রোজা শুরু হতে এখনও এক মাসেরও বেশি সময় বাকি। রোজাদারদের জন্য দেশের ফল ব্যবসায়ীরা খেজুর আমদানিও শুরু করেছেন। তবে ডলারের দর বেশি থাকায় খেজুরসহ সব বিদেশি ফল সাধারণ ক্রেতার হাতের নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, এ বছর পেয়ারা, বরই, কলার ভালো ফলন হওয়ায় বাজারে এই ফলগুলো খুবই সহজলভ্য রয়েছে। তাই এবার ইফতারে পাতে রাখতে হবে দেশি ফল।
ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, চাল, ভোজ্যতেল, চিনি, ডাল-ছোলার দাম আগেই বাড়ায় রোজাকে কেন্দ্র করে এসব পণ্যে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে না। সরকারের পক্ষ থেকেও টিসিবির ট্রাক সেলের মাধ্যমে নিয়মিত এসব পণ্য ন্যায্যমূল্যে সরবরাহ কার্যক্রম চলছে। তাই বিদেশি ফল ছাড়া অন্যান্য ইফতারি পণ্যের দাম নিয়ে কোনো অস্থিরতা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা নেই।
শুক্রবার রাজধানীর বেশ কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বিদেশি সব ফলের দাম আকাশ ছোঁয়া। এর মধ্যে কেবল মাল্টার দামই সবচেয়ে কম। ভালো মানের এক কেজি মাল্টা পড়ছে ২৮০-৩০০ টাকা। সবুজ আপেল বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকা কেজি। ঠান্ডাজনিত রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ায় আমদানি করা কমলারও দাম বেড়েছে। চায়না ভালো মানের কমলার কেজি এদিন ছিল ৩৮০ টাকা। ভারতীয় কমলা বিক্রি হয়েছে ২৫০-৩০০ টাকা। তবে দেশি কমলা পাওয়া গেছে ২০০-২২০ টাকায়।
বাজারে এখন অ্যাভোকাডো ১৮০০ টাকা কেজি। অ্যাভোকাডো, ড্রাগন ফল, কিউই, পার্সিমন, আঙ্গুরসহ সব বিদেশি ফলই গত বছরের তুলনায় ২৫-৩০ শতাংশ বা কোনও কোনও ক্ষেত্রে আরও বেশি দামে কিনতে হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন রাজধানীর ফলের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার বাদামতলীর ব্যবসায়ীরা।
তারা বলছেন, রোজাদারদের ইফতারে সবচেয়ে কমন আইটেম থাকে খেজুর। তবে এখন শুধু সৌদি আরব থেকে খেজুর আসে- এমন নয়। অন্যান্য অঞ্চল থেকেও প্রচুর খেজুর আসে। মিশর, জর্ডান, চীন, ভারত থেকেও খেজুর আসে।
ঢাকার মধ্যবিত্ত ক্রেতাদের একটি অংশের পছন্দের খেজুর মরিয়ম। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, মরিয়ম খেজুর খুচরায় ৭০০ থেকে ১০০০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। একটির ওজন হয় গড়ে ১০ গ্রাম। সেই হিসাবে ভালো মানের একটি মরিয়ম খেজুরের দাম ১০ টাকা পড়ে বলে জানান গুলশান ডিসিসিআই মার্কেটের ফল বিক্রেতা আসলাম আকন্দ।
তিনি জানান, প্যাকেটজাত মরিয়ম খেজুর ১২০০-১৪০০ টাকা বা আরও বেশি দামেও বিক্রি হয়, যা মূলত সুপারশপে পাওয়া যায়। মরিয়মের চেয়ে বেশি দাম আজওয়া খেজুরের, যার ক্রেতা মূলত অভিজাত শ্রেণি। এখন এক কেজি খোলা আজওয়ার সর্বনিম্ন দাম ১০০০ টাকা থেকে শুরু। প্যাকেটজাত আজওয়া খেজুর গুনমানের ভিত্তিতে ১৬০০ টাকা পর্যন্ত রয়েছে।
ঢাকার বাদামতলীর ফল ব্যবসায়ী হাজী মো. আমির হোসেন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমরা নিজেরাই ফল আমদানি করি। এবার ডলারের রেট অসম্ভব বেড়ে গেছে। বেশি টাকা লগ্নি করতে হচ্ছে।
“আবার সব ব্যবসায়ী ডলার পাচ্ছে না, ইমপোর্ট করতে পারছে না। এ কারণেও খেজুরের সরবরাহ কম থাকবে। তাই দাম একটু বেশি হবে এবার। এখনই ইজতেমার কারণে খেজুর প্রায় মার্কেট আউট। আবার নতুন খেজুর ঢুকবে। ওইটাই রমজানে পাওয়া যাবে।”
সরকার খেজুর আমদানিতে শুল্ক ছাড় দিচ্ছে; না দিলে খেজুরের দাম সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে বলে মনে করছেন এই ব্যবসায়ী।
আমির হোসেন বলেন, “শুল্ক ছাড় না দিলে তো ৫০০ টাকার নিচে কোনও খেজুরই পাবেন না। আগে ১০০ টাকায় ডলার পাওয়া গেছে। এবার ১২০ টাকায়ও পাচ্ছি না। তাছাড়া বিশ্ববাজারেও সবকিছুর দাম বাড়তি।”
শুক্রবার ঢাকার কারওয়ান বাজারে সর্বনিম্ন ৩০০ টাকা কেজিতে এক ধরনের খেজুর বিক্রি করতে দেখা যায়। তবে অন্যান্য খেজুরের দাম শুরুই হয়েছে ৫০০ টাকায়। অর্থাৎ ভালো মানের এক কেজি খেজুর কিনতে লাগছে ৫০০ টাকার বেশি।
তবে সর্বনিম্ন দাম ৩০০ টাকায় যে খেজুর পাওয়া যাচ্ছে তা খাওয়ার উপযুক্ত কিনা- তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে ক্রেতাদের।
ঢাকার লালমাটিয়ার আরিফুল ইসলাম একটি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ফার্ম পরিচালনা করেন। কারওয়ান বাজারে খেজুর কিনতে এসেছিলেন তিনি।
৩০০ টাকা কেজির ওই খেজুর দেখিয়ে আরিফুল সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এটা তো দেখলেই বোঝা যায় খাওয়ার উপযোগী না। যে সব ক্রেতা পণ্য সম্পর্কে সচেতন, যাদের সামর্থ্য আছে তারা এই খেজুর কিনবে না। এগুলো তো এখনই দেখা যাচ্ছে গলে যাচ্ছে।”
নিজেকে সচেতন ক্রেতা দাবি করে আরিফুল বলেন, “এই মুহূর্তে বাজারে প্রচুর কুল বরইয়ের সরবরাহ দেখা যাচ্ছে। দামও অন্যান্য ফল থেকে কিছুটা কম। পেয়ারাও এখন ৫০-৬০ টাকা কেজি। তাছাড়া রোজার শেষ দিকে আম, তরমুজ উঠতে শুরু করবে। তাই বেশি পয়সা দিয়ে বিদেশি ফল না খেয়ে, দেশি ফল পছন্দের তালিকায় রাখব।”
ঠান্ডায় কলার দামও কিছুটা হাতের নাগালেই রয়েছে। ভালো মানের দেশি চাম্পা কলা ৬০ টাকা ডজন বিক্রি হচ্ছে। নেপালি সাগর কলা ১২০ টাকা ডজন বিক্রি হচ্ছে। গত বেশ কিছুকাল ধরেই কলার দাম একইরকম রয়েছে।
ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, শসা, গাজর ও টমোটোর সরবরাহও ভালো রয়েছে বাজারে; রোজায়ও থাকবে।
অন্যবার টমেটোর ভরা মৌসুমে দাম প্রতিকেজি ২০ টাকায় নেমে আসলেও এবার ৫০-৬০ টাকার মধ্যে ওঠানামা করছে। ইজতেমাকে কেন্দ্র করে দেশি পেঁয়াজের দাম ১০০ টাকায় উঠেছে। সপ্তাহখানেক আগেও ৮০-৯০ টাকা কেজি বিক্রি হয় এই পেঁয়াজ। শসা মিলছে ৫০-৬০ টাকায়। দেশি গাজর পাওয়া যাচ্ছে ৪০-৫০ টাকায়; আমদানি করা গাজর ৮০-১০০ টাকা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিশ্ব এজতেমাকে কেন্দ্র করে আরও কিছু নিত্যপণ্যের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়েছে ঢাকায়। ফলে বাজারে এগুলোর দাম কিছুটা বাড়তে দেখা গেছে। এক সপ্তাহ আগে এক ডজন ডিম বিক্রি হয়েছে ১২৫-১৩০ টাকা। শুক্রবার এক ডজন ডিম কিনতে হয়েছে ১৪০-১৪৫ টাকায়।
বাজার ঘুরে কাঁচামরিচের দামও কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী পাওয়া গেছে। বাজারভেদে কাঁচামরিচ বিক্রি হয়েছে ১২০-১৪০ টাকা কেজি।
রমজানে খেজুরের পাশাপাশি চাল, ভোজ্যতেল, চিনির আমদানি শুল্ক কমানোরও নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাতে পণ্যগুলোর দাম আর বাড়ার আশঙ্কা করছেন না ব্যবসায়ীরা।
বাজারে বর্তমানে মোটা চাল (পাইজাম) পাওয়া যাচ্ছে ৫৪-৬০ টাকা কেজিতে। গত একবছর ধরেই এই দাম দেখা যাচ্ছে। এর আগে এই চালের সর্বনিম্ন দাম ছিল ৪৮-৫২ টাকা। সরু নাজিরশাইল চাল বিক্রি হচ্ছে ৭৮-৮৮ টাকার মধ্যে।
ভোজ্যতেলের দামেও গত একমাসে কোনো পার্থক্য দেখা যায়নি। বর্তমানে প্রতিলিটার বোতলজাত ভোজ্যতেল (সয়াবিন তেল) পড়ছে ১৭০ থেকে ১৭৫ টাকা। খোলা সয়াবিন লিটার পড়ছে ১৬৫ টাকা।
সাদা চিনি ১৫০-১৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। প্রায় এক বছরেরও বেশি সময় ধরে এই দামে চিনি বিক্রি হচ্ছে। নতুন করে চিনির দাম বৃদ্ধির কোনো আশঙ্কা করছেন না ব্যবসায়ীরা।
দেশের অন্যতম ভোগ্যপণ্যের ব্র্যান্ড তীরের পণ্য বাজারজাত করে সিটি গ্রুপ। এই গ্রুপের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “চাল, চিনি ও তেলের ক্ষেত্রে রোজায় বড় ধরনের কোনো সংকট হবে না।”
ডালের দামও স্বাভাবিক থাকবে বলে আশা করছেন তিনি।