অনিচ্ছা সত্ত্বেও দলের দাবি এবং মা ও বোনের চাওয়া মেনে নিয়ে ভারতের লোকসভায় বিরোধীদলীয় নেতা হতে রাজি হয়েছেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী।
ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত রাজীব গান্ধী ও দীর্ঘ সময় ধরে কংগ্রেসের হাল ধরা সোনিয়া গান্ধীর ছেলে রাহুলকে লোকসভায় বিরোধীদলীয় নেতা করা নিয়ে মঙ্গলবার রাতে বৈঠকে বসে বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র জ্যেষ্ঠ নেতারা।
দেশটির সবচেয়ে পুরনো এই দলের প্রেসিডেন্ট মল্লিকার্জুন খাড়গের বাড়িতে বৈঠকটি হয় বলে এনডিটিভির এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
বৈঠক শেষে কংগ্রেস নেতা ও রাজস্থানের এমপি কে সি ভেনুগোপাল বলেন, “কংগ্রেস পার্লামেন্টারি পার্টি চেয়ারপারসন সোনিয়া গান্ধী অষ্টাদশ লোকসভার প্রো-টেম স্পিকার ভ্রাতৃহরি মাহতাবকে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন।
“লোকসভায় বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে রাহুল গান্ধীকে নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা চিঠিতে তিনি তাকে জানিয়েছেন।”
এনডিটিভির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লোকসভায় বিরোধীদলীয় নেতার পদে বসতে রাহুল গান্ধী শুরুতে অনাগ্রহী ছিলেন বলে শোনা যাচ্ছিল। তবে দল এবং মা সোনিয়া গান্ধী ও বোন প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর দাবির সামনে শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করেন তিনি।
দুই দশক আগে ২০০৪ সালে নির্বাচনে জয়ের মাধ্যমে ভারতের লোকসভায় জায়গা করে নিলেও এই প্রথম দেশটির সাংবিধানিক পদের দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন যুক্তরাজ্যের ট্রিনিটি কলেজের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের সাবেক ছাত্র রাহুল।
এর জন্য দীর্ঘ ২০ বছর তাকে রাজনীতির চড়াই-উতরাই পেরোতে হয়েছে। শুনতে হয়েছে কটূ কথা।
২০১৭ সালে রাহুলকে কংগ্রেসের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। এর দুই বছর পর ২০১৯ সালে ভারতের লোকসভা নির্বাচনে দলটির শোচনীয় পরাজয় হয়।
বিজেপির ৩০৩টি আসনের বিপরীতে সেবার কংগ্রেস মাত্র ৫২টি আসনে জিতেছিল। এর পুরো দায় নিজের ঘাড়ে নিয়ে কংগ্রেসের প্রেসিডেন্টের পদ থেকে ইস্তফা দেন রাহুল।
তার আগে ২০১৪ সালের নির্বাচনেও বিজেপির সামনে দাঁড়াতে পারেনি কংগ্রেস। সে বছর লোকসভার মাত্র ৪৪টি আসনে জয় পেয়েছিল তারা। অন্যদিকে বিজেপি পেয়েছিল ২৮২টি আসন।
রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই রাহুলকে নিয়ে নেতিবাচক ধারণা জনমানসে যেন গেঁথে যায়। তিনি তার দাদি সাবেক প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত ইন্দিরা গান্ধী বা বাবা রাজীব গান্ধীর মতো সিরিয়াস রাজনীতিক নন- এমনটাই বলাবলি করে মানুষ।
বিশেষ করে প্রধান প্রতিপক্ষ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সামনে রাহুলকে অনেক বেশি অনাকর্ষণীয়, অনেক বেশি ম্লান দেখাচ্ছিল। কথার খেলায় রাহুল থেকে অনেক এগিয়ে মোদী। লোকরঞ্জনবাদী নেতা হিসেবে মোদীর ধারে-কাছেও যেতে পারছিলেন না রাহুল।
এক দশক ধরে মোদী যেভাবে ২৪ ঘণ্টার রাজনীতিক এবং প্রচারক হিসেবে নিজের ইমেজ দাঁড় করিয়েছেন, সেই তুলনায় রাহুল নিজেকে রাজনীতির মাঠে পাকা খেলোয়াড় হিসেবে হাজির করতে ব্যর্থতার পরিচয় দেন।
তবে দেরিতে হলেও রাহুল নিজেকে এই অবস্থান থেকে বদলেছেন। তাকে ঘিরে মানুষের ধারণা প্রথম পাল্টায় ২০২২-২৩ সালে।
সেসময় ভারত জোড়ো যাত্রা কর্মসূচির ডাক দিয়ে দক্ষিণের তামিলনাড়ু রাজ্যের কন্যাকুমারী শহর থেকে একেবারে উত্তরের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল জম্মু ও কাশ্মীরে চার হাজার কিলোমিটার পথ প্রায় দেড়শ’ দিন ধরে হেঁটে পাড়ি দেন রাহুল।
উদ্দেশ্য, নেতিয়ে পড়া দলের তৃণমূল পর্যায়ের কর্মী এবং সমর্থকদের উজ্জীবিত করা। এ বছরের শুরুতেও ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রা কর্মসূচিতে ছয় হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে জনগণের সান্নিধ্যে আসেন তিনি।
রাহুলের এই দুই কর্মসূচির প্রভাব দেখা গেছে এবারের লোকসভা নির্বাচনে। উত্তর প্রদেশের রায়বেরেলি এবং কেরালার ওয়েনাদ থেকে দাঁড়িয়ে দুটি আসনেই জয় পেয়েছেন তিনি। এই আসন দুটিতে রাহুল সাড়ে তিন লাখের বেশি ভোটের ব্যবধানে জয়ী হন।
রায়বেরেলি রেখে ওয়েনাদ আসনটি বোন প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তও সম্প্রতি জানিয়েছেন রাহুল। ওই আসনে উপনির্বাচনে প্রিয়াঙ্কা জয়ী হবেন- এই বিশ্বাস যেমন তার আছে, তেমনি দলেরও আছে।
আর ভারতের এবারের লোকসভা নির্বাচনের পুরো চিত্র দেখে অনেকে ভাবতে শুরু করেছে, রাহুলের নেতৃত্বে কংগ্রেস তাদের হারানো ঐতিহ্য ফিরে পেতে শুরু করেছে। লোকসভার ৯৯টি আসনে জয়ী হয়ে বিজেপিকে এরই মধ্যে বিপাকে ফেলেছেন তিনি।
নির্বাচনে এই প্রথম সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় জোট শরিকদের ওপর ভর করে সরকার গঠন করতে হয়েছে ক্ষমতাসীন দলটিকে।