মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু শহরে আবার মুহুর্মুহু বিস্ফোরণ হচ্ছে, যা আতঙ্ক ছড়াচ্ছে টেকনাফ সীমান্তে বাংলাদেশিদের মধ্যে।
মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধের মধ্যে বাংলাদেশ লাগোয়া রাখাইন রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই এখন সেদেশের বিদ্রোহী দল আরাকান আর্মির হাতে।
তবে এখন এই বিদ্রোহ গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মুসলমান জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র দলগুলো দাঁড়াচ্ছে বলে ওপার থেকে খবর পাওয়া গেছে।
আরাকান আর্মিকে ঠেকাতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের যুদ্ধে ঠেলে দিচ্ছে বলে এর আগেও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছিল।
বিস্ফোরণে আতঙ্ক
টেকনাফে নাফ নদীর ওপারে মংডু এলাকায় গত ৩ নভেম্বরের পর শান্তই ছিল। মঙ্গলবার রাত থেকে আবার বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়ার খবর জানিয়েছে স্থানীয়রা। এতে টেকনাফ সদর এবং হ্নীলা ও সাবরাং এলাকায় বাসিন্দারা আতঙ্কে রয়েছে। তারা মংডু এলাকায় রাতদিন যুদ্ধবিমানের চক্কর দিতেও দেখেছেন।
সাবরাং আছারবনিয়ার মোহাম্মদ সাবের সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এমন বিকট বিস্ফোরণের শব্দ আগে কখনও শোনা যায়নি। ফজরের নামাজের সময় বোমার শব্দে থর থর করে কেঁপে উঠে পুরো মসজিদ।”
টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের গণমাধ্যমকর্মী জসিম মাহমুদ বলেন, “নয় মাস ধরে এলাকার মানুষের চোখে ঘুম নেই। দিনের বেলা তো যেমন-তেমন, রাত হলেই বাড়ে দুশ্চিন্তা।
“মিয়ানমারের সমস্যার কারণে এপারের বাসিন্দারা সবসময় আতঙ্কের মধ্যে বসবাস করতে হচ্ছে। যুদ্ধ বিমানগুলো আমার বাড়ির ওপর দিয়ে গিয়ে বোমা নিক্ষেপ করছে, এমন মনে হয়। তারা আমাদের আকাশ সীমা অতিক্রম করছে কি না, সেই প্রশ্নও দেখা দিয়েছে।”
ইরাবতীর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, রাখাইনে আরাকান আর্মি গত রবিবারই সামরিক বাহিনীর একটি হেলিকপ্টার ভূপাতিত করেছে। সেই হেলিকপ্টারের ছবিও তারা সোশাল মিডিয়ায় দিয়েছে।
হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাশেদ মাহমুদ আলী ও সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুর হোসেন বলেন, বিস্ফোরণের বিকট শব্দে লোকজন শান্তিতে ঘুমাতে পারছে না। বিশেষ করে, শিশু ও বয়স্কদের নিয়ে খুবই বিপাকে পড়তে হচ্ছে।
তবে ওপারের সংঘর্ষকে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসাবে দেখার কথা জানিয়েছেন টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরী। তবে তাতে এপারের বাংলাদেশিরাও যে সমস্যায় পড়েছেন, তা স্বীকার করেন তিনি।
ইউএনও আরও বলেন, এ সংঘাতের জেরে কেউ যাতে অবৈধভাবে বাংলাদেশে করতে না পারে, সে লক্ষ্যে সীমান্তে বিজিবি ও কোস্টগার্ডের টহল জোরদার করা হয়েছে।
মিয়ানমারে সংঘাতের জেরে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের পালিয়ে আসার ঘটনা বারবারই ঘটে। টেকনাফ ও উখিয়ায় এখন ১৩ লাখের মতো রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়ে আছে। তাদের ফেরত পাঠানোর কোনও উদ্যোগই সফল হচ্ছে না।
সংঘর্ষে কারা
সীমান্তবাসী একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছে, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে হটিয়ে রাখাইন রাজ্যের বেশিরভাগ এলাকা এখন আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে। সরকারি বাহিনী বিমান থেকে বোমাবর্ষণ চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এর মধ্যে স্থলভাগে আরাকান আর্মির বিপক্ষে যুদ্ধে নেমেছে রোহিঙ্গা গোষ্ঠিগুলো।
হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মোহাম্মদ আলী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “নাফ নদীর জালিয়ার দিয়া ও লাল দিয়া নামে এ দুটি চরে মিয়ানমারের বিদ্রোহী দুটি গোষ্ঠী অবস্থান করছে।”
স্থানীয়রা জানায়, ২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর জাতিগত নিধনযজ্ঞের শিকার রোহিঙ্গারা এবার আরাকান আর্মির নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। ফলে রোহিঙ্গা সংগঠনগুলো রুখে দাঁড়াচ্ছে।
দীর্ঘদিন নানাভাবে বিভক্ত সশস্ত্র রোহিঙ্গা গোষ্ঠীগুলো গত ৮ নভেম্বর একটি বৈঠক করেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। ওই বৈঠকে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা), রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও), আরাকান রোহিঙ্গা আর্মি (এআরএ) এবং ইসলামি মহাজ গোষ্ঠীর নেতারা উপস্থিত ছিলেন। তারা আরাকান আর্মির বিপক্ষে লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নেয়।
গত ৮ নভেম্বর জাপানের টেলিভিশন এনএইচকেতে প্রচারিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, রাখাইনে বৌদ্ধদের নেতৃত্বাধীন আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে লড়াই করতে রোহিঙ্গা মুসলিমদের পাঠানোর কৌশল নিয়েছে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী।
কিছু ভিডিও পাওয়ার কথাও জানিয়েছে এনএইচকে, যেখানে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর মতো পোশাকে অস্ত্র হাতে দেখা গেছে।
আরাকান আর্মি সামরিক প্রধান তাওয়ান মিন্ত নাইং বলেছেন, “সেনাবাহিনী এখন এতটা দুর্দশায় আছে যে তারা রোহিঙ্গাদের রিক্রুট করছে। রোহিঙ্গাদের অস্ত্র দিয়ে রাখাইনদের হত্যা করতে পাঠাচ্ছে।”
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ জানিয়েছে, বাংলাদেশে থাকা রোহিঙ্গাদেরও দলে ভেড়াচ্ছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। সেখান থেকে এরইমধ্যে ২ হাজার জন্যকে রিক্রুট করা হয়েছে।
ক্রাইসিস গ্রুপের মিয়ানমার ও বাংলাদেশ বিষয়ক জ্যেষ্ঠ পরামর্শক এনএইচকে’কে বলেন, “রোহিঙ্গাদের কয়েকটি সশস্ত্র দল এরই মধ্যে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। রাখাইন ও বাংলাদেশের শরণার্থী শিবির থেকে রোহিঙ্গাদের রিক্রুট করতে তারা সামরিক বাহিনীর পক্ষে কাজ করছে।”