Beta
মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল, ২০২৫
Beta
মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল, ২০২৫

রাজশাহীতে দুই বোনের মৃত্যুর কারণ কি অজানাই থেকে যাবে

মুফতাউল মাশিয়া ও মুনতাহা মারিশা গত ফেব্রুয়ারিতে চার দিনের ব্যবধানে মারা যায়।
মুফতাউল মাশিয়া ও মুনতাহা মারিশা গত ফেব্রুয়ারিতে চার দিনের ব্যবধানে মারা যায়।
[publishpress_authors_box]

গত ফেব্রুয়ারিতে রাজশাহীতে চার দিনের ব্যবধানে মৃত্যু ঘটে দুই বোনের। শিশু দুটি বরই খাওয়ার পর অসুস্থ হওয়ায় প্রথমে নিপা ভাইরাস সংক্রমণ বলে ধারণা করা হচ্ছিল। কিন্তু পরে আইইডিসিআর জানায়, পরীক্ষায় নিপা সংক্রমণের প্রমাণ মেলেনি।

তাহলে কোন কারণে মারা গেল শিশু দুটি? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে তৎপর হয়নি দেশের স্বাস্থ্য বিভাগ। অথচ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের ও দেশের মানুষের স্বার্থেই শিশু দুটির মৃত্যুর কারণ খোঁজার দরকার ছিল।

৪ দিনে দুই বোনের মৃত্যু

রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের গণিত বিভাগের প্রভাষক মনজুর রহমানের বাড়ি ওই জেলার দুর্গাপুর উপজেলায়। তবে তিনি স্ত্রী পলি খাতুন এবং দুই শিশুকন্যা নিয়ে সারদার ক্যাডেট কলেজের কোয়ার্টারে থাকতেন।  

তার দুই মেয়ে মুফতাউল মাশিয়া ও মুনতাহা মারিশা গত ফেব্রুয়ারিতে চার দিনের ব্যবধানে মারা যায়। বেঁচে থাকলে গত ২ মার্চ ২ বছর হতো মুনতাহার, ৩০ মে মুফতাউলের বয়স হতো ৫ বছর।

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তাদের মা পলি জানান, ১৩ ফেব্রুয়ারি গৃহকর্মী কলেজ ক্যাম্পাসের গাছের নিচে পড়ে থাকা বরই এনে দুই বোনকে খেতে দিয়েছিলেন। সেই বরই না ধুয়েই খেয়ে ফেলে দুই বোন।

তবে সেদিন তারা ভালোই ছিল জানিয়ে পলি বলেন, পরদিন ছোট মেয়ে মুনতাহার জ্বর আসে, বমিও হয়।

এরপর মেয়েকে নিয়ে মনজুর ও পলি রাজশাহী সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) রওনা হন। তবে শহরে ঢোকার আগেই মুনতাহার মৃত্যু হয়।

ছোট মেয়ের লাশ দাফন করতে সপরিবারে বাড়িতে গিয়েছিলেন মনজুর। সেখানে বড় মেয়ে মুফতাউলও অসুস্থ হয়ে পড়ে। প্রথমে তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়।

সেখান থেকে পাঠানো হয় রাজশাহী সিএমএইচে। অবস্থার অবনতি ঘটলে তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে নেওয়া হয়।

তবে বাঁচানো যায়নি মুফতাউলকেও। ছোট বোনের মৃত্যুর পর চারদিন পর সেও মারা যায়।

কী লক্ষণ ছিল

মেনিঙ্গোকক্কাল মেনিনজাইটিসের লক্ষণ এমন।

দুই বোনের ক্ষেত্রেই জ্বরের সঙ্গে মাথাব্যথা ছিল। ছোট মেয়েকে দাফনের আগে মনজুর-পলি দেখেন, তার গায়ে কালো ছোপ ছোপ দাগ, যেটা গরম তেলের কারণে সৃষ্ট ফোসকার মতো।

বড় মেয়ে অসুস্থ হলে তার গায়েও একই রকম কালো ছোপ দেখতে পেয়েছিলেন তারা। এমন দাগ তারা আগে কখনও দেখেননি বলে জানান।

দুই মেয়ের মৃত্যুর পর রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একটি ওয়ার্ডে আইসোলেশনে রাখা হয়েছিল এই দম্পতিকে। তখন পলির জ্বর এলেও মনজুর ছিলেন সুস্থ। পরে পলি সেরে ওঠেন।

সন্দেহ নিপা, তবে প্রমাণ মেলেনি

বরই খাওয়ার পর অসুস্থ হওয়ায় ধারণা করা হচ্ছিল, দুই বোন নিপা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিল। এই ভাইরাসটি সাধারণও বাদুর থেকে ছড়ায়।

তখন রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) থেকে একটি দল গিয়েছিল রাজশাহীতে; তারা মৃত শিশুদের নমুনা সংগ্রহ করেছিল।

আইইডিসিআর পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরীন তখন সকাল সন্ধ্যাকে বলেছিলেন, দুই শিশুর নমুনা পরীক্ষায় নিপা ভাইরাস ‘নেগেটিভ’ আসে।

তবে শিশু দুটি অন্য কোনও ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিল কি না, তা পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছিলেন তিনি।

এরপর পরীক্ষাই হলো না

এরপর পরীক্ষা হলো কি না, হলেও কী মিলল, সে বিষয়ে আইইডিসিআর থেকে কিছু জানানো হয়নি।

শিশু দুটির বাবা মনজুর সাড়ে ৩ মাস পর সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, কেউ তাদের কিছু জানায়নি।

“আমার দুটো সন্তান চলে গেল। কেন গেল, কী হয়েছিল, তার কিছুই জানতে পারলাম না। কেউ আমাকে কিছু জানালো না, এটা হতে পারে না।”

দুই মেয়ে হারানো মনজুরের সঙ্গে কথা বলার সময় তার অসহায়ত্ব ছাপিয়ে ক্ষোভের সঞ্চার ফোনের এপাশ থেকেও টের পাওয়া যাচ্ছিল।

“তারা নাকি আইডিয়া করে বলেছে, মেনিঙ্গোকক্কাল মেনিনজাইটিস। কিন্তু তার প্রমাণ নাই, টেস্টের রিপোর্টে নাই,” বলেন তিনি।

মুফতাউল মাশিয়া ও মুনতাহা মারিশা আজ কেবলই ছবি।

জানতে চাইলে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফ এম শাহীন আহমেদ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, তারা এবিষয়ে কিছু জানেন না, কারণ তাদের কিছু জানানো হয়নি।

“অফিসিয়ালি রিপোর্ট আমাদেরকে দেয় নাই। হয়ত ডিজি হেলথ (স্বাস্থ্য অধিদপ্তর) দিয়েছে; তাই জানি না।”

আইইডিসিআরেরই সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান হতাশ কণ্ঠে সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “দেশজুড়ে আলোড়ন তৈরি করা দুই শিশুর মৃত্যু নিয়ে শেষ পর্যন্ত আমরা কিছু জানতে পারিনি।”

আইইডিসিআর পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিন সকাল সন্ধ্যার জিজ্ঞাসায় বলেন, তারা ধারণা করছেন এটি মেনিঙ্গোকক্কাল মেনিনজাইটিস।

কিন্তু তাও নিশ্চিত নয় জানিয়ে তিনি বলেন, “এটা নিশ্চিত করার সুযোগও ছিল না।”

মেনিঙ্গোকক্কাল মেনিনজাইটিস কী

মেনিঙ্গোকক্কাল মেনিনজাইটিস একটি গুরুতর ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ। মেনিনজাইটিসের এই ধরনটিতে মৃত্যুহার বেশ উচ্চ।

মেনিঙ্গোকক্কাল ব্যাকটেরিয়া।

চিকিৎসকরা বলেন, এটি মহামারিও তৈরি করতে পারে। এই ব্যাকটেরিয়া শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে ছড়াতে পারে করোনাভাইরাসের মতো। ছড়াতে পারে হাঁচি বা কাশির মাধ্যমে।

যদি দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা না যায়, তাহলে এটি মস্তিষ্কের মারাত্মক ক্ষতি করে এবং মৃত্যু ঘটাতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা জানান।

এতে আক্রান্তের লক্ষণের মধ্যে রয়েছে- জ্বর, মাথাব্যথা, বমি বমি ভাব এবং বমি হওয়া, ঘাড় শক্ত হয়ে যাওয়া, বিভ্রান্ত মানসিক অবস্থা। সেইসঙ্গে রয়েছে শরীরে গাঢ় বেগুনি ফুসকুড়ি।

এগুলোর অনেকটাই মারা যাওয়া দুই বোনের মধ্যে ছিল।

চিকিৎসকরা বলছেন, রোগ নির্ণয় সঙ্গে সঙ্গে হলেও প্রায় আট থেকে ১৫ শতাংশ রোগী সংক্রমণের প্রথম ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টাও বেঁচে থাকতে পারে না।

কারণ জানা কেন জরুরি

মুমতারিন ও মুফতাউলের মৃত্যুর কারণ জানা পরবর্তী চিকিৎসা এবং এই রোগ প্রতিরোধের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা।

শিশু দুটির বাবা মনজুর বলেন, “ছোটটা না হয় মারা গেল, বড় মেয়েটা তো দুইদিন সময় দিয়েছিল। কিন্তু ডাক্তাররা ধরতেই পারল না, বুঝতেই পারল না।”

অধ্যাপক মাহমুদুর বলেন, “আমি নিজে অধ্যাপক তাহমিনার (বর্তমান পরিচালক) সঙ্গে কথা বলেছিলাম এ নিয়ে। ফারদার (পরবর্তী) ইনভেস্টিগেশন করা দরকার ছিল।”

সুযোগ ছিল না- তাহমিনা শিরিনের এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন অধ্যাপক মাহমুদুর।

তিনি বলেন, “দেশে অনেক সুযোগ না থাকলেও সে নিয়ে কাজ করা যায়। আইইডিসিআর এর আগে এরকম অনেক কাজ করেছে। যেটা দেশে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি, তার অধিকতর পরীক্ষার জন্য সিডিসিতে (সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন, যুক্তরাষ্ট্র) পাঠিয়েছে, সেখান থেকে রোগ শনাক্ত হলে তার প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয়েছে।”

আইইডিসিআর ভবন।

অধিকতর পরীক্ষায় কেন যাওয়া হলো না- সকাল সন্ধ্যার সেই প্রশ্নে অধ্যাপক তাহমিনা ‘সুযোগ ছিল না’ বলার পর আর তা নিয়ে কিছু বলতে চাননি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আইইডিসিআরের এই পরবর্তী পদক্ষেপে না যাওয়াকে দায়িত্বে অবহেলা, জনস্বার্থকে গুরুত্ব না দেওয়ার নজির হিসাবে দেখছেন।

তাদের একজন বলেন, নতুন কোনও রোগের আবির্ভাব হলেই কাজ করে আইইডিসিআর। রোগ নিয়ে গবেষণা করে তার প্রতিকার, প্রতিরোধ নিয়ে কাজ করবে। শিশু দুটির মৃত্যুর পর কেবল ‘সন্দেহজনক’ বলে বসে থাকার সুযোগ তাদের নেই।

একজন চিকিৎসক বলেন, “স্যাম্পল বাইরে (দেশের বাইরে) পাঠানো যেত। অতীতেও তো এমন হয়েছে। এমনকি শুরুতে নিপাও শনাক্ত হয়েছে দেশের বাইরে।

“কিন্তু এই শিশুদের আসলে কী হয়েছিল? কেন দুই বোন প্রায় একসঙ্গে মারা গেল? এর একটা বিহিত হওয়া প্রয়োজন ছিল। এটা দেশের স্বার্থেই হওয়া উচিৎ ছিল।”

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশু দুটির মৃত্যুর কারণ জানা গেলে প্রতিরোধের পাশাপাশি সেই রোগ বিষয়ে মানুষকে সচেতন করে তোলার সুযোগ থাকত।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত