উপহারের ঢল নেমেছে অযোধ্যায়। কী নেই তাতে! সিঁদুর, পিঠা, সবজি, লাড্ডু থেকে শুরু করে সোনার জুতা, সবই আছে উপহারের তালিকায়। আসছে ভারতের নানা প্রান্ত থেকে, উপলক্ষ রাম মন্দির উদ্বোধন। এনিয়ে গোটা অযোধ্যায় এখন সাজসাজ রব।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সোমবার অযোধ্যার এই বিশাল মন্দিরের উদ্বোধন করবেন। ধারণা করা হচ্ছে, এই উদ্বোধন তার তৃতীয়বার জয়ের পথ সুগম করবে।
রাম জন্মভূমি মন্দিরের নির্মাণ এখনও শেষ হয়নি। মন্দিরটি যেখানে তৈরি হচ্ছে এর কিছু দূরেই ষোড়শ শতকে নির্মিত বাবরি মসজিদ, ৩২ বছর আগে যেটি ধ্বংস করা হয়েছিল।
বিতর্কিত সেই স্থানে একটি হিন্দু মন্দির নির্মাণে মোদীর দীর্ঘদিনের প্রতিশ্রুতি এখন পূরণ হতে যাচ্ছে।
১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনা হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ভারতের রাজনীতির মানচিত্র পাল্টে দেয়। তাতে গতিশীল হয় হিন্দু জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, যার উপর ভর করে বিজেপির উত্থান।
এসব কারণে সোমবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ঘিরে রয়েছে তুমুল বিতর্ক। দেশটির অনেক হিন্দুই এই অনুষ্ঠান সাড়ম্বরে উদযাপন করবেন।
কিন্তু ভারতের সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠীর জন্য এটি ধর্মীয় বিভাজনের বেদনাদায়ক স্মৃতি। বিজেপির শাসনে এই বিভাজন আরও গভীর হতে পারে, এটাই তাদের আশঙ্কা।
সোমবার যা হতে যাচ্ছে
হিন্দুদের দেবতা রামের একটি মূর্তি উদ্বোধনের দিন মন্দিরের গর্ভে স্থাপিত হবে। আর এই পুরো প্রক্রিয়াটি হবে মোদীর পরিচালনায়। কোটি কোটি মানুষ এই দৃশ্য দেখার অপেক্ষায় আছেন।
ভারতের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদসহ ৭ হাজারের বেশি মানুষকে এই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে তারা এই ঘটনার সাক্ষী হবেন।
সোমবার অযোধ্যায় কমপক্ষে ১০০টি ভাড়া করা বিমান অবতরণ করবে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যম বলছে, নগরীর হোটেলগুলোতে এখন কক্ষ খালি পাওয়াই ভার। যা পাওয়া যাচ্ছে, তার ভাড়াও দিনে ১২০০ ডলারেরও বেশি।
রাম মন্দিরে গত ১৬ জানুয়ারি থেকে একদিকে পূজারীরা পূজা-অর্চনা করছেন। অন্যদিকে শ্রমিকরা মন্দির চত্বরে মূর্তি স্থাপনের কাজ করে যাচ্ছেন।
আর বিজেপির নেতাদের মুখ দেখা যাচ্ছে টেলিভিশনের পর্দায়। ভারতীয় টিভিগুলো ২৪ ঘণ্টা মন্দিরের বিভিন্ন কার্যক্রম দেখাতে ব্যস্ত।
অনুষ্ঠানটি বিদেশে ভারতীয় দূতাবাস ও নিউ ইয়র্কের টাইমস স্কয়ারের বিশালকার টিভি স্ক্রিনে দেখানো হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
রাম মূর্তির ‘প্রাণ প্রতিষ্ঠা’ উপলক্ষে মোদী ধর্মীয় রীতি অনুসারে ১১ দিনের উপবাস ও প্রার্থনা করছেন।
সম্প্রতি তিনি তার ইউটিউব চ্যানেলে এক ভিডিওবার্তায় বলেন, “উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভারতের সব মানুষের প্রতিনিধিত্বের জন্য ভগবান আমাকে মাধ্যম হিসেবে গড়ে তুলেছেন। আমি সবার কাছে আশীর্বাদ চাই।”
রাম মন্দির কেন বিতর্কিত
ভারতে মুঘলরা ১৫২৬ থেকে ১৮৫৮ সাল পর্যন্ত শাসন করে। ষোড়শ শতকে তাদের হাত ধরেই নির্মিত হয়েছিল বাবরি মসজিদ।
হিন্দুদের অনেকের বিশ্বাস, প্রথম মুঘল সম্রাট বাবর একটি হিন্দু মন্দির ধ্বংস করে তার উপর বাবরি মসজিদটি তৈরি করেছিলেন। তাদের জন্য এই জায়গার গুরুত্ব অনেক।
কারণ তারা বিশ্বাস করেন, এটা দেবতা রামের জন্মস্থান। আর তাকে সম্মান জানিয়েই নতুন রাম মন্দির নির্মাণ করা হচ্ছে।
কট্টর হিন্দুরা অনেক বছর ধরেই বাবরি মসজিদ ভেঙে সেখানে মন্দির নির্মাণের প্রচার চালিয়ে আসছিল। ১৯৯২ সালে বিজেপি ও অন্য ডানপন্থি গোষ্ঠীর উসকানিতে হাতুড়ি নিয়ে হামলা হয় বাবরি মসজিদে। তার প্রতিক্রিয়ায় ব্যাপক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছিল।
ওই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে একাধিক মসজিদ-মন্দিরে হামলা হয়েছিল। দাঙ্গায় গোটা দেশে দুই হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় হওয়া রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর ভারত এমন সহিংসতা আর দেখেনি।
ধ্বংসপ্রাপ্ত মসজিদের জায়গায় রাম মন্দির নির্মাণের জন্য পরের বছরগুলোতে হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা একজোট হয়। এ নিয়ে কয়েক দশক ধরেই রাজনৈতিক টানাপড়েন চলে।
দেশটির সুপ্রিম কোর্ট ২০১৯ সালে অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণের অনুমতি দিয়ে কয়েক দশক ধরে চলা বিতর্ক অবসান ঘটানোর চেষ্টা করে।
তাকে মোদী এবং তার সমর্থকরা নিজেদের বিজয় হিসেবে প্রচার করে। কিন্তু অনেক মুসলিমের জন্য এটি ছিল বিরাট ধাক্কা। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনা আজও তাদের হৃদয়ে গভীর ক্ষত হয়ে আছে।
মন্দিরের সঙ্গে মোদীর যোগ
মোদী ২০১৪ সালে দেশের অর্থনৈতিক সংস্কার ও উন্নয়নের নতুন যুগের সূচনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় বসেন। কিন্তু তার রাজনৈতিক জীবনজুড়েই তিনি হিন্দুত্ববাদকে সামনে রেখে চলছেন। এটি এমন এক মতাদর্শ যা বিশ্বাস করে, ভারত একটি হিন্দু রাষ্ট্র হওয়া উচিৎ।
ক্ষমতায় থাকাকালে মোদীর দল তার মূল ভোটারদের অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেয়। অনেকেই এই প্রতিশ্রুতিকে দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট হিসেবে দেখেন।
চার বছর আগে সুপ্রিম কোর্ট যখন রায় ঘোষণা করে, তখন মোদী বলেন, “এই সিদ্ধান্ত জাতির জন্য ‘এক নতুন সূর্যোদয়’ এনেছে এবং এটি ‘এক নতুন ভারত’ সৃষ্টি করবে।”
কিন্তু সমালোচকরা বলছেন, হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকরা ভারতকে তার ধর্মনিরপেক্ষ ভিত্তি থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে।
মনে করা হচ্ছে, রাম মন্দির উদ্বোধনের ফলে মোদীর তৃতীয় মেয়াদে নির্বাচনে জয়ের সম্ভাবনা বাড়বে। ভোটারদের কাছে তিনি আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠবেন।
মোদী সরকার মন্দিরটি নির্মাণে সরাসরি অর্থায়ন করেনি। তবুও মোদী ও তার দল এই উদ্বোধনকে ব্যাপকভাবে প্রচার করেছে। একে ঐতিহাসিক জাতীয় অনুষ্ঠানের রূপ দিতে চেষ্টা করেছেন তারা। বিজেপির নেতারা জানিয়েছেন, তাদের মূল সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ মন্দিরের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে অংশ নিতে প্রায় ৫ কোটি পরিবারকে খাবার বিতরণ করেছে।
মন্দির নির্মাণে বিশাল ব্যয়
ভারতীয় প্রকৌশল গ্রুপ লারসেন অ্যান্ড টুব্রো ৭০ একর জমিতে রাম মন্দির বানাচ্ছে। এজন্য প্রায় দেড় হাজার কোটি রুপি ব্যয় হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে মন্দির কমপ্লেক্সটির জন্য ৩ হাজার কোটি রুপি অনুদান পাওয়া গেছে।
তিনজন ভাস্কর রামের মুর্তি তৈরি করেছেন। এর মধ্যে একটি কালো পাথরের মুর্তির ওজন ১৫০-২০০ কেজি। মুর্তিটিতে রামকে পাঁচ বছরের ছেলে হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে।
মুসলমানদের আশঙ্কা
ভারতের ১৪০ কোটি মানুষের মধ্যে মুসলমান প্রায় ২০ কোটি। অযোধ্যা যে রাজ্যে, সেই উত্তর প্রদেশ নির্বাচনী রাজনীতিতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। অযোধ্যার প্রায় ৩০ লাখ মানুষের মধ্যে ৫ লাখ মুসলমান। তাদের অনেকেই মন্দির উদ্বোধনের দিন হামলার আশঙ্কা করছেন।
সোশাল মিডিয়ায় অনেক মুসলিম নিজেদের মধ্যে সতর্কতামূলক বার্তা আদান-প্রদান করছেন। নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজে তারা মুসলমানদের ট্রেন ও বাসে চলাফেরা না করার আহ্বান জানাচ্ছেন।
২০১৯ সালে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বলা হয়েছিল, কর্তৃপক্ষকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে একটি মসজিদ নির্মাণের জন্য জমি বরাদ্দ করতে হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, মসজিদ নির্মাণের কাজ মে মাসের আগে শুরু হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
কয়েকজন মুসলিম আইনপ্রণেতা রাম মন্দির উদ্বোধনের সমালোচনা করেছেন। শত শত বছর আগে তাদের পূর্বপুরুষরা যে বাবরি মসজিদে কোরান পাঠ করতেন, এর ক্ষতি নিয়ে তারা শোক প্রকাশ করেছেন।
অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন পার্টির প্রধান আসাদউদ্দীন ওয়াইসি তার অনুসারীদের উদ্দেশে এই মাসের শুরুতে ভাষণ দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি তরুণদের লক্ষ্য করে বলেছিলেন, “আমরা আমাদের মসজিদ হারিয়েছি, তোমরা দেখছ ওখানে কী হচ্ছে। তোমাদের হৃদয়ে কি বেদনা নেই?”
বিরোধীরা কী বলছে
ভারতের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস রাম মন্দির উদ্বোধন বয়কটের ঘোষণা দিয়েছে। তাদের অভিযোগ, এই অনুষ্ঠানকে বিজেপি রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করছে।
কংগ্রেসের মন্দির উদ্বোধন বয়কট ঘোষণার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বিজেপির মুখপাত্র শুধাংশু ত্রিবেদী। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “এটি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্রতি তাদের ঈর্ষা, বিদ্বেষ ও হীনমন্যতার প্রকাশ। দলটি ‘দেশ’ ও ‘ঈশ্বরের’ বিরোধিতা করছে।”
তথ্যসূত্র : সিএনএন