Beta
বৃহস্পতিবার, ৯ মে, ২০২৪
Beta
বৃহস্পতিবার, ৯ মে, ২০২৪

গণমাধ্যম এখন

রেডিও কি বিদায় নিল

মীর মাসরুর জামান। প্রতিকৃতি অঙ্কন: সব্যসাচী মজুমদার

‘‘ রেডিও হচ্ছে স্লিপিং জায়ান্ট বা ঘুমন্ত দৈত্য। এর অনেক ক্ষমতা। এটাকে জাগিয়ে তুলে ঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে যোগাযোগে বিপ্লব ঘটে যাবে।’’

নয়ের দশকের শেষদিকে এমন কথা বলেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতার অধ্যাপক ড. সাখাওয়াত আলী খান। দেশে যখন রাষ্ট্রীয় বেতার ছাড়া আর কোনও রেডিও স্টেশন নেই তেমন সময় এ কথা বলার যথেষ্ট যুক্তি ছিল। কেননা রেডিওর ক্ষমতার কথা তো সবার জানা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গোড়া থেকেই জড়িয়ে আছে রেডিওর নাম। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। এই বেতার কেন্দ্রের শিল্পী-কলাকুশলীদের শব্দসৈনিক বলে ইতিহাস। রণাঙ্গনের সৈনিকদের পাশাপাশি তারাও একেকজন মুক্তিযোদ্ধা। আকাশবাণী কলকাতা কিংবা বিবিসি’র ভূমিকাও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ। এদেশে নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় অনেক বাড়ি কিংবা দোকানপাটের সামনে মানুষের ভিড় লাগত বিবিসি-ভয়েস অব আমেরিকার খবর শোনার জন্য।

সংবাদপত্র যখন শুধু সাক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ, টেলিভিশন সেটের মালিকানার জন্য যখন আর্থিক সঙ্গতির পাশাপাশি বিদ্যুৎসুবিধা অপরিহার্য তখন অক্ষরজ্ঞানহীন ও সীমিত সামর্থের মানুষের জন্য সহজলভ্য এবং খুব সহজে ব্যবহার করার মতো গণমাধ্যম হিসেবে রেডিও তো অতুলনীয়! বিশ্বজুড়েই দুর্যোককালীন সতর্কতা জারি, জরুরি সংবাদ সম্প্রচার ও উন্নয়ন যোগাযোগ এমনকি বিনোদনের জন্য রেডিওর সফলতা প্রবাদতুল্য। ঘড়ির সময় মেলানো থেকে শুরু করে মানুষ দিনের কার্যসূচি এমনকি চলাচলের পথ ঠিক করত রেডিও শুনে। এদেশে রেডিও ছিল পারিবারিক সামাজিক বন্ধনেরও সূত্র। এক পরিবারের সবাই এমনকি কয়েক পরিবারের মানুষ মিলে তখন একসাথে রেডিও শুনত। রেডিওর গানের অনুষ্ঠান, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান, নাটক, শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান, কৃষি অনুষ্ঠান, নাটক— সবই জনপ্রিয় ছিল।

বাংলাদেশ বেতার থেকে শুরু করে কমিউনিটি রেডিও পর্যন্ত সবাই এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে টার্গেট করে অনুষ্ঠান নির্মাণ এবং সম্প্রচারে জোর দিয়েছে।

কিন্তু সংবাদ নিয়ে মানুষ সন্তুষ্ট ছিল না। রাষ্ট্র পরিচালিত হওয়ায় তা ছিল একপেশে এবং মূলত শাসকদের গুণগাননির্ভর। বিশেষ করে সামরিক শাসন এবং সেনাসমর্থিত স্বৈরাচারী সরকারের সময় দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির বাস্তব চিত্র সেখানে উঠে আসত না। দিনের পর দিন সরকারি প্রেসনোটের ভাষ্য প্রচার করে তা মানুষের আস্থা পুরোপুরি হারিয়ে ফেলে। মানুষ তখন সংবাদপত্রের ওপর নির্ভর করতে শুরু করে। আর রেডিও হিসেবে বিবিসি এবং ভয়েস অব আমেরিকার সংবাদের জন্য অপেক্ষা করে থাকে। দেশের রেডিওর জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়তে থাকে। পাশাপাশি বিনোদনমাধ্যম হিসেবে টেলিভিশন সহজলভ্য হতে থাকে। শব্দের সাথে ছবি দেখার সুযোগের কারণে স্বভাবতই এই মাধ্যম অনেক বেশি দাপট দেখাতে থাকে। অনেক বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে টেলিভিশনের ধারাবাহিক নাটক, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান, সিনেমার গানের অনুষ্ঠান। এরপরও সংবাদের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করে মানুষের আস্থা ফিরিয়ে বাংলাদেশে রেডিওর পূর্ণ ক্ষমতার বিকাশের জন্য এর স্বায়ত্বশাসনের দাবি জানাতেন রাজনীতিবিদ-বুদ্ধিজীবী-সামাজিক-সাংস্কৃতিককর্মীরা। নব্বইয়ে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতনের সময় যে তিনজোটের রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়েছিল তাতেও গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করা হয়েছিল বেতার-টেলিভিশনের স্বায়ত্বশাসনের কথা।

দাপুটে রেডিওর প্রথম দফা পতন:

নয়ের দশকের শুরুতে ক্যাবল টেলিভিশন নেটওয়ার্ক চালু হওয়ার সুবাদে ডিশ অ্যান্টেনা ব্যবহার করে দেশের বাইরের, বিশেষ করে ভারতের চ্যানেলগুলো দেখতে শুরু করে মানুষ। সেই রঙিন চটকদার ঝলমলে বিনোদন মাধ্যমের পাশে রেডিও ম্লান-মলিন-ম্রিয়মান হয়ে পড়ে। বেতার-টেলিভিশনের স্বায়ত্বশাসনের দাবিও শেষ পর্যন্ত আর বাস্তবায়ন হয়নি। এর মাঝে, নয়ের দশকের শুরুতে বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার অধ্যাদেশের মাধ্যমে বিশেষ ক্ষমতা আইনের কিছু ধারা বাতিল করে দিয়ে সংবাদপত্র প্রকাশের সুযোগ উন্মুক্ত করে দেয়। মানুষের মাঝে সংবাদপত্রেরও দাপট বেড়ে যায়। রেডিও চলে যায় মনোযোগের আড়ালে।

আরেকবার জেগে ওঠা:

নতুন শতকে আওয়ামী লীগ সরকার প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর বেসরকারি মালিকানায় রেডিও সম্প্রচারের অনুমতি দিলে রেডিও আরেক দফা প্রাণ ফিরে পায়। ২০০৬ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ২৪ ঘণ্টা সম্প্রচার শুরু করে দেশের সর্বপ্রথম ব্যক্তিমালিকানাধনি রেডিও— রেডিও টুডে। শুরু হলো বাংলাদেশের রেডিওর ইতিহাসে নতুন অধ্যায়। তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এফএম রেডিও। বাড়িতে শোনার রেডিও হয়ে ওঠে গাড়িতে, দোকানে, মোবাইল ফোনে শোনার বস্তু। এফএম রেডিওর গান, অনুষ্ঠান, সংবাদ— সব শুনতে থাকে মানুষ। রেডিওর বিশাল শ্রোতাগোষ্ঠী গড়ে ওঠে তরুণ সমাজের মধ্যে। জন্ম হয় রেডিও জকি বা ‘আর জে’ হিসেবে পরিচিত একঝাঁক নতুন তারকার। পাশাপাশি চালু হয় কমিউনিটি রেডিও। বেসরকারি সংস্থাগুলোর পরিচালনায় স্থানীয় পর্যায়ে কমিউনিটি রেডিও তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের মুখপাত্র হয়ে ওঠে। বেসরকারি টেলিভিশনের বিস্তারের মধ্যেও চলতে থাকে রেডিওর এক নতুন জয়যাত্রা।  

যে বেতার ১৯৩৯ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পুরান ঢাকা থেকে সম্প্রচার শুরু করে শুধু রাষ্ট্রীয় মালিকানায় পরিচালিত হতো তা এ সময়ে বিশাল ব্যাপ্তি লাভ করে। বাংলাদেশ বেতার ঢাকাসহ বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে ১২ টির বেশি কম্পাঙ্ক ব্যবহার করে জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে কার্যক্রম চালাতে থাকে। একটি কম্পাঙ্ক ব্যবহার করে সম্প্রচার চালায় বিবিসি বাংলা। পাশাপাশি একে একে সম্প্রচার শুরু করে ৩৫ টির বেশি বেসরকারি মালিকানাধীন এফএম রেডিও। এগুলোর মধ্যে আছে— রেডিও ফুর্তি, রেডিও টুডে, রেডিও আমার, এবিসি রেডিও, পিপলস রেডিও, ঢাকা এফএম, রেডিও ভূমি, রেডিও স্বাধীন, সিটি এফএম, কালারস এফএম, রেডিও একাত্তর, রেডিও ধ্বনি, জাগো এফএম, রেডিও ক্যাপিটাল, বাংলা রেডিও, রেডিও আম্বার, স্পাইস এফএম, রেডিও দিন রাত, সুফি এফএম এবং রেডিও প্রাইম। এগুলোর মধ্যে রেডিও টুডে, এবিসি রেডিও, রেডিও আমার এবং পরে রেডিও ধ্বনিসহ কয়েকটি সংবাদ প্রচার করলেও বেশিরভাগই অনুষ্ঠান, বিশেষ করে সঙ্গীতনির্ভর অনুষ্ঠান প্রচার করতো। তবে পরবর্তী পর্যায়ে অবশ্য প্রায় সবাই সংবাদ প্রচার বন্ধ করে দেয়। শুধু রেডিও টুডে সংবাদ শিরোনাম প্রচার করতে থাকে। বাংলা রেডিও ভয়েস অব আমেরিকার সাথে একটি অনুষ্ঠান প্রচার করছে।

এফএম রেডিওগুলোর গানের পাশাপাশি রহস্যগল্প ও জীবনঘনিষ্ঠ নানা অনুষ্ঠান জনপ্রিয়তার তুঙ্গে পৌঁছে যায়। সবচেয়ে বেশি সমাদৃত রহস্যগল্পভিত্তিক অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে— ‘পোকা’, ‘ভূত’, ‘কুয়াশা’, ‘পাপ’, ‘থারসডে নাইট সাগা’ ‘ছায়া’ এবং ‘ডর’। জীবনঘনিষ্ঠ অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে বেশি জনপ্রিয় হয়— ‘যাহা বলিব, সত্য বলিব’, ‘জীবনের গল্প’, ‘লাভ গুরু’, ‘প্রেমরোগ’, ‘ইটস কমপ্লিকেটেড’ ইত্যাদি। অনুষ্ঠানে শ্রোতাদের সরাসরি অংশগ্রহণের সুযোগ শ্রোতাদের কাছে রেডিওর আকর্ষণ বাড়িয়ে দেয়। সবাই ধারণা করে, আবার রেডিওর দিন ফিরে এল।

কমিউনিটি রেডিওর নতুন তরঙ্গ:

এফএম রেডিওর পাশাপাশি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর পরিচালনায় স্থানীয় পর্যায়ে অনুমতি পায় ৩২ টি কমিউনিটি রেডিও। এগুলোর মধ্যে কার্যক্রম চালানো ১৮ টির মধ্যে রয়েছে— রেডিও সাগরগিরি, রেডিও নলতা, রেডিও ঝিনুক, রেডিও মুক্তি, রেডিও বরেন্দ্র, রেডিও পদ্মা, রেডিও মহানন্দা, রেডিও বিক্রমপুর, রেডিও সুন্দরবন, রেডিও নাফ, রেডিও সৈকত, রেডিও চিলমারি, রেডিও সাগরদ্বীপ, রেডিও পল্লীকণ্ঠ, লোক বেতার, রেডিও মেঘনা ও রেডিও বড়াল। প্রতিদিন ১৭০ ঘণ্টার বেশি অনুষ্ঠান প্রচার করে এই রেডিওগুলো। কৃষি, উন্নয়ন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিষয়ক সতর্কতাসহ জীবনঘনিষ্ঠ বিভিন্ন বিষয়ে অনুষ্ঠান প্রচার এবং এগুলোতে স্থানীয় মানুষের অংশগ্রহণের সুযোগের কারণে নির্দিষ্ট এলাকাগুলোতে কমিউনিটি রেডিও জনপ্রিয়তা পায়। সংবাদ ও সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ বিষয়ক অনুষ্ঠানও প্রচার করে কেউ কেউ। শুরুতে কমিউনিটি রেডিওর বিজ্ঞাপন প্রচারের এখতিয়ার না থাকলেও পরবর্তী সময়ে সেই সুযোগ করে দেয় সরকার। চালু হওয়ার ৯ বছর পর ২০১৭ সালে কমিউনিটি রেডিও স্থাপন, সম্প্রচার ও পরিচালনা (সংশোধিত) নীতিমালা অনুযায়ী, কমিউনিটি রেডিওগুলোকে মোট অনুষ্ঠান সময়ের ১০ শতাংশ সময়ে বিজ্ঞাপন প্রচারের অনুমতি দেওয়া হয়। তবে স্থানীয় পর্যায়ে বিজ্ঞাপন সহজলভ্য না হওয়ায় মূলত সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের অনুদান থেকে কমিউনিটি রেডিওর অর্থ যোগাড় হয়। ওই নীতিমালায় কমিউনিটি রেডিও স্টেশনের সম্প্রচারের ব্যাপ্তিও বাড়ানো হয়। বলা হয়, রেডিও স্টেশনের অবস্থানকে ঘিরে চারদিকে ২৫ কিলোমিটার পর্যন্ত সম্প্রচারের জন্য সর্বোচ্চ ২৫০ ওয়াট সম্প্রচারশক্তির ট্রান্সমিটার ব্যবহার করা যাবে। আগের নীতিমালায় চারদিকে ব্যাপ্তি ছিল ১৭ কিলোমিটার। আর ট্রান্সমিটারের শক্তি ছিল ১০০ ওয়াট। তবে ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে এই সীমানা পেরিয়ে যায় কমিউনিটি রেডিও। এছাড়া ১৮টি কমিউনিটি রেডিওর আওতায় আছে ১৬ টি জেলার ১১০ টি উপজেলার প্রায় ৬০ লাখ জনগোষ্ঠী। আর কমিউনিটি রেডিওগুলোর রয়েছে প্রায় ৫ হাজার শ্রোতা ক্লাব।

বেসরকারি মালিকানায় এফএম রেডিও এবং উন্নয়ন সংস্থাগুলোর পরিচালনায় কমিউনিটি রেডিওর এই প্রসার রেডিওর নতুন করে জেগে ওঠার ইঙ্গিত দেয়। অনেকেই আগ্রহী হয় রেডিও প্রতিষ্ঠায়। তরুণরাও খুঁজে পায় কাজের নতুন ক্ষেত্র।

আবার ধস:

এর মাঝেই অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে বাড়তে থাকে ডিজিটাল মাধ্যমের প্রসার। ২০২০-এর দিকে এসে অনেক বেড়ে যায় ডিজিটাল প্লাটফর্মে ভিডিও কনটেন্টের ছড়াছড়ি। এর আগে, ক্যাবল টেলিভিশনের দাপটে যেমন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিল, এই দফায় ইন্টারনেট আর ডিজিটাল মাধ্যমের সামনে তেমনই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে রেডিও। অডিয়েন্স রেডিওর প্রতি আগ্রহ হারায়। ফেইসবুক-ইউটিউবেই তারা বেশি ব্যস্ত থাকে। আবার শুরু হয় রেডিওর ধস। সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে এফএম রেডিওর ওপর। অডিয়েন্স হারানোয় ব্যবসা হারিয়ে আর্থিক ক্ষতির শিকার হতে থাকে এগুলো। বেশ ক’টি রেডিও স্টেশন এর মাঝে বন্ধ হয়ে যায়। এগুলো হলো— ডয়চে ভেলে বাংলা সার্ভিস, বিবিসি বাংলা, রেডিও মেট্রোওয়েভ, রেডিও এজ, রেডিও অ্যাকটিভ, রেডিও ঢোল, এশিয়ান রেডিও এবং রেডিও নেক্সট। এ পর্যায়ে এসে এফএম রেডিওগুলোর এক সময়ের তারকারা এমনকি কর্তৃপক্ষও চূড়ান্ত হতাশ হয়ে পড়েন। তারা রেডিও নিয়ে আর কোনও আশা দেখতে পান না।

অন্যদিকে, আর্থিক সঙ্কটের কারণে ঝুঁকিতে রয়েছে কমিউনিটি রেডিও। পাশাপাশি দক্ষ জনবলের অভাবে অনুষ্ঠানের মান বাড়াতে পারছে না তারা। টাওয়ারের উচ্চতা কম হওয়ায় অনেক জায়গায় সিগন্যাল ঠিকমতো পাওয়া এবং বিদ্যুতের ঘাটতির চ্যালেঞ্জও রয়েছে। চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলায় সহযোগিতা করার বিষয়ে সরকারের আশ্বাস আছে বটে কিন্তু এখন পর্যন্ত উদ্যোক্তা সংগঠনগুলোর সহযোগিতা, উৎসাহ আর মনের জোরেই টিকে আছে কমিউনিটি রেডিওগুলো। 

ইন্টারনেট রেডিও:

এ সময় আবার চালু হয়েছে ৫০টির মতো ইন্টারনেট রেডিও। এগুলোর মধ্যে রয়েছে— রেডিও গুনগুন, বাংলা রেডিও, রেডিও তুফান, রেডিও ভয়েস ২৪ ডটকম, রেডিও লেমন ২৪, রেডিও তোলপাড়, রেডিও স্বদেশ, রেডিও কার্নিভাল, এফএনএফ.এফএম, বাংলা, এফএম মুন, রেডিও সংবাদ, রেডিও সারাহা, ইসলাহী মুজাকারা ও রেডিও সিলনেট। যেহেতু সময় এখন ডিজিটাল যোগাযোগের বিকাশের তাই ইন্টারনেট রেডিওগুলোর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখতে পান কেউ কেউ।  

তবু ভবিষ্যতের জন্য:

সরকারি, আন্তর্জাতিক, বাণিজ্যিক এবং কমিউনিটি রেডিও— এই চার ধরন মিলিয়ে এখনও বাংলাদেশে সচল আছে বেশ কিছু রেডিও স্টেশন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে— বাংলাদেশ বেতারের ১৪টি আঞ্চলিক বেতারকেন্দ্র এবং ৩৫টি এফএম; অনুমোদন পাওয়া ২৮টি বেসরকারি এফএম এর মধ্যে সম্প্রচারে আসা ২২টি থেকে একটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ২১টি এফএম; অনুমোদন পাওয়া ৩২টির মধ্যে সম্প্রচারে আসা ১৮টি কমিউনিটি রেডিও এবং ৫০টির মতো ইন্টারনেট রেডিও।

সামাজিক-যোগাযোগমাধ্যমের সুবাদে মানুষ ভিডিও কনটেন্টের দিকে ঝুঁকলেও শ্রুতিমাধ্যম একবারে ছেড়ে দেয়নি মানুষ। কাজের ফাঁকে ফাঁকে শোনার জন্য জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে অডিওবুক-পডকাস্ট। শ্রুতিমাধ্যমের ভিন্ন রকম আবেদন ও সুবিধা রয়েছে।

এ অবস্থায় রেডিওগুলো যা করতে পারে—

ক. ইন্টারনেটভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অডিয়েন্সের জন্য সমসাময়িক কনটেন্ট তৈরি করা;

খ. রেডিওর অনুষ্ঠান নির্মাণ ও সম্প্রচার খরচ কম হওয়ার সুযোগ নিয়ে চারপাশের বিষয়গুলো থেকে বাছাই করে সমসাময়িক, জনগুরুত্বপূর্ণ এবং জনপ্রিয় বিভিন্ন বিষয়ে কনটেন্ট তৈরি এবং প্রচার করা;

গ. ডিজিটাল প্লাটফর্মের সুবাদে রেডিও এখন মুঠোফোনে ‘দেখার’ মতো হয়ে ওঠায় কনটেন্টগুলোর ভিজ্যুয়াল সংস্করণ তৈরি ও প্রচার করা;

ঘ. আর্থিক সঙ্গতির জন্য ডিজিটাল প্লাটফর্মের কনটেন্ট থেকে আয় করার চেষ্টা করা ইত্যাদি।

বাংলাদেশ বেতার থেকে শুরু করে কমিউনিটি রেডিও পর্যন্ত সবাই এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে টার্গেট করে অনুষ্ঠান নির্মাণ এবং সম্প্রচারে জোর দিয়েছে। এভাবে কেউ কেউ টিকে থাকারও আশা করছে। আর গণমাধ্যমের জগৎটা এমন— এখানে সময়ের সাথে কার কখন উত্থান আর কার পতন অথবা পুনর্জাগরণ হয়—এনিয়ে অনিশ্চয়তা থেকেই যায়। যুগের  সাথে তাল মিলিয়ে কৌশল পরিবর্তন করে রেডিও’ও টিকে থাকতে পারে কিংবা আরও বেশি শক্তি নিয়ে আবার জেগে উঠতে পারে— কে জানে?

লেখক: সাংবাদিক ও লেখক। সাংবাদিকতা ও যোগাযোগ বিষয়ক প্রশিক্ষক।ইমেইল: masrurzaman@yahoo.com