Beta
বৃহস্পতিবার, ৩ অক্টোবর, ২০২৪
Beta
বৃহস্পতিবার, ৩ অক্টোবর, ২০২৪

কোটা সংস্কার আন্দোলন : নতুন ধাক্কা রপ্তানি খাতে

রপ্তানি আদেশের কাজ গোছাতে কর্মব্যস্ত পোশাক শ্রমিকরা।
রপ্তানি আদেশের কাজ গোছাতে কর্মব্যস্ত পোশাক শ্রমিকরা।
Picture of জাফর আহমেদ

জাফর আহমেদ

কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে দেশের রপ্তানি খাত, বিশেষ করে পোশাক রপ্তানি খাত দেখছে আরও চ্যালেঞ্জ, যা উদ্বেগ বাড়িয়েছে ব্যবসায়ীদের।

তারা বলছেন, এই আন্দোলনের মধ্যে ঘটা সহিংসতার যেসব খবর বিদেশি গণমাধ্যমে প্রকাশ হচ্ছে, ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি, এ সময়ে ফ্যাক্টরি বন্ধ থেকেছে; তাতে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্য ভাবমূর্তি সঙ্কটে পড়ছে, যা নতুন চ্যালেঞ্জ।  

কোভিড-১৯ এর অভিঘাতের পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের রপ্তানি খাত ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেই ধকল এখনও মোকাবিলা করতে হচ্ছে বলে উল্লেখ করেছেন পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, বিশ্ববাজারে প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের পণ্যের দরপতন হচ্ছে। কিন্তু রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) ‘অসত্য তথ্যের’ কারণে তা দেশের মানুষ জানতে পারেনি।

চলতি মাসের শুরুতে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়ে ইপিবির দেওয়া রপ্তানি তথ্যে গলদ থাকার কথা জানিয়েছে। এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন হিসাবায়ন করে রপ্তানি আয়ের ‘প্রকৃত তথ্য’ প্রকাশ করে।

এরপর গত ১৪ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংক গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসের (জুলাই-মে) রপ্তানির প্রকাশ করে। তাতে দেখা যায়, ওই ১১ মাসে পণ্য রপ্তানি থেকে ৪ হাজার ৭২ কোটি ৯০ লাখ (৪০.৭৩ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে।

অথচ এর আগে গত ৪ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংক পুরনো হিসাবে রপ্তানির যে তথ্য প্রকাশ করেছিল, তাতে গেল অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে পণ্য রপ্তানি থেকে ৫ হাজার ১৫৪ কোটি ২৭ লাখ (৫১.৫৪ বিলিয়ন) ডলার আয়ের তথ্য উল্লেখ করা হয়েছিল।

অর্থাৎ নতুন হিসাবায়নের পর গত অর্থবছরের ১১ মাসেই রপ্তানি আয় ১ হাজার ৮১ কোটি ৩৭ লাখ (১০.৮১ বিলিয়ন) ডলার কম হয়েছে বলে জানানো হয়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো ওই চিঠিতে জানানো হয়, এভাবে বিগত দশ বছরে ইপিবি ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড পণ্যের এইচএস কোডের একাধিক এন্ট্রি, কাপড়ের দর, স্যাম্পল আইটেমও রপ্তানি দেখিয়েছে। এছাড়া  ইপিজেড থেকে দেশের ভেতরে বিক্রিকে রপ্তানি দেখিয়ে বিগত ১০ বছরে প্রায় ৬৪ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলার বেশি রপ্তানি দেখিয়েছে।

ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, কোভিড-১৯ মহামারীর পর ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর রপ্তানি খাত সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। এখন সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এগিয়ে যাওয়ার সময় গত কয়েক দিনে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে ঘটে যাওয়া ঘটনা বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের পণ্য ভাবমূর্তি সঙ্কটে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে রপ্তানি খাত, বিশেষ করে পোশাক রপ্তানি খাত আবারও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।

নতুন এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় রপ্তানিতে প্রণোদনা বহাল রাখার পাশাপাশি বন্দর কর্তৃপক্ষের সহযোগিতার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন ব্যবসায়ীরা।

বাংলাদেশের মোট রপ্তানির প্রায় ৮৫ শতাংশই তৈরি পোশাক; বিশ্ব বাজারে সেসব পণ্যের দরপতন চলছে বলে জানিয়েছেন এ খাতের ব্যবসায়ীরা।  

এ বিষয়ে পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি এস এম মান্নান কচি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “কোভিড-১৯ এর পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে আমরা একটা চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়েই যাচ্ছি। এই সময়ে বিশ্ববাজারে আমাদের পণ্যের দরপতন হয়েছে। প্রতিনিয়তই আমাদের পণ্যের দর কমাচ্ছে। একইসঙ্গে আমাদের অর্ডারও কমে যাচ্ছে।

“সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় গত দুই ঈদে আমাদের ১০-১২টা কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। আমাদের অনেক শ্রমিক বেকার হয়ে গেছে। ঠিক সেই মুহূর্তে আবারও বড় একটা ধাক্কা আমাদের এসে লাগল।”

আগের চ্যালেঞ্জ তুলে ধরে তিনি বলেন, “কোভিড-১৯ এর প্রভাবে আমাদের রপ্তানি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এরপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আমাদের রপ্তানি কমে গেছিল। প্রাইজ কমে গেছে।”

সেহা ডিজাইনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মান্নান কচি বলেন, “কোভিড-১৯ ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। উল্টো ব্যাংকের সুদ হার বেড়ে গেছে।”

এসব কারণে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের চাহিদা কমে যায় বলে দাবি করে তিনি বলেন, “এরকম পরিস্থিতির মুখে পড়লেই আমরা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ি।”

এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার মধ্যেই চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে পোশাক রপ্তানি খাতের প্রণোদনা কেটে নেওয়ার প্রসঙ্গ তুলে বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, “এই প্রণোদনা কেটে নেওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে সরকারের কাছে তা পুনর্বহালের আবেদন করেছি।”

গত ৩০ জুন বাংলাদেশ ব্যাংকের রপ্তানিতে নগদ সহায়তা কমানোর কথা জানিয়ে একটি সার্কুলার জারি করে। এতে বলা হয়, নতুন অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে জাহাজীকৃত রপ্তানিমুখী দেশীয় বস্ত্র খাতে শুল্ক বন্ড ও ডিউটি ড্র-ব্যাকের পরিবর্তে বিকল্প নগদ সহায়তা হবে দেড় শতাংশ।

এর আগে গত ফেব্রুয়ারিতে প্রণোদনা ৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ করা হয়। ইউরো অঞ্চলে বস্ত্র খাতের রপ্তানিকারকদের প্রণোদনার হার দেড় শতাংশের অতিরিক্ত বিশেষ সহায়তা কমিয়ে শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়।

পোশাক খাতের সব ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে অতিরিক্ত নগদ সহায়তা ১ শতাংশ কমিয়ে ৩ শতাংশ করা হয়। বস্ত্র খাতে নতুন পণ্য বা নতুন বাজার সম্প্রসারণ সুবিধা ২ শতাংশ কমিয়ে ২ শতাংশ করা হয়। তৈরি পোশাক খাতে বিশেষ নগদ সহায়তা শূন্য দশমিক ৭০ কমিয়ে শূন্য দশমিক শূন্য ৩ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়।

গত মার্চ মাসে নির্বাচিত বিজিএমইএর নতুন এই সভাপতি কচি বলেন, “গত কয়েক দিনে কোটা সংস্কার আন্দোলনে সৃষ্ট সহিংসতার কারণে পোশাক খাতেই প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে।

“আন্দোলনের সময় টানা চারদিন আমাদের কারখানা বন্ধ রাখতে হয়েছে। বন্ধ থাকায় প্রতিদিন আমাদের সবমিলে গড়ে এক হাজার ৬০০ কোটি টাকা করে লস হয়েছে। সেই হিসাবে চারদিন আমাদের ৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকার লস হয়েছে।”

“এই চারদিনে সব কারখানার পোশাক কর্মীদের বেতন দিতে হবে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। আর সুতা ও বোতাম কারখানার ক্ষতি হয়েছে কমপক্ষে ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। সবমিলে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে।”

আন্দোলন ঘিরে ঘটে যাওয়া সহিংস ঘটনার প্রসঙ্গ তুলে বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, “বহির্বিশ্ব দেখছে আমরা কাজ করতে পারতেছি না। ভাঙচুর হচ্ছে, জ্বালাও পোড়াও করছে, সন্ত্রাসীরা মানুষ খুন করছে।

“এসব নেতিবাচক কর্মকাণ্ড দেশে বিদেশে সব জায়গায় প্রচারিত হয়েছে। আবার ইন্টারনেট ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দিয়েছে, যার কারণে বেশ কয়েকদিন উদ্যোক্তারা ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারেনি।”

“বহির্বিশ্বে আমাদের ইমেজ, আমাদের ভাবমূর্তি অনেক ক্ষুণ্ন হয়েছে আমাদের দেশের আমাদের শিল্পের। কারণ, আমাদের ফ্যাক্টরি বন্ধ, আমরা কাজ করতে পারতেছি না।”

এসব কারণে পুরো রপ্তানি খাতই আরেকটি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে বলেন মনে করছেন বিজিএমই সভাপতি।

নিট পোশাক খাতের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মো. হাতেম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমরা আগে থেকেই বলে আসছিলাম কোভিড-১৯ ও ইউক্রেইন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশের রপ্তানি খাত ব্যাপক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। এবং ইপিবি রপ্তানির যে তথ্য দিচ্ছিল তা সঠিক নয়।

“এই সময়ে বাংলাদেশের রপ্তানি খাত বিশেষ করে পোশাক রপ্তানি আদেশ এবং পণ্যের দর দুটোই কমেছে। এই সময়ে আমাদের রপ্তানি নেতিবাচক হয়েছে।”

“বিশেষ করে আমরা ইউক্রেইন-রাশিয়া যুদ্ধের চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে উঠছিলাম। এমন মুহূর্তে গত এক সপ্তাহে যে পরিস্থিতি বিরাজমান ছিল তাতে আমাদের রপ্তানি খাত নিঃসন্দেহে আরেক দফা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।”

হাতেম বলেন, “গত এক সপ্তাহ ধরে যা হয়েছে, তা বিদেশি গণমাধ্যমে নেতিবাচকভাবে প্রচারিত হয়েছে। আমাদের ইন্টারনেট বন্ধ থাকার কারণে আমরা ক্রেতাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারি নাই।

“এই সময়ে তারা বিদেশি গণমাধ্যমে যা শুনেছেন তাই বিশ্বাস করেছেন। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের রপ্তানি খাত আবারও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে।”

তিনি বলেন, “কোটা আন্দোলনের কমপ্লিট শাটডাউন ও কারফিউ জারির কারণে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ব্যবসায়ীরা আমদানি পণ্য খালাস করতে পারেননি। এখন সেই কারণে বন্দর কর্তৃপক্ষ মাল খালাস না করার কারণে জরিমানা দাবি করছে। এই পরিস্থিতি ব্যবসায়ীদের জন্য আর কঠিন হয়ে উঠেছে।

“এখন আমাদের নতুন সঙ্কট তৈরি হয়েছে। সেটা হচ্ছে কারফিউ জারির কারণে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষই আমাদের পণ্য খালাস করতে পারেনি। এখন যখন আমরা মাল রিলিজ করতে গেলাম পোর্ট অথরিটি আমাদের কাছে ডেমারেজ দাবি করছে।”

“দেশে কারফিউ ও সারাদেশ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় পোর্ট আমাদের মাল ডেলিভারি দিতে পারে নাই। কিন্তু এখন ডেমারেজ কেন দাবি করবেন?”

বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি বলেন, “বিষয়টি আমি মুখ্য সচিবকে জানিয়েছি। মুখ্য সচিব বন্দর কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন। এরপর আবারও বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মাল খালাসের জন্য যোগাযোগ করলে তারা জরিমান ছাড়া মাল খালাসের নির্দেশনা পাননি বলে আমাদের জানাচ্ছেন।  

“এরপর আমরা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে বিষয়টি জানানোর পর তারা বলল ফাইল তৈরি করে তা সচিব স্যারের কাছে উপস্থাপন করে অনুমোদন নিয়ে সেই মাল ছাড়া হবে বলে জানানো হয়।”

বিষয়টি ব্যবসাবান্ধব নয় বলে মনে করেন এই ব্যবসায়ী নেতা।

তিনি বলেন, “সেই ফর্মালিটিজ করতে করতে শেষে দেখা যাবে আমার সব শেষ। দেশে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরির জন্য এতো কথা বলা হয়। কিন্তু এই রকম পরিস্থিতিতে মন্ত্রণালয় স্বপ্রণোদিত হয়ে একটা আদেশ জারি করলে কী ক্ষতি হয়? আমার মাথায় ধরে না।

“বন্দর থেকে পণ্য খালাস করতে না পারায় আমরা কন্টেইনার ফিরিয়ে দিতে পারি নাই। আবার কন্টেইনার ফিরিয়ে দিতে না পারায় শুক্রবার থেকে কন্টেইনার ডেমারেজও দিতে হবে।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত