পার্বত্যাঞ্চলে পাহাড়িদের দুই সংগঠন জেএসএস আর ইউপিডিএফের বিরোধ প্রায় তিন দশকের; রাজনীতির মাঠে তাদের বিরোধ অনেক রক্তও ঝরিয়েছে। কিন্তু উপজেলা নির্বাচনে এসে তাদের বিরল ঐক্য দেখা যাচ্ছে।
রাঙ্গামাটির বিভিন্ন উপজেলায় নির্বাচন ঘিরে এমন ঐক্যকে কৌশলগত বলছেন আঞ্চলিক দল দুটির স্থানীয় নেতারা।
১৯৯৭ সালে সরকারের সঙ্গে জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) শান্তি চুক্তি সইয়ের পর তার বিরোধিতা করে প্রসিত বিকাশ খিসার নেতৃত্বে গড়ে ওঠে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিফিএফ)।
পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অবিসংবাদিত নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার (এম এন লারমা) গড়ে তোলা জেএসএস ভেঙে দুটি দল হওয়ার পর তাদের হানাহানি চলতে থাকে।
গত এক দশকে ওই দুই দলেও দেখা দেয় ভাঙন। জেএসএস থেকে আলাদা হয়ে নতুন দল হয় জনসংহতি সমিতি (এমএন লারমা); যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন এখন বিমল কান্তি চাকমা। অন্যদিকে ইউপিডিএফ থেকে একটি অংশ বেরিয়ে গঠন করে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক), তাদের নেতা এখন শ্যামল চাকমা।
পাহাড়ে এখন এই চারটি দলই সক্রিয়। উপজেলা পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তারা দৃশ্যত দুই ভাগে রয়েছে। একদিকে রয়েছে পুরনো দুটি দল জেএসএস ও ইউপিডিএফ। অন্যদিকে রয়েছে নতুন দুটি দল ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) ও জেএসএস (এম এন লারমা)।
ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন চলছে দেশজুড়েই। প্রায় ৫০০ উপজেলায় কয়েক ধাপে ভোটগ্রহণ হচ্ছে। গত ৮ মে প্রথম ধাপে ভোট হয়। দ্বিতীয় ধাপে ২১ মে ভোটগ্রহণের পর ২৯ মে হবে তৃতীয় ধাপের ভোট।
উপজেলা পরিষদ নির্বাচন দলীয় প্রতীকে হলেও এবার বিএনপি বর্জন করায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে অংশ নিচ্ছে না। প্রতিটি উপজেলায় দলটির একাধিক নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে লড়ছেন। পার্বত্যাঞ্চলে তাদের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে আঞ্চলিক দলগুলোর নেতারা।
কোন উপজেলায় কেমন ঐক্য
রাঙ্গামাটি জেলা মোট উপজেলা ১০টি। সদর উপজেলা বাদে বাকিগুলো হলো- বরকল, জুরাছড়ি, কাউখালী, কাপ্তাই, বাঘাইছড়ি, বিলাইছড়ি, রাজস্থলী, নানিয়ারচর ও লংগদু।
প্রথম ধাপে রাঙামাটি সদর, বরকল, জুরাছড়ি ও কাউখালীতে ভোট হয়েছিল। রাঙামাটি সদর, জুরাছড়ি ও বরকলে প্রার্থী দিয়েছিল সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএস। সদর উপজেলার সাপছড়ি, কুতুকছড়ি ও বন্দুকভাঙা ইউনিয়ন ইউপিডিএফের নিয়ন্ত্রিত এলাকা হিসাবে পরিচিত।
ইউপিডিএফের সমর্থনে সদর ও বরকলে জেএসএস সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছে। জুরাছড়ি ও কাউখালীতে বিজয়ী হয়েছে আওয়ামী লীগ সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থীরা।
দ্বিতীয় ধাপের ভোটে কেবল বিলাইছড়িতে চেয়ারম্যান পদে বীরোত্তম তঞ্চঙ্গ্যাকে (দোয়াত কলম) সমর্থন দিয়েছে জেএসএস। এই উপজেলায় উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অভিলাষ তঞ্চঙ্গ্যা প্রার্থী হয়েছেন আনারস প্রতীকে।
কাপ্তাই ও রাজস্থলীতে আঞ্চলিক দলের কোনও প্রার্থী নেই। রাজস্থলীতে চেয়ারম্যান পদে আনারস প্রতীকে লড়ছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি উবাচ মারমা এবং দোয়াত কলম প্রতীকে লড়ছেন স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা রিয়াজ উদ্দিন রানা।
কাপ্তাই উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী তিনজন। এরমধ্যে আনোয়ারুল ইসলাম চৌধুরী (বেবী) আনারস প্রতীক, মো. নাছির উদ্দিন দোয়াত কলম প্রতীক এবং সুব্রত বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা ঘোড়া প্রতীকে লড়ছেন।
তারা তিনজনই আওয়ামী লীগে যুক্ত। এরমধ্যে বেবী উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি, নাছির উদ্দিন উপজেলা যুবলীগের সভাপতি ও সুব্রত বিকাশ উপজেলা কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক।
তৃতীয় ধাপে আগামী ২৯ মে বাঘাইছড়ি, নানিয়ারচর ও লংগদু উপজেলায় ভোটগ্রহণ হবে।
আয়তনে দেশের সবচেয়ে বড় উপজেলা বাঘাইছড়িতে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছেন দুজন। তারা হলেন ঘোড়া প্রতীকের প্রার্থী বর্তমান চেয়ারম্যান সুদর্শন চাকমা এবং আনারস প্রতীকের প্রার্থী বাঘাইছড়ি ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান অলিভ চাকমা। সুদর্শন জেএসএসের (এম এন লারমা) কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদক। অলিভ চাকমা জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহ সভাপতি।
এই উপজেলায় আঞ্চলিক রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশও বৈচিত্র্যময়। জেএসএসের (এম এন লারমা) প্রার্থী হলেও স্থানীয় আওয়ামী লীগের বড় অংশের সমর্থন পাচ্ছেন সুদর্শন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের হলেও ইউপিডিএফ-জেএসএসের সমর্থন পাচ্ছেন অলিভ।
নানিয়ারচরে চেয়ারম্যান পদে লড়ছেন চারজন। তারা হলেন- বর্তমান চেয়ারম্যান প্রগতি চাকমা (কাপ-পিরিচ), রুপম দেওয়ান (দোয়াত-কলম), জ্যোতিলাল চাকমা (মোটর সাইকেল) ও অমর জীবন চাকমা (আনারস)।
প্রগতি চাকমা জেএসএসের (এম এন লারমা) রাঙ্গামাটি জেলা কমিটির সাবেক সহ-সভাপতি, রুপম দেওয়ান বর্তমান উপজেলা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক। জ্যেতিলাল চাকমা নানিয়ারচর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান ও অমর জীবন চাকমা ঘিলাছড়ি ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান।
তাদের মধ্যে জ্যোতিলাল ও অমর জীবন দুজনই ইউপিডিএফে যুক্ত। প্রগতি চাকমার সঙ্গে ভোটের লড়াইয়ে নেমে জেএসএসের (এম এন লারমা) সমর্থন পাননি রূপম।
লংগদু উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে বর্তমান উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল বারেক সরকার (ঘোড়া), বাবুল দাশ বাবু (আনারস), বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী (দোয়াত-কলম) এবং সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আবছার আলী (মোটর সাইকেল) লড়ছেন।
তাদের মধ্যে বারেক সরকার লংগদু উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি। বাবুল দাশ বর্তমান সাধারণ সম্পাদক। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বর্তমান সহ সভাপতি। আবছার আলী এক সময় রাঙামাটি জেলায় বাঙালিভিত্তিক সংগঠন ‘সম-অধিকার আন্দোলন’ এ যুক্ত ছিলেন।
লংগদুতে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বাবুল দাশকে সমর্থন দিয়েছে জেএসএস (এম এন লারমা)। তবে উপজেলায় শক্ত অবস্থানে থাকা জেএসএসের ভোট কার ঝুলিতে যাবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়।
ভোটে ঐক্য নিয়ে কী বলছেন নেতারা
ইউপিডিএফের মুখপাত্র অংগ্য মারমা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, জেএসএসের সঙ্গে তাদের নীতিগত বিরোধ থাকলেও উপজেলা নির্বাচন নিয়ে তারা কৌশলী অবস্থান নিয়েছেন।
“পাহাড়ের নির্বাচনগুলোতে পার্টির অবস্থান থাকে। এবারও কৌশলগত অবস্থান নিয়েছে পার্টি। আমরা বিভিন্ন উপজেলায় জেএসএসের সমর্থিত প্রার্থীকেও সমর্থন দিয়েছি।”
“তার মানে এই নয় যে আমরা জেএসএসকে পুরোপুরি সমর্থন দিয়েছি। আমাদের রাজনৈতিক অবস্থান ও মতাদর্শিক বিরোধ আগের মতো রয়েছে। জাতীয় স্বার্থে বা বৃহত্তর ঐক্যের স্বার্থে পার্টি কৌশলগত অবস্থান নিয়েছে। যাতে পাহাড়ে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতসহ অন্যান্য সমস্যাবলির সমাধান আসে,” যোগ করেন তিনি।
এদিকে শনিবারই লংগদুতে ইউপিডিএফের দুই কর্মীকে গুলিতে নিহত হওয়ার পর দলটি জেএসএসকে দায়ী করেছে। তবে জেএসএস সেই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
ভোট ধরে রাজনৈতিক ঐক্য নিয়ে জেএসএসের একাধিক নেতার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। দলটির মুখপাত্র ও কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি সাবেক সংসদ সদস্য ঊষাতন তালুকদারের মোবাইল ফোনটি বন্ধ পাওয়া গেছে।
জেএসএসের (এম এন লারমা) রাঙামাটি জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক জুপিটার চাকমার কথায়ও পাওয়া গেল কৌশলগত ঐক্যের সুর।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বাঘাইছড়িতে উপজেলায় আমাদের দলের সমর্থিত প্রার্থী সুদর্শন চাকমা। লংগদুতে আমাদের দলের সমর্থন দেওয়া হয়েছে বাবুল দাশ বাবুকে (উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক)।”
নানিয়ারচরে দুজন প্রার্থী হওয়ার বিষয়ে জুপিটার বলেন, সেখানে তারা কাকে সমর্থন দেবেন, ‘কৌশলগত কারণে’ আপাতত জানাতে চান না।
ইউপিডিএফের (গণতান্ত্রিক) কেন্দ্রীয় সভাপতি শ্যামল চাকমা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, তাদের কোনও প্রার্থী উপজেলা নির্বাচনে না থাকলেও বাঘাইছড়িতে জেএসএসের (এন এম লারমা) নেতা সুদর্শন চাকমাকে সমর্থন দিচ্ছেন তারা।
অন্য উপজেলাগুলোর বিষয়ে তিনি বলেন, “নানিয়ারচর ও লংগদুতে সাধারণ জনগণ যাকে বেছে নেবেন, যার বেশি জনপ্রিয়তা রয়েছে; কৌশলগত বিষয় বিবেচনা করেই আমরা সমর্থন জানাব।”
উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে দলীয়ভাবে কাউকে সমর্থন দেওয়া হচ্ছে না বলে জানালেন রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. মুছা মাতব্বর।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “নেত্রীর (শেখ হাসিনা) সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। নেত্রী বলেছেন, যার যত জনপ্রিয়তা আছে, তা যাচাই করে দেখতে।
“যেখানে আমাদের দলের একক কোনও প্রার্থী নেই; সেখানে আলাদা করে কাউকে সমর্থন দেওয়ার তো কথা আসে না। যে যার মতো করে ভোট করছেন।”
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক একক সমর্থন দেওয়ার বিষয়টি খারিজ করে দিলেও দলীয় সূত্রগুলো জানায়, উপজেলা পরিষদ নির্বাচন শুরুর আগে জেলা আওয়ামী লীগ ১০ উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে একক প্রার্থী ঠিক করতে বৈঠক করেছিল।
ওই বৈঠক থেকে চেয়ারম্যান পদে একজন করে প্রার্থীর বিষয়ে জোর তাগিদ দেওয়া হয়েছিল। তবে সদর, জুরাছড়ি, কাপ্তাই, রাজস্থলী, লংগদুতে একাধিক প্রার্থী হয়েছে।
তবে এমন বৈঠকের কথা অস্বীকার করেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুছা মাতবর।
স্মৃতিতে বিভীষিকার দিন
২০১৯ সালের ১৮ মার্চ (সোমবার) পঞ্চম উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ইউনিয়নের কংলাক, মাচালং ও বাঘাইহাট কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ শেষে ব্যালেট পেপার, সরঞ্জাম নিয়ে ফেরার পথে নির্বাচনী ও নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ার ঘটনা ঘটেছিল। তাতে মোট আটজনের মৃত্যু হয়।
সেই হামলার ঘটনায় পাহাড়ের তিনটি আঞ্চলিক দলটি তখন একে-অন্যকে দোষারোপ করেছিল।
এবারও বাঘাইছড়িতে আঞ্চলিক দলগুলোর বিরোধে সহিংসতার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। কারণ সম্প্রতি বাঘাইছড়ির বঙ্গলতলী ইউনিয়নে দুই দলের মধ্যে পাল্টাপাল্টি গুলিবর্ষণের খবর পাওয়া গেছে।
নির্বাচনের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রাঙামাটির পুলিশ সুপার মীর আবু তৌহিদ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “প্রথম ধাপে রাঙামাটির চারটি উপজেলায় অত্যন্ত নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট গ্রহণ হয়েছে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপের ভোটেও যেন এমন পরিবেশ বজায় থাকে, সেজন্য আমরা বিভিন্ন উপজেলায় যাচ্ছি।
“নির্বাচন সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলছি। আমরা আশা করছি এবারের ভোটে আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যথেষ্ট সজাগ-সচেতন রয়েছে, যাতে কোনোভাবেই শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিঘ্নিত না হয়। গোয়েন্দা তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।”