। কিন্তু তখন লোক কম ছিল। আমি তো বুঝি নাই। আমি হেঁটে পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছিলাম। তখন হঠাৎ করে গুলি এসে লাগে। আমি পরে বুঝতে পারি এক বাসার ছাদ থেকে পুলিশ গুলি করছিল। তাই রাস্তা খালি ছিল।”
আহত রোগীদের ব্যাপারে কথা বলতে রাজি হননি হাসপাতালের কোনও চিকিৎসক। রোগীদের বিষয়ে জানতে চাইলে পাল্টা প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়- “কীভাবে ওয়ার্ডে ঢুকলেন?”
কর্তব্যরত চিকিৎসক শাহরিয়ার বলেন, “কোনও কথা বলতে পারব না। সেনসিটিভ ইস্যুতে আলাপ করা যাবে না। আপনি বের হয়ে যান।”
হাসপাতাল পরিচালকের কক্ষের সামনে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করার কথা জানাতেই আনসারের এক সদস্য দ্রুত বের হয়ে যেতে বলেন।
হাসপাতালের নিচতলায় ১৪৬ নম্বর কক্ষে সহিংসতায় আক্রান্ত লোকদের সংখ্যার একটি তালিকা পাওয়া যায়। সে তালিকার তথ্য অনুসারে, ১৮ জুলাই থেকে ২৬ জুলাই পর্যন্ত ৩২৯ জন ভর্তি হয়েছেন। এদের মধ্যে চোখে অস্ত্রোপচার করাতে হয়েছে ৩০৫ জনের। এর মধ্যে ১৮ জুলাই থেকে ২০ জুলাই পর্যন্ত যথাক্রমে ৬৬ জন, ৯৩ জন ও ৬৮ জনের অস্ত্রোপচার করা হয়। গুলির আঘাত নিয়ে ২৮ জুলাই ভর্তি হন ১২ জন।