‘‘তকারে জানামলেন দং দ
হিহিড়ি দং দ পিপিড়ি রে,
চৗর কন ধৗরতি পাঁচ কন পৃথিমি বৗইগৗন নাতরে
গৗইয়ে গহালরেয় জানামলেনা’’
[কোথায় জন্ম নিয়েছিল সাঁওতালদের গানের সুর দং দ?
হিহিড়ি পিপিড়ি নামের জঙ্গলদ্বীপের বৗইগৗন গ্রামে জন্মেছিল সুর।]
(দং সুরের এই গানটি সংগ্রহ ও অনুবাদ করেছেন নিরলা মার্ডী)
সাঁওতালী পুরাণ থেকে জানা যায়, ‘হিহিড়ি-পিপিড়ি’ জনপদে জন্ম নেওয়া সাঁওতালেরা খজখামান, হারাতা, সাসাংবেডা হয়ে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে এবং পরবর্তীতে ‘দামিন-ই-কোহ্’ যা সাঁওতাল পরগণা হিসেবে পরিচিতি পায় সেই এলাকায় এসে আবারও সাওঁতাল সভ্যতা গড়ে তুলে।
‘হিহিড়ি-পিপিড়ি’র আখ্যানসহ এমন বহু সাঁওতালি আখ্যান শুনিয়েছিলেন তুমুল জনপ্রিয় আদিবাসী নেতা ও বিপ্লবীকর্মী রবীন্দ্রনাথ সরেন। বলেছিলেন, আমরা পিলচু হাড়াম পিলচু বুঢ়হির বংশধর। পৃথিবীতে যখন প্রাণের উদ্ভব হয়, তখন চারধারে কেবল জল আর জল, প্রাচীন হাঁসেরা মাটির তলা থেকে কাদামাটি আবিস্কার করেছিল। সাঁওতালদের বহু গোত্রপ্রতীক নানা বৃক্ষ-পাখি-বুনো প্রাণ। প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ সুরক্ষার শপথ জন্মের পর থেকেই প্রতিটি সাঁওতাল শিশুর শুরু হয় নিজের পরিবারেই। রবীন্দ্রনাথ সরেনের পারিস বা গোত্র ‘সরেন’। নীল কৃত্তিকা নক্ষত্রপুঞ্জ এই গোত্রের প্রতীক। সরেন গোত্রকে সাঁওতাল সমাজে একইসাথে ‘যোদ্ধা’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। রবীন্দ্রনাথ সরেন আরও বলেছিলেন, আমরা ফুলমণি, সিধো, কানহু, বীরসা, শিবরাম মাঝির উত্তরাধিকার। যাদের নাম উল্লেখ করা হলো তাঁরা হুল, উলগুলান কিংবা তেভাগা সংগ্রামের নায়ক। তারা সাঁওতাল।
এই ভূমির অন্যতম আদি বাসিন্দা সাঁওতাল জাতি এখন বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম জাতিগোষ্ঠী। বাংলাদেশের সর্বশেষ ‘জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২’ অনুযায়ী দেশে আদিবাসী জনসংখ্যা দেখানো হয়েছে ১৬,৫০,১৫৯ জন এবং জাতিগোষ্ঠী ৫০টি।
শুধু সাঁওতাল নয়, দেশের সব আদিবাসীদের অধিকার ও প্রাণ-প্রকৃতির সুরক্ষার দাবি নিয়ে ফুলবাড়ি থেকে ভীমপুর, বাগদাফার্ম থেকে বগুড়া, নাচোল থেকে ভাওয়াল, চা বাগান থেকে মধুপুর, সমতল থেকে পাহাড়ে সাহস নিয়ে দাবড়ে বেড়ানো রবীন্দ্রনাথ সরেন ১২ জানুয়ারি গভীর রাতে অনন্তলোকে যাত্রা করেন। জাতিগত নিপীড়নকে বারবার প্রশ্ন করে দাঁড়ানো এক সাঁওতাল যোদ্ধা যেন মহাবিশ্বের নক্ষত্রপুঞ্জে মিশে গেলেন দুম করেই। বহু কাজ, বহু কথা, বহু দরবার অমীমাংসিত রয়ে গেল।
মেহনতি আদিবাসী নিম্নবর্গের অধিকার, পরিবেশ ও পাবলিক সম্পদ সুরক্ষায় নিবেদিতপ্রাণ রবীন্দ্রনাথ সরেনের সাথে আমার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সখ্যতা ১৯৯৮ সালের মাঝামাঝি থেকে। তিনি আমার আদিবাসী অধিকার আন্দোলনের অন্যতম শিক্ষক এবং বন্ধু। প্রান্তিকতা, অধিকার এবং আন্দোলনের ক্ষেত্রে তাঁর সামগ্রিক তৎপরতা এক গুরুত্বপূর্ণ ডিসকোর্স বিকশিত করেছে। সকল প্রাণের মৃত্যুই শূন্যতা তৈরি করে, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সরেনের অসময়ে প্রস্থান আমাদেরকে বহু জটিল প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। তাঁর চিন্তা-দর্শন ও তৎপরতার নিবিড় পাঠ এবং অনুশীলন জাগিয়ে রাখবার ভেতর দিয়ে হয়ত নতুন প্রজন্ম সকল প্রশ্নের সামনে দাঁড়াবার সাহস পাবে। দগ্ধ ও দায়িত্বশীল হবে। নানা স্মৃতি-বিস্মৃতির ভেতর থেকে চলতি আলাপখানি রবীন্দ্রনাথ সরেনের অবিস্মরণীয় চিন্তা-দর্শন ও কর্মতৎপরতাকে পাঠ করছে।
বারকোণা থেকে দশদিগন্ত
উত্তরাঞ্চলের বহু স্থাননাম সাঁওতালি ভাষার। বীরটোলা, বিরল, বীরগঞ্জ। সাঁওতালি ভাষায় ‘বীর’ মানে জংগল। দিনাজপুরের পার্বতীপুরের বারকোণা গ্রামটিও ছিল জঙ্গলময়। আশেপাশে সব ছিল আদিবাসী বসতি। বারকোণা গ্রামে ১৯৫৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর জন্ম নেন রবীন্দ্রনাথ সরেন। মা সুমি টুডু ও পিতা দারকাল সরেন। চার ভাইবোনের ভেতর রবীন্দ্রনাথ সবার ছোট। সবার বড় বোন নীলমনি সরেন, বড় ভাই সুন্দর সরেন ও মেজ ভাই বুধরায় সরেন। ভর্তি হন বারকোণা বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। পার্বতীপুর হাবড়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিক পাশ করেন। দিনাজপুর সঙ্গীত কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক। রাজশাহী শাহ মখদুম কলেজ থেকে ডিগ্রি পাশ করার পর রাজশাহী ল’ কলেজে আইনে ভর্তি হন। কিশোর বয়স থেকেই রবীন্দ্রনাথ আদিবাসী গ্রাম পর্যবেক্ষণ শুরু করেন। ছাত্রজীবনে বামপন্থী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। তরুণ বয়সে একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ নিয়ে খুঁজে বেড়ান নাচোলের তেভাগাকর্মীদের।
১৯৯২ সালে তাঁর পরিচয় ঘটে অনিল মারান্ডীর সাথে এবং ১৯৯৩ সালে গড়ে তুলেন জাতীয় আদিবাসী পরিষদ। উত্তরাঞ্চল থেকে দক্ষিণাঞ্চল, চা বাগান এবং ঢাকাতেও সম্প্রসারিত হতে থাকে সাংগঠনিক তৎপরতা। আদিবাসী পরিষদের ৯ দফা দাবি প্রণয়েন তাঁর ভূমিকা অনন্য। দিনাজপুর-৬ আসন থেকে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দেন। কেবল ‘জাতীয় আদিবাসী পরিষদ’-ই নয়, তাঁর অনুপ্রেরণা এবং তৎপরতায় ২০০৩ সালে ‘আদিবাসী সাংস্কৃতিক পরিষদ’, ২০০৮ সালে ‘আদিবাসী ছাত্র পরিষদ’, ২০১১ সালে ‘আদিবাসী যুব পরিষদ’ এবং ২০১২ সালে গঠিত হয় ‘আদিবাসী নারী পরিষদ’। ‘বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম’, জনপ্রিয় ব্যান্ড গানের দল ‘মাদল’সহ বহু স্থানীয় ও জাতীয় সংগঠন গড়ে তুলতে তিনি সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি, কাপেং ফাউন্ডেশনের চেয়ারপার্সন, ‘খাদ্য অধিকার বাংলাদেশ’ জাতীয় কমিটির সদস্য হিসেবে আমৃত্যু দায়িত্ব পালন করেছেন। জাতিসংঘে আদিবাসী স্থায়ী ফোরামে যোগদানের মাধ্যমে বৈশ্বিক আদিবাসী আন্দোলনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।
ভূমি কমিশন গঠনের স্বপ্ন
‘‘ধীরে ধীরে বসতভিটা, গাছপালা সবই শেষ হয়ে গেল
আমি এখন নিজ দেশে পরবাসীর মতো।
ওরা এখন আমাকে বলছে
যেখানে ইচ্ছা সেখানে চলে যেতে পারো তুমি’’
(বরেন্দ্র ভূমিতেই জন্ম নিয়েছি আমি চুনু মাঝি, রবীন্দ্রনাথ সরেন, ২০০৮)
সমতল অঞ্চলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক স্বতন্ত্র ভূমি কমিশন গঠনের দাবি ও আন্দোলনকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন রবীন্দ্রনাথ। বহু রাজনৈতিক দল নির্বাচনী ইশতেহারেও এই দাবিকে অঙ্গীকার হিসেবে গ্রহণ করেছে। ২০০০ সনের ১৮ আগস্ট নওগাঁর ভীমপুরে ভূমি রক্ষা করতে গিয়ে খুন হন আলফ্রেড সরেন। রবীন্দ্রনাথ সরেন ‘আলফ্রেড সরেনের ভূমি আন্দোলনকে’ দেশব্যাপী পরিচিত করে তুলতে ভূমিকা রেখেছেন। তারই সহযোগিতায় এ ঘটনা নিয়ে আরণ্যক নাট্যদল ‘রাঢ়াঙ’ নাটক তৈরি করে। তাঁরই সক্রিয়তায় গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম ভূমি রক্ষা আন্দোলন শুরু হয় ২০১৬ এর দিকে। ১৯৬২ সনে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার ৫নং সাপমারা ইউনিয়নের রামপুর, সাপমারা, মাদারপুর, নরেঙ্গাবাদ ও চকরহিমাপুর মৌজার ১৮৪২.৩০ একর ভূমি ‘রংপুর (মহিমাগঞ্জ) সুগার মিলের’ জন্য অধিগ্রহণের নামে কেড়ে নিয়েছিল তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান সরকার। ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালালে নিহত হন শ্যামল হেমব্রম, মঙ্গল মার্ডী ও রমেশ টুডু। ফুলবাড়ি উন্মুক্ত কয়লাখনির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রথম রুখে দাঁড়ান রবীন্দ্রনাথ স্থানীয় আদিবাসী ও গ্রামের বাঙালিদের নিয়ে । পরবর্তীতে এটি জাতীয় সংগ্রামে রূপ নেয়। ২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট ফুলবাড়িতে এশিয়া এনার্জি কোম্পানির অফিস ঘেরাও কর্মসূচিতে সহস্র জনতাকে সংগঠিত করার নেতৃত্ব দেন। ‘ফুলবাড়ি’, ‘আলফ্রেড সরেন’ ও ‘বাগদাফার্ম’ রবীন্দ্রনাথ সরেনের তিনটি উল্লেখযোগ্য পাবলিক আন্দোলন।
থামতে দেখিনি কখনও
মাত্র ৬৭ বছরের জীবনে তাঁকে থামতে দেখেনি কেউ। রাতবিরেতে, দিনেদুপুরে, শীত-বর্ষা, গ্রাম কী শহরে। তিনি ছুটে গেছেন রক্তপাত কী আগুনের ভেতর। দাঁড়িয়েছেন বন্দুক কী বাহাদুরির সামনে। সৃজনশীল ও উপযোগীসব কর্মসূচি গ্রহণে তিনি দক্ষ ছিলেন। প্রচারপত্র, পোস্টার, চিঠি, স্মারকলিপি কিংবা অবস্থানপত্র তৈরিতে খুব সচেতন ছিলেন। বিশেষ করে বানান, আলোকচিত্র ব্যবহার ও শব্দচয়নের ক্ষেত্রে।
১৯৯৬ সালে তেভাগা আন্দোলনের সুবর্ণজয়ন্তীতে নাচোলে ইলা মিত্রের উপস্থিতিতে লক্ষাধিক মানুষের সমাবেশ আয়োজনে রবীন্দ্রনাথ সরেনের ভূমিকা অনন্য। আদিবাসী পরিষদের ৯ দফা দবি বাস্তবায়নের জন্য উত্তরাঞ্চলের ১০ হাজার আদিবাসী নারী-পুরুষকে নিয়ে ঢাকায় বিশাল গণসমাবেশ করেন ১৯৯৮ সালের ৮ ডিসেম্বর। ২০০৯ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-রাজশাহীতে ভূমিরক্ষায় আয়োজন করেন দীর্ঘ গণপদযাত্রা। আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবিতে এক লাখ গণস্বাক্ষর নিয়ে ২০১০ সালের ১০ ডিসেম্বর মানববন্ধন করেন জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে। দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা মুন্ডাদের একত্র করতে ২০১১ সালে তাঁর উৎসাহে সবিন চন্দ্র মুন্ডা ও নরেন পাহান শুরু করেন ‘জাতীয় মুন্ডা সম্মেলন-২০১১’। একই সালের ৩০ জুন সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবিতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে সংসদ অভিমুখে মিছিল সংগঠিত হয় তার নেতৃত্বে। ২০১৪ সালে নওগাঁতে সংগঠিত যৌন সহিংসতার বিরুদ্ধে বিচিত্রা তির্কীর সাথে জোরালো আন্দোলন গড়ে তুলেন। ভূমি অধিকারের দাবিতে ২০২২ সালে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে বিশাল সব গণকর্মসূচি আয়োজন করেন।
নানা সময়ে ভীষণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লেও তিনি কাউকে বুঝতে দেননি। চিকিৎসার নামে দিনাজপুরে তাঁর পায়ের তিনটি আঙুলে কেটে ফেলে ডাক্তার। অসুস্থ অবস্থায় রাজনীতিবিদ পংকজ ভট্টাচার্যের পরামর্শে তাঁকে ঢাকায় এনে চিকিৎসা করা হয়। কিছুটা সুস্থ হয়ে আবার সক্রিয় হয়ে ওঠেন। দারুণ ক্ষিপ্র ও চৌকস ভাষণ ও আলাপে জাগিয়ে রাখেন আদিবাসী আন্দোলনের ময়দান। কিন্তু কী নিদারুণ! আবার হঠাৎ অসুস্থ হয়ে বেশ কিছুদিন দিনাজপুরে লাইফসাপোর্টে থেকে বাড়ি ফিরে গিয়ে হঠাৎ করেই এক তীব্র শীতের রাতে সব শেষ।
নিঞাঃ কড়ামরে দ চৗরটি পাটাঃকান
(যন্ত্রণায় আমার বুক চুরমার হয়ে যাচ্ছে)
‘‘নিত মেনাঃ দাড়ে মেনাঃ
নওয়া দাড়ে দ বাং তাঁহেঁ না,
সেরমা রে সিঞ চান্দ কর্মচৗরি বাবা মেনায়
নওয়া দাড়ে দ বাং তাঁহেঁ না
[ আজকে শরীরের শক্তি আছে, এই শক্তি সারাজীবন থাকবে না। আকাশে দিনের বেলা সূর্য আছে, এই শক্তি সবসময় থাকবে না।]
(দং সুরের এই গানটি সংগ্রহ ও অনুবাদ করেছেন নিরলা মার্ডী)
রবীন্দ্রনাথ সরেনের সাথে আমার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ঘনিষ্ঠতা দৃঢ় ও দীর্ঘ। সংগঠন কী পরিবারে আমরা আমাদের গল্প ও সিদ্ধান্তগুলো ভাগাভাগি করতাম। আদিবাসী পরিষদের পোস্টার কি চিঠি দেখে দেইনি বা রবীন্দ্রনাথ সরেন আমার কোনও লেখা পড়েননি এমন খুব কম ঘটেছে। কিন্তু কী দুঃসহ, এই লেখাটি তিনি পড়তে পারবেন না। সাঁওতালি ভাষায় চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, ‘‘নিঞাঃ কড়ামরে দ চৗরটি পাটাঃকান’’ (যন্ত্রণায় আমার বুক চুরমার হয়ে যাচ্ছে)।
রাজশাহীতে সাঁওতালি ভাষার স্কুল প্রতিষ্ঠা করে আদিবাসী মাতৃভাষায় শিক্ষার দাবিকে তিনি সামনে এনেছিলেন। নওগাঁয় ওঁরাওদের ‘কারাম পরব’ ও দিনাজপুরে সাঁওতালদের ‘বাহা পরব’ জাতীয়ভাবে আয়োজনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। তিনি কোনও আয়রোজগার করতেন না, মানুষের সহযোগিতা এবং গণ চাঁদার মাধ্যমেই কাজ করতেন। কীভাবে যে বিশাল সব আয়োজন সফল করেছেন হাতে একটি পয়সা ছাড়া সেসব এখনো বিস্ময় জাগায়। আদিবাসী শিশুদের শিক্ষা এবং তরুণদের উচ্চশিক্ষা নিশ্চিতকরণে জোরালো ভূমিকা রেখেছেন।
এতসব কর্মতৎপরতার ভেতর পরিবারেও সময় দেওয়ার চেষ্টা করেছেন রবীন্দ্রনাথ। কন্যা ভারত এবং পুত্র বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেছেন। তিনি সবসময় কৃতজ্ঞ ছিলেন তাঁর স্ত্রী সংস্কৃতিকর্মী ও নেতা বাসন্তী মুর্মুর প্রতি। কারণ কৃষিকাজের মাধ্যমে সংসারের যাবতীয় ব্যয় ও ব্যবস্থাপনা সামলেছেন বাসন্তী। পুরো পরিবারই সক্রিয়ভাবে জড়িত হন অধিকার আদায়ের সংগ্রামে, বাংলাদেশে এমন উদাহরণ বিরল। বিরলকে দৃষ্টান্তে আর অসাধ্যকে সাধ্য করবার প্রমাণ হিসেবে হাজির করবার যে দীক্ষা রবীন্দ্রনাথ সরেন জাগিয়ে রেখে গেছেন, বিশ্বাস করি তা নিরন্তর বিকশিত হতে থাকবে।
লেখক: প্রাণ ও প্রতিবেশ বিষয়ক গবেষক ও লেখক।
ই-মেইল: animistbangla@gmail.com