ভারতের অষ্টাদশ লোকসভায় বিরোধী দলনেতা হিসাবে নির্বাচিত হলেন কংগ্রেসের নেতা রাহুল গান্ধী। এর মধ্য দিয়ে ২০ বছর পর গান্ধী পরিবারের তৃতীয় সদস্য হিসেবে বিরোধী দলনেতা হলেন তিনি
কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়া জোটের সিদ্ধান্তে সাংবিধানিক এই পদে দায়িত্ব পালন করবেন রাহুল।
প্রায় ৩০ বছরের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে এবারই প্রথম কোনও সাংবিধানিক পদ পেলেন রাহুল গান্ধী। দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয়ভাবে রাজনীতি করছেন কংগ্রেসের কর্ণধার নেহেরু-গান্ধী পরিবারের এই সদস্য। এর আগে দলের সভাপতিও ছিলেন। কিন্তু কোনও সাংবিধানিক পদে দায়িত্ব পালন করা হয়নি।
গান্ধী পরিবার থেকে এর আগে দুই ব্যক্তি এই পদে ছিলেন। রাহুল গান্ধীর বাবা রাজিব গান্ধী, ১৯৮৯-৯০ সালে এই পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। আর রাহুলের মা সোনিয়া গান্ধী ১৯৯৯ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত লোকসভার বিরোধী দলনেতার পদে ছিলেন।
এছাড়া লোকসভায় ১০ বছর পর আনুষ্ঠানিকভাবে একজন নেতাকে বিরোধী দলের নেতার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। ১৬ তম এবং ১৭ তম লোকসভায় কংগ্রেস বা অন্য বিরোধী দলগুলোর কাছে এই পদের জন্য প্রয়োজনীয় ১০ শতাংশ সদস্য ছিল না। এবারের লোসকভা নির্বাচনে কংগ্রেস ৯৯টি আসনে জয় পেয়েছে, যা ১৮ শতাংশের বেশি।
রাহুলের সমর্থন ছাড়া মোদি সরকারের পক্ষে একতরফা কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হবে। লোকসভায় এবার বিজেপির নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায়, রাহুল গান্ধীর ওপর কোনো সিদ্ধান্ত ‘চাপিয়ে’ দেওয়া সহজ হবে না।
বিরোধী দলের নেতা হিসেবে রাহুল গান্ধীকে একজন ক্যাবিনেট মন্ত্রী তথা পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রীর সমান মর্যাদা দেওয়া হবে। এতে সংসদীয় ও রাষ্ট্রীয় প্রোটোকল তালিকায় তার অবস্থান প্রথমদিকে থাকবে।
এছাড়াও একাধিক ক্ষমতা থাকবে তার হাতে। ভারতের ১৯৭৭ সালের সংসদীয় আইন অনুযায়ী, উচ্চ বেতন-ভাতার পাশাপাশি বেশ কিছু সুযোগ-সুবিধা এবং ক্ষমতা মিলবে রাহুলের।
লোকসভায় প্রথম সারিতে আসন
বিরোধী দলনেতা হিসেবে রাহুল গান্ধী লোকসভায় সামনের সারিতে আসন পাবেন। ডেপুটি স্পিকারের আসনের পাশেই থাকবে তার আসন। তিনি বসবেন লোকসভার স্পিকারের চেয়ারের বাম দিকের একেবারে সামনের সারিতে।
পার্লামেন্ট ভবনে সচিবালয়সহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত একটি ঘরও পাবেন। রাহুল আরও কিছু সুবিধা পাবেন। এর মধ্যে রয়েছে নির্বাচিত স্পিকারকে মঞ্চে নিয়ে যাওয়া এবং রাষ্ট্রপতি যখন সংসদের উভয় কক্ষে ভাষণ দেন তখন সামনের সারিতে আসন নেওয়া।
সাংবিধানিক পদে নিয়োগে ভূমিকা
বিরোধী দলের নেতা হিসেবে রাহুল গান্ধী লোকপাল, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার, সিবিআই ডিরেক্টর, সেন্ট্রাল ভিজিল্যান্স কমিশন, সেন্ট্রাল ইনফরমেশন কমিশন এবং সেন্ট্রাল ইনফরমেশন কমিশনের নির্বাচন ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগের প্যানেলের সদস্য হবেন। প্রধানমন্ত্রী এই সব প্যানেলের প্রধান।
তবে এইসব প্যানেলে তিনি থাকবেন সংখ্যালঘু হিসেবে। কারণ, তিনি ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ছাড়া এসব প্যানেলে থাকবেন আরও এক বা একাধিক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী।
সিবিআই, ইডি বা সিভিসির মতো কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলোর প্রধানদের বাছাই করার কমিটিরও সদস্য হবেন রাহুল গান্ধী। এই কমিটিগুলো বাছাইয়ের ক্ষেত্রে রাহুলের হাতে আরও বেশি ক্ষমতা থাকবে। তিন সদস্যের এই কমিটির নেতৃত্বে থাকবেন প্রধানমন্ত্রী মোদি। আর তৃতীয় সদস্য হিসেবে থাকবেন ভারতের প্রধান বিচারপতি বা সুপ্রিম কোর্টের কোনও একজন বিচারপতি।
এটা বিরোধী পক্ষের জন্য বড় খবর। কারণ বিরোধীরা বারবারই অভিযোগ করেন, বিরোধী নেতাদের হয়রানি করতেই বিভিন্ন কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলোকে অপব্যবহার করে মোদির বিজেপি সরকার।
সরকারে নীতি নিয়ে প্রশ্ন
বিরোধী দলনেতা হিসেবে তার অন্যতম প্রধান ভূমিকা সরকারের নীতির উপর কার্যকর প্রশ্ন উত্থাপন। রাহুলের পদটি সত্যিই চ্যালেঞ্জিং হতে চলেছে। কারণ তাকে আইনসভা এবং জনগণের কাছে সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। এই পদে তাকে সরকারি প্রস্তাব বা নীতির বিকল্প উপস্থাপন করতে হবে।
আরও যেসব সুবিধা পাবেন রাহুল গান্ধী
বিরোধী দলনেতা হিসেবে রাহুল গান্ধী ধারা ৩এ উল্লিখিত বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পাবেন। তার বেতন হবে ৩ লাখ ৩০ হাজার রুপি।
পাশাপাশি একজন এমপি হিসেবে একই মর্যাদা ও বেতন স্কেলে একজন সচিবের সাহায্য পাওয়ার অধিকারী হবেন। ক্যাবিনেট মন্ত্রী হিসেবে তার ব্যক্তিগত কর্মীও থাকবে।
রাহুল গান্ধী একজন ব্যক্তিগত সচিব, দুজন অতিরিক্ত ব্যক্তিগত সচিব, দুই সহকারী ব্যক্তিগত সচিব, দুই ব্যক্তিগত সহকারী, একজন হিন্দি স্টেনো, একজন কেরানি, একজন ঝাড়ুদার ও চারজন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মী পাবেন। এছাড়াও রাহুল গান্ধী আতিথেয়তা ভাতা ছাড়াও ১৯৫৪ আইনের ধারা ৪ এর অধীনে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য একই হারে নির্বাচনী ভাতাও পাবেন।
ক্যাবিনেট মন্ত্রী পর্যায়ের নিরাপত্তাও পাবেন তিনি। অর্থাৎ জেড প্লাস ক্যাটাগরির নিরাপত্তা পাবেন রাহুল। ক্যাবিনেট মন্ত্রীদের মতো একটি বড় সরকারি বাংলোও পাবেন।
প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হিসেবে নিজেকে প্রমাণের সুযোগ
পার্লামেন্টে বিরোধী দলনেতার দায়িত্ব রাহুল গান্ধীর রাজনৈতিক জীবনের জন্যও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এর আগে তার সম্পর্কে বিজেপি নেতারা নানা সময়ে কটাক্ষ করেছেন।
তারা প্রশ্ন তুলতেন- রাহুল গান্ধী কে? তিনি বিরোধী দলনেতাও নন, কংগ্রেসের সভাপতিও নন। তাহলে তার কথাকে গুরুত্ব দেওয়া হবে কেন? এখন বিরোধী দলনেতা হওয়ার পর রাহুল গান্ধীকে আর এতটা হেলাফেলা করা যাবে না।
রাহুল গান্ধী এবার সহ পাঁচবারের লোকসভা সদস্য। তিনি প্রথম নির্বাচিত হয়েছিলেন ২০০৪ সালে। সেসময় উত্তর প্রদেশের আমেথি থেকে নির্বাচিত হন তিনি। এখনও পর্যন্ত তিনি শুধু একবারই নির্বাচনে হেরেছেন। সেটিও সেই আমেথি থেকেই। ২০১৯ সালে তাকে পরাজিত করেছিলেন বিজেপির স্মৃতি ইরানি।
তবে ওই একই বছরে তিনি ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য কেরালার ওয়ানাড় আসন থেকে জয়ী হয়ে সংসদে এসেছিলেন। ২০২৩ সালে মানহানির এক মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে, কয়েকদিনের জন্য সংসদ সদস্য পদ খুইয়েছিলেন তিনি।
পরে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে তার সংসদ সদস্য পদ ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ২০১৭ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত তিনি কংগ্রেসের সভাপতি পদেও ছিলেন। বর্তমানে, তিনি যুব কংগ্রেসের চেয়ারপারসন। এবারের নির্বাচনে তিনি ওয়ানাড় এবং রায়বরেলি থেকে ভোটে জিতেছেন।
রাহুল প্রশাসক হিসেবে কেমন, তা জানার বা দেখার সুযোগ হয়নি ভারতের মানুষের। যে কারণে প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হিসেবে অনেকেই এখনও তার ওপর ভরসা রাখতে পারেন না। এবার মন্ত্রী না হলেও, বিরোধী দলনেতার দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়েও প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হিসেবে নিজেকে প্রমাণের সুযোগ পাবেন রাহুল গান্ধী।
তথ্যসূত্র: টাইমস অফ ইন্ডিয়া, আনন্দ বাজার, এনডিটিভি