সকাল সন্ধ্যা: ২০১৮ সালে সরকারি চাকরিতে কোটাবিরোধী যে আন্দোলন হয়েছিল তারা চেয়েছিলেন কোটার সংস্কার। সে সময় ৫৬ শতাংশ কোটা ও ৪৪ শতাংশ মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ হতো। আন্দোলনকারীরা ৫৬ থেকে কোটা ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার দাবি করেছিলেন, এমনকি তারা ১৫ শতাংশ পর্যন্ত কোটা মেনে নিতে রাজি ছিলেন। কিন্তু সরকার তখন প্রথম শ্রেণিসহ উচ্চতম পদগুলোতে কোটা তুলে দিল। এই কোটা তুলে দেওয়া ঠিক হয়েছে কি না? আপনি কী মনে করেন?
মো. ফিরোজ মিয়া: কোটা তুলে দেওয়া হয়েছিল ১ম থেকে ১৩তম গ্রেডের পদগুলোতে। নিচের দিকের পদগুলোতে কোটা বহাল রাখা হয়েছিল। এইভাবে কোটা বাতিল করে দেওয়া যৌক্তিক হয়নি। প্রায় সব দেশেই সরকারি চাকরিতে কম-বেশি কোটা পদ্ধতি আছে। এই কোটা আছে অনগ্রর শ্রেণির নাগরিকদের জন্য (ব্যাকওয়ার্ড সেকশন অব সিটিজেন)।
সকাল সন্ধ্যা: স্বাধীন বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি চালু করা হলো কবে? কোটা চালুর পর কাদের জন্য কত কোটা থাকবে সেটা কখন কীভাবে সংস্কার বা পর্যালোচনা করা হয়েছিল?
মো. ফিরোজ মিয়া: বাংলাদেশে প্রথম সরকারি চাকরিতে কোটা চালু করা হয় একটা সার্কুলারের মাধ্যমে, ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭২ সনে। সেসময় ২০ শতাংশ মেধা কোটা, ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা এবং ১০ শতাংশ নির্যাতিত নারী কোটা চালুর বিধান করা হয়। বাকি ৪০ শতাংশ রাখা হয়েছিল জেলা কোটা। মনে রাখা দরকার, এটা করা হয়েছিল সংবিধান কার্যকর হওয়ার আগে। সংবিধান গৃহীত হয়েছিল ৪ নভেম্বর ১৯৭২ তারিখে। সংবিধান কার্যকর হওয়ার পর ২৯ অনুচ্ছেদে ‘সব নাগরিকের সমান অধিকার এবং অনগ্রসরদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থার’ যে নীতি রয়েছে সেটার আলোকে কোটা পদ্ধতি সংস্কার করা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সেটা আর করা হয়নি।
পরবর্তীকালে ১৯৭৬ সনে মেধা কোটা ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪০ শতাংশ করা হয়। এরপর ১৯৮৫ সনে মেধা কোটা আরও বাড়িয়ে ৪৫ শতাংশ করা হয়। এই দুই বারের কোটা সংস্কারেও মুক্তিযোদ্ধা কোটা শুরুর মতোই ৩০ শতাংশই থেকে যায়। আর ১০ শতাংশ ‘নির্যাতিত নারী কোটা’কে নাম পাল্টে ‘নারী কোটা’ করা হয় প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির জন্য। এরচেয়ে নিচের পদগুলোতে নারী কোটা রাখা হয় ১৫ শতাংশ। এরপর আবার নতুন কতগুলো কোটা যুক্ত করা হয়— উপজাতি কোটা (আদিবাসী), এতিম ও প্রতিবন্ধী কোটা, আনসার ও ভিডিপি কোটা।
একদিকে যেমন সংবিধানের আলোকে কোটা পদ্ধতির সংস্কার করা হয়নি অন্যদিকে আবার আনসার ও ভিডিপি কোটার মতো অযৌক্তিক কোটা চালু করা হলো। সংবিধানের নীতিতে বিশেষ সুবিধার কথা বলা হয়েছে অনগ্রসর নাগরিকদের জন্য। এখন আপনি আনসার ও ভিডিপিকে কোন যুক্তিতে অনগ্রসর হিসেবে বিবেচনা করবেন। আরও কিছু কোটা আছে যেসব আপনি অনগ্রসর নাগরিকদের সুবিধা হিসেবে বিবেচনা করতে পারবেন না।
সকাল সন্ধ্যা: মুক্তিযোদ্ধা কোটা কি তাহলে শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ৩০ শতাংশই রয়ে গেছে? এটা কি আর কখনও পর্যালোচনা করা হয়নি?
মো. ফিরোজ মিয়া: বাহাত্তরে মুক্তিযোদ্ধা কোটা চালু করা হয়েছিল ৩০ শতাংশ। এরপর থেকে বিগত পঞ্চাশ বছরেও মুক্তিযোদ্ধা কোটার আর পর্যালোচনা করা হয়নি। এটা ৩০ শতাংশই রয়ে গেছে। একটা পর্যায়ে এমনও হয়েছে যে, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক প্রার্থী পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন বেশ কয়েকবারই সুপারিশ করেছে কোটা সংস্কারের জন্য। বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে মুক্তিযোদ্ধা কোটা সংস্কারের বিষয়েও সুপারিশ করেছিল। কিন্তু সেটা করা যায়নি। বরং একটা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা কোটা মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান এবং তারপর মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনিদের জন্য বরাদ্দ করা হয়। এরপর তো ২০১৮ সালের আন্দোলনের পর ১ম থেকে ১৩তম গ্রেডে সব কোটাই বাতিল করে দেওয়া হয়।
সকাল সন্ধ্যা: কোটাবিরোধী আন্দোলনে সবচেয়ে বেশি সমালোচনা হচ্ছে ‘মুক্তিযোদ্ধা কোটা’ নিয়েই। অন্যদিকে, মুক্তিযোদ্ধা কোটাকে কীভাবে যৌক্তিকীকরণ করা যায় সেটা নিয়েও কথা হচ্ছে। প্রশ্ন আসছে যিনি নিজে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সরকারি চাকরির সুবিধা নিয়েছেন তার সন্তানও সেই সুবিধা পাবে কি না? বা যে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কোটায় চাকরি পেয়েছেন তার নাতিও কোটা সুবিধা পাবে কি না? বিষয়টিকে কীভাবে সমাধান করা যায় বলে মনে করেন?
মো. ফিরোজ মিয়া: আগেই বলেছি, মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাহাত্তরে সংবিধান গৃহীত হওয়ার আগেই চালু করা হয়েছিল এবং পরে এটা আর সংস্কার করা হয়নি। বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান থাকাকালে ড. সা’দত হুসাইন কোটা সংস্কারের বিষয়ে অনেক উদ্যোগ নিয়েছিলেন। আমার যতদূর মনে পড়ে এজন্য অনেক সভা-সেমিনার তিনি করেছেন। ঢাকায়, ঢাকার বাইরে বিভাগীয় পর্যায়ে, জেলা শহরে। আমি নিজেও তার সঙ্গে এমন অনেক জায়গায় উপস্থিত ছিলাম। তখন দেখেছি, প্রায় প্রতি সভাতেই কোনও একটা গ্রুপ মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে এতো বেশি উত্তেজিত হয়ে যেত যে সভা পরিচালনা করাই মুশকিল হয়ে যেত। একটা বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হতো। ফলে এটা আর সংস্কার করা যায়নি।
সকাল সন্ধ্যা: মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে একটা বড় সমালোচনা হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা। এটা বার বার প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। কোটাসুবিধা ও বয়সসুবিধা নেওয়ার জন্য অমুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়েছেন বলে বহু প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। একাধিক সাবেক সচিব মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া সনদ নিয়ে চাকরিতে ধরা পড়েছেন। আবার এমন ব্যক্তিরও মুক্তিযোদ্ধা সনদ আছে একাত্তর যার বয়স ছিল পাঁচ থেকে ছয় বছর। এর পাশাপাশি দেখা যাচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের জন্য কোটাসহ নানা সুযোগ থাকলেও শহীদ-পরিবারের সন্তানদের জন্য কোনও সুবিধা নেই। এই বিষয়গুলো কীভাবে সমাধান হতে পারে?
মো. ফিরোজ মিয়া: চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কাদেরকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য করা হবে, কোন নীতিতে এটা নির্ধারণ করা হবে এই বিষয়ে সরকার একটা সার্কুলারও জারি করেছে। সরকার নীতিমালা করেছে, নির্দেশনা জারি করেছে। সে অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধার সনদ যাচাই করা নিয়োগদাতা বা পিএসসির করার কথা না, এটা মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় করে থাকে। এখন যে প্রার্থী মুক্তিযোদ্ধা কোটা পাওয়ার আবেদন করে এমন সনদ জমা দিল নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠান তো আর তাকে নাকচ করতে পারবে না। কারণ সনদ পেয়ে গেলে আইনগতভাবে তিনি মুক্তিযোদ্ধা বিবেচিত হবেন।
আর মুক্তিযোদ্ধা কোটায় শিক্ষা বা চাকরির ক্ষেত্রে কে কতবার কীভাবে বিশেষ সুবিধা নিতে পারবেন এটা সরকারি নীতিমালার বিষয়। আর এখন বিষয়টি আদালতে বিচারাধীন ফলে আদালত এই বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত দেয় কী নির্দেশনা দেয় সেটা দেখতে হবে। এটা আদালতের ওপর নির্ভর করবে।
সকাল সন্ধ্যা: এইকোটা বাতিল করে দেওয়ার কাজটি হয়েছিল সচিব কমিটির মাধ্যমে। কোটা বাতিল করার সময় কি আমাদের ভারত-পাকিস্তান-শ্রীলংকা-নেপালের মতো প্রতিবেশী দেশগুলোতে সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা কিংবা অন্যান্য দেশের বাস্তবতার সঙ্গে কোনও তুলনামূলক বিশ্লেষণ করা হয়েছিল? বা তেমনটা করা দরকার ছিল বলে মনে করেন কি?
মো. ফিরোজ মিয়া: এই কমিটি এমন কোনও পর্যালোচনা করেছিল কি না আমার জানা নাই। তবে পর্যালোচনা দরকার ছিল। প্রতিবেশী ভারত বলেন আর যুক্তরাজ্য বা যুক্তরাষ্ট্র বলেন এমন সব উন্নত দেশেও সরকারি চাকরিতে কোটা আছে। এক্ষেত্রে বড় কথা হলো, আমাদের সংবিধানের ২৯ অনুচ্ছেদ অনুসারেই তো কোটা পর্যালোচনা করা হয় নাই। এটা করা জরুরি ছিল। ২৯ অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবেই অনগ্রসর নাগরিকদের জন্য বিশেষ বিধানের নীতি আছে। আর ১ম থেকে ১৩তম গ্রেডের সব কোটা বাতিল করাও যথাযথ হয় নাই বলে মনে করি। বরং সব কোটাগুলোকেই পর্যালোচনা করে একটা যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে আসা দরকার ছিল।
সকাল সন্ধ্যা: ২০১৮ সালে উল্লিখিত কোটাগুলো তুলে দেওয়ার পর ৩৯ তম বিসিএস থেকে এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে নারী, আদিবাসী ও প্রতিবন্ধীদের সরকারি চাকরি পাওয়ার হার আগের চেয়ে উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে। এরকম হাতে নাতে ফল পাওয়ার পরও আমরা পিছিয়ে সমাজে থাকাদের ক্ষমতায়নে নারী কোটা, আদিবাসী কোটা বা প্রতিবন্ধী কোটা পুনর্বহালে সরকারের কোনও উদ্যোগ দেখলাম না। বিষয়টিকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
মো. ফিরোজ মিয়া: সরকার কেন করল না সেটা বলা মুশকিল। সরকার এ বিষয়ে কোনও গবেষণা করেছে কি না জানি না। তবে যেটা আপনি বললেন যে সরকারি চাকরিতে অনগ্রসর নাগরিকদের নিয়োগ এই কোটা বাতিলের পর কমে গেছে, সেটা হয়তো ঠিকই। অথচ সংবিধানে তো এই অনগ্রসর নাগরিকদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার বিধান রাখা হয়েছে। কাদের জন্য কত শতাংশ রাখা হবে সেটা নিয়ে সময়োপযোগী মূল্যায়ন করা দরকার ছিল। সংবিধান অনুসারে একট যৌক্তিক পর্যায়ে এটা বিবেচনা করা উচিৎ ছিল।
সকাল সন্ধ্যা: আমরা দেখেছি দীর্ঘদিন ধরে সরকারি চাকরিতে ‘জেলা কোটা’ ছিল পিছিয়ে পড়া এলাকার মানুষদের সরকারি চাকরিতে সুযোগ দেওয়ার জন্য। এই ধরনের ব্যবস্থা আসলে কীভাবে কাজ করে? প্রতিবছর বা কয়েক বছর পর পর যদি এই ধরনের কোটার পুনর্মূল্যায়ন করা না হয় তাহলে কি সেটা বাস্তবসম্মত থাকে?
মো. ফিরোজ মিয়া: আসলে কোটা ব্যবস্থা একটা সাময়িক বিষয়। কোটা চালুর উদ্দেশ্য অনগ্রসরদের এগিয়ে নিয়ে আসা। আর্থসামাজিক অবস্থার মতোই বিভিন্ন শ্রেণি-গোষ্ঠীর নাগরিকদেরও অবস্থার পরিবর্তন হয়। একসময় যারা পিছিয়ে ছিল তারা হয়তো এগিয়ে যায়। তাই কোটা কখনও চিরদিনের কোনও বিষয় হতে পারে না। কোটা ব্যবস্থা অবশ্যই একটা নির্দিষ্ট সময় পর পর পুনর্বিবেচনা করতে হয়। সব দেশেই এটা পুনর্বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশে স্বাধীনতা উত্তরকালে বিভিন্ন অঞ্চলের যে বাস্তবতা ছিল এখন তো আর সেটা সেরকম নাই। অনেক কিছুই বদলে গেছে। কোটার সংস্কার একটা চলমান প্রক্রিয়া। কোটা সংস্কারের জন্য বাস্তবসম্মত গবেষণা করা দরকার। সে অনুযায়ী এটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা দরকার।
সকাল সন্ধ্যা: কোটা ব্যবস্থার পাশাপাশি আমরা সরকারি নানা নিয়োগ এমনকি পদোন্নতির ক্ষেত্রেও নানা কোটা দেখছি। রাষ্ট্রপতির সুপারিশে সচিব নিয়োগ বা পদোন্নতি হয়ে থাকে। আবার সরকারি চাকরিতেও পোষ্য কোটা থাকে। এছাড়া দেখা যায়, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন বাহিনী থেকে ডেপুটেশনে নিয়োগ হয়ে থাকে। এর পাশাপাশি আছে ক্যাডার সার্ভিসের বাইরে বিভিন্ন পর্যায়ে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ ও পরামর্শক নিয়োগের ব্যবস্থা। এসব ব্যবস্থা কতটা যৌক্তিক বলে মনে করেন?
মো. ফিরোজ মিয়া: পোষ্য কোটার যে কথা বললেন সেটা প্রযোজ্য হয় নিম্নশ্রেণির পদগুলোতে যেখানে মেধার প্রয়োজনীয়তা অতটা থাকে না। সেখানে কায়িক শ্রম দরকার হয়। অনেক দেশেই কিছু কিছু সার্ভিসে এমন পোষ্য কোটা আছে। আমাদের দেশেও রেলওয়ে, প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ ইত্যাদি ক্ষেত্রে এটা দেখা যায়। আর ৯ম এবং তারচেয়ে ওপরের পদগুলোতে যেখানে মেধার প্রয়োজন সেখানে মেধাভিত্তিক নিয়োগের কোনও বিকল্প নাই। সেখানে মেধাভিত্তিক নিয়োগ না হলে জাতির জন্য সেটা ভালো না।
আর আপনি রাষ্ট্রপতির সুপারিশের যে কথা বললেন কিংবা বিভিন্ন বাহিনী থেকে নিয়োগের যে কথা বললেন, এসব একটা পর্যায় পর্যন্ত থাকতে পারে। অনেক সময় জনস্বার্থে আপনি কোনও একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তিকে বিশেষ ব্যবস্থায় নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে তার অভিজ্ঞতা-দক্ষতাকে কাজে লাগানোর জন্য। রাষ্ট্রপতি এমন নির্দেশনা দিতেই পারেন। কিন্তু বাংলাদেশে এসব যে পরিমাণে হচ্ছে সেই হার আসলেই অনেক বেশি। এ কারণে এমন বিশেষ নিয়োগ বা পদোন্নতির সুফলের চেয়ে কুফলই বেশি।
সকাল সন্ধ্যা: কোটা নিয়ে বিতর্কের বাইরেও সিভিল সার্ভিসে নিয়োগের যোগ্যতম প্রার্থী বাছাইয়ের প্রক্রিয়া নিয়েও আলোচনা-সমালোচনা আছে। আরেকটা বড় সমস্যা হচ্ছে প্রশ্নফাঁস। শিক্ষাক্ষেত্রে যেমন প্রশ্নফাঁস হচ্ছে তেমনি বিসিএস-এর পরীক্ষাতেও প্রশ্নফাঁস হচ্ছে। অনেকে বলছেন বর্তমান পরীক্ষা ও নিয়োগ পদ্ধতি যথাযথ নয়। এখন গাইড বই মুখস্ত করে বিসিএস-এ ভালো ফল করা যাচ্ছে। আপনার কী মনে হয় প্রার্থী বাছাইয়ের পদ্ধতি কতটা যুগোপযোগী?
মো. ফিরোজ মিয়া: এটা ঠিক যে আমাদের প্রার্থী বাছাইয়ের প্রক্রিয়া অতটা আধুনিক নয়। আমরা এখনও পুরনো ধাঁচেই চলতেছি। এতে সবক্ষেত্রে যে যোগ্যতম প্রার্থী বাছাই হয় সেটা বলা যাবে না। প্রার্থীরা তো ভিন্ন ভিন্ন সাবজেক্টে পড়ালেখার ডিগ্রি নিয়ে এসব পরীক্ষায় আসে। ধরুন শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলা, ইংরেজি বা সমাজবিজ্ঞান, দর্শনের ছেলে মেয়েরা যে পরিমাণ নম্বর পাবে বিজ্ঞান বা পরিসংখ্যান বা ব্যবসায় অনুষদের ছেলে মেয়েরা হয়তো তার চেয়ে বেশি নম্বর পেতে পারে। কিন্তু প্রার্থী বাছাই তো নম্বরের ভিত্তিতে করা হয়। তাই এই প্রক্রিয়া কতটা যৌক্তিক সেটা ভাববার অবকাশ আছে। ফলে লিখিত পরীক্ষা আর নম্বরভিত্তিক এই প্রক্রিয়াকে ত্রুটিমুক্ত বলা যাবে না।
এক্ষেত্রে বিভিন্ন বিশেষ ক্যাডার সার্ভিসের জন্য বিষয়ভিত্তিক পরীক্ষা-পদ্ধতিতে আরও জোর দেওয়া যেতে পারে। এছাড়া জেনারেল সার্ভিসের প্রার্থীদের জন্য এমন বিষয়গুলো রাখতে হবে যা সবারই জানা প্রয়োজন। আর সামগ্রিকভাবে প্রার্থী বাছাইয়ের প্রক্রিয়া কীভাবে আরও যুগোপযোগী ও যথাযথ করা যায় সেটা নিয়ে আসলেই বিশদ গবেষণা করা উচিৎ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের।
সকাল সন্ধ্যা: কোটা নিয়ে এতো কথার পেছনে একটা বড় কারণ সম্ভবত দেশে এখন সরকারি চাকরিই সবচেয়ে নিরাপদ ও আকর্ষণীয়। বেসরকারি খাতের অনগ্রসরতাও হয়তো আরেকটি কারণ। অন্যদিকে রয়েছে দেশের বিপুলসংখ্যক কর্মক্ষম শিক্ষিত শ্রমশক্তির বেকারত্ব। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিবেদন বলছে, চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে দেশে বেকারের সংখ্যা ২৫ লাখ ৯০ হাজার। বেকারত্ব ও কর্মসংস্থানের এই পরিস্থিতিকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
মো. ফিরোজ মিয়া: এক্ষেত্রে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে আরও ভাবা দরকার বলে মনে হয়। কারণ শিক্ষিত হয়ে তরুণ তরুণীরা সবাই-ই যে চাকরির পেছনে ছুটবে এটাও তো কাম্য না। কারিগরী শিক্ষাসহ আরও নানা কর্মমুখী শিক্ষার ওপরও জোর দেওয়া দরকার। তরুণ-তরুণীরা নানা বিষয়ের উদ্যোক্তা হতে পারে, ব্যবসায় নিয়োজিত হতে পারে, সৃজনশীল নানা কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে পারে। অবশ্য এটা আসলে কেবল শিক্ষাই না আরও কিছু সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপরও নির্ভর করে। কিন্তু আমরা বেশি বেশি করে উচ্চশিক্ষিত বেকার তৈরি করছি। এতে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে বিশাল হতাশা তৈরি হয়, তারুণ্যের এই হতাশা জাতির জন্য ভালো না। এছাড়া সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে আরও বেশি পরিমাণ কর্মসংস্থান তৈরির জন্য যথাযথ পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ তো অবশ্যই দরকার।
সকাল সন্ধ্যা: আমরা প্রায়ই ‘গুড গভর্নেন্স’ বা ‘সুশাসন’-এর কথা শুনি। এটা কি শুধু জনপ্রশাসনের দক্ষতার ওপর নির্ভর করে না কি এটা সরকার পরিচালনাকারী রাজনৈতিক নেতৃত্বের সদিচ্ছা এবং আমলাতন্ত্রের দক্ষতার একটা মিলিত প্রয়াসে কাজ করে? আমাদের দেশের বাস্তবতা কেমন?
মো. ফিরোজ মিয়া: আমাদের দেশের বাস্তবতা তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি। এখানে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সদিচ্ছার অভাব যেমন আছে তেমনি আমলাদের, আমলা মানে জনপ্রশাসনের দক্ষতা ও আন্তরিকতা দুটোরই অভাব আছে। সবচেয়ে বড় প্রশ্নটা হলো সততা নিয়ে। সেটা রাজনৈতিক নেতৃত্বেরই হোক আর আমলাদেরই হোক। তবে, একটা কথা স্পষ্টভাবেই বলতে চাই, জনপ্রশাসনে দক্ষ ও সৎ কর্মকর্তার অভাব আছে এটা আমি স্বীকার করি না। আমার অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি। কিন্তু মুশকিলটা হলো, দক্ষ ও সৎ কর্মকর্তাদের যথাযথ জায়গায় পদায়ন করা হচ্ছে না। এটা রাজনৈতিক সদিচ্ছারও প্রশ্ন। কারণ উচ্চতর পদগুলোতে যদি যাচাই-বাছাই করে সৎ ও দক্ষদের পদায়ন করা হয় তাহলে জনপ্রশাসনের চেহারাই পাল্টে যাবে। অথচ আমাদের এখানে উল্টোটাই হতে দেখা যায়।
সকাল সন্ধ্যা: আপনি সততার কথা বললেন। আমরা সরকারি চাকরিতে ‘শুদ্ধাচার পুরষ্কার’-এর প্রচলন হতে দেখেছি। আবার সম্প্রতি দেখা গেল এমন ‘শুদ্ধাচার পুরষ্কারপ্রাপ্ত’ কর্মকর্তাদের নাম শীর্ষদুর্নীতিবাজদের তালিকায় চলে আসছে এবং তাদের বিরুদ্ধে সম্পদ বাজেয়াপ্ত করাসহ নানা মামলার প্রক্রিয়াও চলছে। এটাকে কী বলবেন?
মো. ফিরোজ মিয়া: আমাদের যে সরকারি চাকরি আইন আছে সেটাও ত্রুটিপূর্ণ, আমাদের শৃঙ্খলবিধি যেটা আছে সেটাও ত্রুটিপূর্ণ, যে আচরণবিধি আছে সেটাও ত্রুটিপূর্ণ। এছাড়া সরকারি চাকরিতে থেকে দুর্নীতির বিষয়ে যেসব আইন আছে সেগুলোও অত্যন্ত শিথিল এবং অত্যন্ত সেকেলে। এমনকি প্রতিবেশী দেশ ভারতের চেয়েও অনেক শিথিল আমাদের এই আইনগুলো। এরপরও বড় কথা হলো, এসব আইন-বিধি যতটুকুই আছে সেসবেরও কোনও বাস্তবায়ন নাই। আইনের যদি নিরপেক্ষ ও কঠোর প্রয়োগ না থাকে তাহলে তো ভালো কিছু আশা করা যায়না। আইন-বিধির নিরপেক্ষ প্রয়োগ হলে যাদের কথা বলছেন তাদের তো ‘শুদ্ধাচার’ পুরষ্কার পাওয়ার কথা না। উল্টো তাদের শাস্তি হওয়ার কথা। ফলে ‘সুশাসন’ বলেন আর ‘শুদ্ধাচার’ বলেন এসব আমরা পাচ্ছি না এসব কারণেই।
সকাল সন্ধ্যা: আমরা জনপ্রশাসন সংস্কারের কথাও শুনি। কিন্তু বিগত কয়েক দশকে জনপ্রশাসন সংস্কার নিয়ে সত্যিকারের কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে কি? কোনও সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়েছে কি? এক্ষেত্রে কী করণীয় বলে আপনি মনে করেন বা আপনি কী ধরনের প্রশাসনিক সংস্কার চান?
মো. ফিরোজ মিয়া: অনেক আগে, বেশ অতীতে আমাদের দেশে প্রশাসনিক সংস্কার নিয়ে কিছু কমিটি আর কমিশন হয়েছিল। তারা বেশ কিছু সুপারিশ দিয়েছিল। সেসব সুপারিশের প্রতিবেদন হয়তো এখন কোনও লাইব্রেরিতে উইপোকায় খাচ্ছে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে আমরা এমন কোনও কমিশন বা প্রশাসনিক সংস্কারের কোনও উদ্যোগ দেখি নাই। হয়তো ছোটখাট কিছু কিছু বিষয়ে কিছু সংস্কার হয়েছে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে প্রশাসনিক সংস্কারের কোনও উদ্যোগ নাই।
আমি মনে করি, জনপ্রশাসনের আইনি কাঠামো ও সাংগঠিনক বা জনবল কাঠামো দুটোরই যুগোপযোগী সংস্কার প্রয়োজন আছে। এখনও সরকারি কিছু কিছু অফিসে এমন কিছু পদ পাবেন যা এই যুগে অবান্তর। ওই পদের দায়িত্ব বা কাজের প্রযুক্তি, যন্ত্রপাতি সবই পরিবর্তন হয়ে গেলেও ওই পদগুলো এখনও রয়ে গেছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে যেখানে দরকার নাই সেখানে বেশি পদ আছে, যাকে বলে মাথাভারী প্রশাসন সেটা আছে, কিন্তু যেখানে দরকার সেখানে প্রয়োজনীয় জনবল নাই। আমি মনে করি, আইনি কাঠামো ও জনবল কাঠামোর সংস্কার ছাড়া জনপ্রশাসনে গতি আসবে না।
সকাল সন্ধ্যা: সকাল সন্ধ্যাকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
মো. ফিরোজ মিয়া: আপনাকে এবং সকাল সন্ধ্যাকেও ধন্যবাদ।