নতুন সরকার গঠনের আগেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ তুললেন বিরোধী দল কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী।
গত ৪ জুন লোকসভা নির্বাচনের ভোট গণনা শুরু হওয়ার পর ভারতের পুঁজিবাজারে যে পতন ঘটেছিল, তার পেছনে বড় কোনও কারসাজি জড়িত বলে দাবি করেছেন রাহুল। আর এর জন্য তিনি দায়ী করেছেন নরেন্দ্র মোদী ও তার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে।
রাহুলের অভিযোগ, মোদী-অমিত শাহরা বিনিয়োগকারীদের ইচ্ছাকৃতভাবেই ভুল পরামর্শ দিয়েছেন। আর এ কারণেই তারা ক্ষতির শিকার হয়েছেন।
বৃহস্পতিবার এমন অভিযোগ তুলে রাহুল যৌথ পার্লামেন্টারি কমিটি গঠন করে এর তদন্তের দাবিও জানিয়েছেন।
তৃতীয় মেয়াদে ভারতে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রবিবার শপথ নেবেন নরেন্দ্র মোদী। এদিন তার নতুন মন্ত্রিসভার সদস্যরাও শপথ নেবেন।
নির্বাচন চলাকালে বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব বারবার বিনিয়োগকারীদের পুঁজিবাজারে শেয়ার কেনার পরামর্শ দিয়েছিলেন। মোদীসহ কয়েকজন বিজেপি নেতা বলেছিলেন, নির্বাচনের ফল ঘোষণার সময় শেয়ারের দাম বেড়ে যাবে।
এমনকি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছিলেন, “৪ জুনের আগেই শেয়ার কিনুন। এরপর দাম বেড়ে যাবে।”
বুথফেরত জরিপেও বিজেপির দুর্দান্ত জয়ের ইঙ্গিত পেয়ে ফল প্রকাশের আগের দিন রেকর্ড হারে বেড়েছিল শেয়ারবাজারের সূচক। ৩ জুন ভারতের শেয়ারবাজার আগের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছিল।
কিন্তু পরদিন ফল ঘোষণা শুরু হওয়ার পর তা বুথফেরত জরিপের সঙ্গে না মেলায় বিশাল ধস নামে ভারতের পুঁজিবাজারে। কারণ ভোট গণনার প্রথম দিকে বিজেপি অনেক কম আসন পাবে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। এতে মাথায় বাড়ি পড়ে খুচরা বিনিয়োগকারীদের। রাহুলের দাবি, ৩০ লাখ কোটি রুপির ক্ষতি হয়েছে বিনিয়োগকারীদের।
অবশ্য, চূড়ান্ত ফলাফলে বিজেপি জোটের জয় নিশ্চিত হয়ে গেলে পরদিন থেকেই আবার পুঁজিবাজার স্বাভাবিক হতে শুরু করে। শুক্রবারও ভারতের পুঁজিবাজারে সূচকে ঊর্ধ্বগতি দেখা গেছে।
রাহুল গান্ধীর নিজের কেনা শেয়ারগুলোর দামও বৃহস্পতিবারের মধ্যে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরেছে। তার যেসব কোম্পানির শেয়ার কেনা রয়েছে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হচ্ছে ইনফোসিস, এলটিআইমিন্ডট্রি, টাটা কনসালটেন্সি সার্ভিসেস, আইটিসি, হিন্দুস্তান ইউনিলিভার, নেসলে ইন্ডিয়া, এশিয়ান পেইন্টস ও পিডিলাইট ইন্ডাস্ট্রিজ।
ভরতের পুঁজিবাজারে সাম্প্রতিক এই ধসের ঘটনাকে দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় পুঁজিবাজার কেলেঙ্কারি বলে অভিহিত করেছেন রাহুল গান্ধী। তার দাবি, পুঁজিবাজারের এই ভরাডুবির নেপথ্যে বড় হাত রয়েছে। একে ইতিহাসের অন্যতম বড় দুর্নীতি বলেও আখ্যা দেন তিনি।
বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে রাহুল তার অভিযোগের পেছনে ঘটনার পরম্পরায় যুক্তিও তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “গত ১৩ মে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ একটি নির্দিষ্ট সংবাদ চ্যানেলে (এনডিটিভিতে) ৪ জুনের আগে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের পরামর্শ দিয়েছিলেন বিনিয়োগকারীদের। ১৯ মে ওই একই চ্যানেলে নরেন্দ্র মোদীও বলেছিলেন, ৪ জুন স্টক মার্কেটে রেকর্ড হবে। ২৮ মে ফের একই কথার পুনরাবৃত্তি করেন মোদী।”
রাহুল বলেন, “এরপর ১ জুন সামনে এসেছিল বুথফেরত জরিপগুলোর ফল। তাতে ইঙ্গিত দেওয়া হয়, ৩৭০ থেকে ৪০০ আসন পেতে চলেছে বিজেপি। কিন্তু বিজেপির অভ্যন্তরীণ মূল্যায়নে বলা হয়েছিল, ২২০ আসন পেতে পারে বিজেপি। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও নাকি জানিয়েছিল ২০০ থেকে ২২০ আসন পেতে পারে বিজেপি।”
বিজেপি যে নির্বাচনে খারাপ ফল করতে চলেছে, তা দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব জানত বলেও দাবি করেন রাহুল। তারপরও তারা বিনিয়োগকারীদের এমন পরামর্শ কেন দিলেন, সেই প্রশ্ন তোলেন লোকসভা নির্বাচনে দুটি আসনে জয় পাওয়া কংগ্রেসের এই নেতা।
৩০ ও ৩১ মে পুঁজিবাজারে আগের দিনগুলোর তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ বিনিয়োগ এসেছিল দাবি করে রাহুলের আরও অভিযোগ, “যারা জানতেন স্টক মার্কেটে কিছু কারসাজি চলছে, তারাই এই সময়ে বিনিয়োগ করেছিলেন। হাজার হাজার কোটি রুপি বিনিয়োগ করা হয়েছিল। বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও ভারতের পুঁজিবাজারে অর্থ ঢালেন।”
এটা ভারতের পুঁজিবাজারের সবচেয়ে বড় কেলঙ্কারি দাবি করে রাহুল গান্ধী প্রশ্ন তুলেছেন, ভারতে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে এমন পাঁচ কোটি পরিবারকে কেন প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিনিয়োগের পরামর্শ দিলেন? এটা কি তাদের কাজ?
কেন প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একই ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর মালিকানাধীন একই মিডিয়া হাউসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এই পরামর্শ দিলেন, যেখানে ওই ব্যবসায়িক গোষ্ঠী ইতোমধ্যে পুঁজিবাজারে কারসাজি করার অভিযোগে ভারতের সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ডের তদন্তাধীনে রয়েছে, সেই প্রশ্ন তোলেন রাহুল।
তার আরও অভিযোগ, বিজেপি, ভুয়া বুথফেরত জরিপকারী এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সংযোগ রয়েছে।
এর নেপথ্যে ভারতের দ্বিতীয় শীর্ষ ধনী গৌতম আদানির হাত থাকতে পারে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে সাংবাদিকদের রাহুল বলেন, “আদানি যুক্ত থাকতে পারেন, কিন্তু তার থেকেও বড় হাত রয়েছে।”
ভারতের অন্যতম প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম এনডিটিভির মালিক আদানি গ্রুপ।
রাহুল আরও বলেন, “এটা যে একটা আর্থিক কেলেঙ্কারি, এই বিষয়ে আমাদের কোনও সন্দেহ নেই। ৫ কোটি ভারতীয় খুচরা বিনিয়োগকারীর ক্ষতি করে লাখ লাখ কোটি রুপি হাতিয়ে নিয়েছেন অন্য কেউ। আর ভারতীয়দের শেয়ার কেনার জন্য পরামর্শ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এটা ফৌজদারি অপরাধ।
“তাই আজ আমরা দাবি জানাচ্ছি, যৌথ সংসদীয় কমিটি করে এই ঘটনার তদন্ত করতে হবে। আমরা প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং যেসব সংস্থা বুথফেরত জরিপ করেছে, তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত চাই।”
তবে বিজেপি এই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে। এই প্রসঙ্গে বিজেপি নেতা পীযুষ গয়াল বলেন, “রাহুল গান্ধী এখনও লোকসভা ভোটের হারের শোক ভুলতে পারছেন না। সে কারণে বিনিয়োগকারীদের ভুলপথে চালিত করার ষড়যন্ত্র করছেন। অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশগুলোর তালিকায় ভারত এখন পঞ্চম স্থানে।”
তিনি বলেন, “এপ্রিল এবং মে মাসে যখন সূচক বাড়ছিল, তখন বাজারে বিদেশিরা শেয়ার বিক্রি করেছিল এবং ভারতীয় বিনিয়োগকারীরা শেয়ার কিনেছিল। ফলে গত ২ মাসে এই বৃদ্ধির সুফল ভারতীয় বিনিয়োগকারীরাই পেয়েছেন। কারণ তারা এবার চড়া দামে বিক্রি করেছেন। বুথফেরত জরিপের পর ভারতীয়রা বিক্রি করেছে, আর বিদেশিরা চড়া দামে কিনেছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা উচ্চমূল্যে ৬ হাজার ৮৫০ কোটি রুপির শেয়ার কিনেছে। ভারতীয় বিনিয়োগকারীরাই এর সুফল পেয়েছে।
“৪ জুন ফল প্রকাশের পর সূচক কমেছে, এখন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা কম দামে বিক্রি করেছে আর ভারতীয়রা কম দামে কিনছে। সুতরাং, বিদেশিরা বেশি দামে কিনে কম দামে বিক্রি করেছে। আর ভারতীয় বিনিয়োগকারীরা বেশি দামে বিক্রি করে কম দামে কিনেছে। ফলে লাভ ভারতীয়দেরই হয়েছে।”
তিনি বলেন, “কারও ক্ষতি হয়নি। রাহুল গান্ধী ৩০ লাখ কোটি রুপির কথা বলছেন। এ থেকেই আমি বুঝতে পেরেছি কেন রাহুল গান্ধীর প্রতি দেশের জনগণের কোনও আস্থা নেই, কারণ তিনি এটাও বোঝেন না যে এটি মূল্যায়ন। মূল্যায়ন কিছুই না। ক্রয় এবং বিক্রয় গুরুত্বপূর্ণ। আর তাতে ক্ষতি হয়েছে বিদেশিদের। ভারতীয় বিনিয়োগকারীরা লাভবান হয়েছেন। ভারতের খুচরা বিনিয়োগকারীরাও এই সময়ের মধ্যে উপকৃত হয়েছেন।”
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির তৃণমূল কংগ্রেসও পুঁজিবাজার নিয়ে অভিযোগ তুলেছে। তৃণমূলের রাজ্যসভার এমএলএ সাকেত গোখলে ভারতের সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ডকে এ বিষয়ে চিঠি দিয়েছেন। ওই চিঠিতে বলা হয়, বুথফেরত জরিপের মাধ্যমে কারসাজি করে পুঁজিবাজারের সূচককে চড়িয়ে তোলা হয়েছিল কি না, তা নিয়ে পূর্ণ তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।
তথ্যসূত্র: আল জাজিরা, বিবিসি, বিজনেস টুডে, এনডিটিভি, টাইমস অব ইন্ডিয়া, আনন্দবাজার পত্রিকা