Beta
বুধবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৫
Beta
বুধবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৫

ধ্বংস, রক্ত আর মৃত্যু

বন্ধ থাকা ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের বনানী টোলপ্লাজার সামনে বসে আছেন এক কর্মী। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
বন্ধ থাকা ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের বনানী টোলপ্লাজার সামনে বসে আছেন এক কর্মী। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
[publishpress_authors_box]

শুক্রবার রাত ৮.৪০ মিনিট। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে মেঝেতে ছোপ ছোপ রক্ত। একের পর এক অ্যাম্বুলেন্স, অটোরিকশা এমনকি ট্রাক করে আসছে আহতরা। মানুষের আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠে হাসপাতালের পরিবেশ।

আহত রোগীদের সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছিল চিকিৎসকরা। একজন চিকিৎসককে অজ্ঞান হয়ে যেতে দেখা যায় সেদিন। আরেকজন চিকিৎসক প্রলাপের মতো বলছিলেন, “এত রক্ত কীভাবে সামলাব?”

এই যখন হাসপাতালের চিত্র, তখন ঢাকার বিভিন্ন স্থানে চলছে সংঘর্ষ, অগ্নিসংযোগ। আক্রমণকারীদের প্রধান লক্ষ্য সরকারি স্থাপনা।

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন সহিংসতায় গড়ানোর পর কয়েকদিন রক্ত, ধ্বংস আর দেড় শতাধিক মৃত্যু দেখল গোটা বাংলাদেশ।

বিজিবি নামিয়েও পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হওয়ার পর কারফিউ জারি করে সারাদেশে সেনা মোতায়েন করে সরকার। ঘোষণা করা হয় সাধারণ ছুটি। এরমধ্যে ইন্টারনেটও ছিল বন্ধ।

পাঁচ দিন পর দেশে ইন্টারনেট এসেছে, কারফিউ শিথিল করে অফিস-আদালতও খুলেছে। জনজীবন স্বাভাবিক এখনও হয়নি। পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হওয়ার পর এখন দেখা যাচ্ছে ধ্বংসের চিহ্ন।

সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা সড়কে অবস্থান নেওয়ায় রাজধানী ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ সব সড়ক নিশ্চল হয়ে পড়েছিল। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

এই আন্দোলনের সূত্রপাত হয় গত ৫ জুন, সরকারি চাকরিতে কোটা পুনর্বহাল করে হাইকোর্ট রায় দেওয়ার পর।

২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে চাকরিতে কোটা তুলে দিয়েছিল সরকার। সেই কোটা ফিরে আসায় ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ব্যানারে শুরু হয় নতুন আন্দোলন।

হাইকোর্টের রায় স্থগিতে সরকার আবেদন করলেও শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কারের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে ১ জুলাই থেকে মিছিল-সমাবেশ শুরু করে।

শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও শাহবাগকে কেন্দ্র করেই চলছিল শিক্ষার্থীদের কর্মসূচি। প্রায় প্রতিদিন শাহবাগে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করছিল তারা। ধীরে ধীরে আন্দোলনের পরিসরও বাড়ে।

১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারীরা আক্রান্ত হওয়ার পরদিন সারাদেশে পরিস্থিতি সংঘাতময় হয়ে ওঠে। তাতে মোট ছয়জন নিহত হয়।

এরপর ১৮ জুলাই থেকে দেশজুড়ে ব্যাপক সংঘাত হয়। তারপর থেকে পাঁচ দিনের সংঘাতে নিহত হয় দেড় শতাধিক। এরমধ্যে অগ্নিসংযোগ হয় বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায়।

ঘটনাক্রম

১৫ জুলাই, সোমবার

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা ছাত্রলীগের। দফায় দফায় সংঘর্ষ হয় ক্যাম্পাসে।  

গত সোমবার হামলার শিকার হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য’র বাসভবনের উল্টোপাশে ফুলার রোডে যাবার পথ ধরে দৌড়ে পালাচ্ছেন কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করা শিক্ষার্থীরা। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

১৬ জুলাই, মঙ্গলবার

সড়ক অবরোধ, সারাদেশে ব্যাপক সহিংসতা। ঢাকায় দুজন, চট্টগ্রামে তিনজন এবং রংপুরে একজন নিহত। কোটা পুনর্বহাল করে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সরকারের আপিলের আবেদন।

পুলিশের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো আবু সাঈদের ছবি এখন ব্যাপক আলোচিত।

১৭ জুলাই, বুধবার

পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে তীব্র সংঘর্ষ। জাতির উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ। সর্বোচ্চ আদালতের রায় না আসা পর্যন্ত সবাইকে ধৈর্য ধারণের আহ্বান। তাতে সাড়া না দিয়ে পরদিন ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ বা সর্বাত্মক বনধ কর্মসূচির ডাক আন্দোলনকারীদের। মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ। বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা।

১৮ জুলাই, বৃহস্পতিবার

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সারাদেশে পুলিশ ও সরকার সমর্থকদের সংঘর্ষ। অন্তত ৪১ জন নিহত। মেরুল বাড্ডায় পুলিশ অবরুদ্ধ, পরে হেলিকপ্টারে উদ্ধার। বিটিভি ভবন, সেতু ভবন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে অগ্নিসংযোগ। সারাদেশে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটও বন্ধ।

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরতদের ছত্রভঙ্গ করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে পুলিশ। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরতদের ছত্রভঙ্গ করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে পুলিশ। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

৫৬ শতাংশের পরিবর্তে ২০ শতাংশ কোটার প্রস্তাব আওয়ামী লীগের। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে সরকার রাজি বলে জানান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। সংঘাত ও শিক্ষার্থীর মৃত্যু তদন্তে বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত। আপিল বিভাগে শুনানি এগিয়ে ররিবার করার সিদ্ধান্ত। আলোচনার প্রস্তাব নাকচ আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের।

১৯ জুলাই, শুক্রবার

ব্যাপক সংঘর্ষ সারাদেশে। ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকা রণক্ষেত্র। নিহত অন্তত ৭৫। সবচেয়ে সহিংস এই দিনে মেট্রোরেল স্টেশন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোল প্লাজা, মিরপুর ইনডোর স্টেডিয়ামসহ বিভিন্ন সরকারি স্থাপনা ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ।

সরকারের উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে সারাদেশে কারফিউ জারি, সেনা মোতায়েন। বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী গ্রেপ্তার।

মহাখালীতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ভবনের সামনে পুড়ে যাওয়া গাড়ি। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
মহাখালীতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ভবনের সামনে পুড়ে যাওয়া গাড়ি। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

২০ জুলাই, শনিবার

কারফিউর মধ্যেও ঢাকা, সাভার, গাজীপুর, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘাত। নিহত অন্তত ৩৩।

আইনমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী ও তথ্য প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে নিজেদের আটটি দাবি জানালেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিন সমন্বয়ক। এই সাক্ষাৎ নিয়ে সমন্বয়কদের মধ্যে মতভেদ।

কারফিউ বহাল থাকায় রবি ও সোমবার সাধারণ ছুটি ঘোষণা।

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের বনানী টোলপ্লাজা পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তুপে। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের বনানী টোলপ্লাজা পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

২১ জুলাই, রবিবার

কড়া নিরাপত্তার মধ্যে আপিল বিভাগে শুনানির পর কোটা পুনর্বহাল নিয়ে হাইকোর্টের রায় বাতিল। মেধা ৯৩ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৫ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটা ১ শতাংশ, প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের কোটা ১ শতাংশ নির্ধারণের আদেশ। তবে সরকার চাইলে কোটা হার পুনর্বিন্যাস করতে পারে, জানিয়েছে আদালত।

কারফিউ অব্যাহত, সাধারণ ছুটির আওতায় অফিস-আদালতসহ সব কল কারখানা বন্ধ। কঠোর নিরাপত্তার মধ্যেও বিভিন্ন স্থানে সংঘাত, নিহত অন্তত ১২।

কারফিউ জারির পর সেনা মোতায়েন করা হয় সারাদেশে। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

২২ জুলাই, সোমবার

বিচ্ছিন্ন সংঘাত ঘটলেও আর কারও মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি। কমপ্লিট শাটডাউন ৪৮ ঘণ্টার জন্য স্থগিতের ঘোষণা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামের। এই সময়ের মধ্যে চার দফা দাবির বাস্তবায়নে সরকারকে আলটিমেটাম দিয়েছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম মঙ্গলবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

সাধারণ ছুটির মেয়াদ মঙ্গলবার পর্যন্ত বাড়ানোর ঘোষণা সরকারের। সোমবার পর্যন্ত পাঁচ শতাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের খবর দেয় পুলিশ।

২৩ জুলাই, মঙ্গলবার

কোটা সংস্কার করে সরকারের প্রজ্ঞাপন জারি। রাতে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সীমিত আকারে চালু। সাধারণ ছুটি আর না বাড়িয়ে বুধবার থেকে সীমিত পরিসরে অফিস-আদালত খোলার সিদ্ধান্ত। কারফিউ থাকছে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও নরসিংদীতে, তবে সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত শিথিলের ঘোষণা।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত