আনোয়ারা ইসলাম রানী, একজন রূপান্তরিত নারী। আনোয়ারুল ইসলাম রানা থেকে আনোয়ারা, এখন তিনি রানী। ৩১ বছরের তৃতীয় লিঙ্গের এই নারী এখন সবার কাছে পরিচিত।
আর একদিন পরই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। রংপুর-৩ সংসদীয় আসন থেকে ভোটে দাঁড়িয়েছেন তিনি। রানীর প্রতিপক্ষ জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের। এ আসনে কোনও প্রার্থী দেয়নি আওয়ামী লীগ। স্বতন্ত্র প্রার্থী রানীর মার্কা ঈগল। তৃতীয় লিঙ্গের প্রার্থী হিসেবে ভোটারদের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলেছেন। আসনটিতে ৬ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, তবে আলোচনার কেন্দ্রে এখন রানীই।
রংপুর সিটির ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের নূরপুর এলাকায় থাকেন তিনি। শিক্ষার্থী ছিলেন রংপুর পৌর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের। এরপর রংপুর টেকনিক্যাল স্কুল থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করেন।
কেন ভোটে দাঁড়িয়েছেন রানী? তার স্পষ্ট উত্তর- “জনগণের সেবা করতে চাই। তাই এবারের নির্বাচনে রংপুর-৩ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে লড়ছি।”
গত ১৮ ডিসেম্বর নির্বাচনী প্রতীক নিশ্চিত হওয়ার পরই এলাকায় প্রচারে নামেন রানী। তৃতীয় লিঙ্গের কর্মীরাতো আছেই, পাশে দাঁড়িয়েছেন অন্যরাও। এরই মধ্যে ব্যাপক গণসংযোগ করেছেন, সাড়াও মিলেছে, জানান রানী।
দীর্ঘদিন ধরে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের নিয়ে কাজ করছেন রানী। রংপুরে তাদের জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত সংগঠন ‘ন্যায় অধিকার ট্রান্সজেন্ডার উন্নয়ন সংস্থার’ সভাপতি তিনি। ‘রূপান্তর’ নামে একটি হস্তজাত শিল্পেরও উদ্যোক্তা। ২৪ জন তৃতীয় লিঙ্গের নারী সেখানে কাজ করছেন।
তৃতীয় লিঙ্গের নারীদের জন্য কাজ করতে করতে হঠাৎ কেন সংসদ সদস্য হওয়ার আকাঙ্ক্ষা জাগলো, এই প্রশ্নের জবাবে সকাল সন্ধ্যাকে রানী বলেন, “আমার কোনও পিছুটান নেই। স্বামী-সন্তান নেই। লোভও নেই। আমি সবার জন্য কাজ করবো। সংসদে সাড়ে তিনশ এমপির মধ্যে আমি যদি একজন হতে পারি, তাহলে রংপুরের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মানুষদের নিয়ে কথা বলতে পারবো।”
রংপুরবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে রানী বলেন, “আপনারা আর ঘুমিয়ে থাকবেন না। এবার জাগুন। চোখ খুলুন। চারপাশ তাকিয়ে দেখুন। নিজেদের কল্যাণের কথা চিন্তা করে আমাকে ভোট দিন। আমাকে আপনাদের সেবা করার সুযোগ দিন।”
রংপুরে এই প্রথম কোনও তৃতীয় লিঙ্গের নারী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন। এ কারণে তাকে ঘিরে রংপুরবাসীদের কৌতূহলের শেষ নেই। রানী এরই মধ্যে মানুষের মধ্যে সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়েছেন। সংসদ নির্বাচনে তার অংশগ্রহণকে কেউ কেউ রাজনীতির মাঠে নতুন অধ্যায়ের সূচনা বলে মনে করছেন।
রংপুর সিটি কর্পোরেশনের কামারপাড়া এলাকার বাসিন্দা সোহেল। তিনি বলেন, “আনোয়ারা ইসলাম রানী তৃতীয় লিঙ্গের এটা বড় কথা নয়। তিনি একজন মানুষ, এটাই তার প্রকৃত পরিচয়।
রানী মানুষের সেবা করার জন্য নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন, এটা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। এজন্য আমরা খুশি। আশা করি, কামারপাড়ার মানুষ তাকে ভোট দেবে। ”
কামারপাড়া এলাকার আরেক বাসিন্দা কামরুল হোসেন বলেন, “আমরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে রানী আপাকে ভোট দিতে যাব। তাকে ভোট দিয়ে জয়ী করব। আমরা লাঙ্গলকে বুঝিয়ে দেব, রংপুরের মানুষ আর বোকা না। যুগ যুগ ধরে এখানকার মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে। এটি আর হতে দেওয়া যাবে না। আমরা লাঙ্গলকে বিতাড়িত করবোই করবো। আপামর জনতার উন্নয়নের জন্য আমরা রানী আপাকে ভোট দিয়ে সংসদে বসাব।”
রানীর নির্বাচনে দাঁড়ানো নিয়ে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং বিভাগের শিক্ষক ওমর ফারুক বলেন, “রানী মূলত জিতে গেছেন। একজন হিজড়া বা ট্রান্সজেন্ডার সমাজে নানা ধরনের বাধার সম্মুখীন হন। এসব বাধা পেরিয়ে তাকে এগিয়ে যেতে হয়। রানী নিজের ও সম্প্রদায়ের উন্নয়নচেষ্টার পাশাপাশি আপামর জনসাধারণের উন্নয়ন নিয়ে ভাবছেন। এটি চাট্টিখানি কথা নয়। রংপুরে জাতীয় পার্টির বিপক্ষে জনসমর্থন তৈরি করা বিশাল ব্যাপার। সেক্ষেত্রে তাকে জয়ী বলা যেতেই পারে।”
রানীকে রংপুরের একাংশের মানুষ সমর্থন জানালেও ট্রান্সজেন্ডারদের প্রতি নেতিবাচক মনোভাবের কারণে অনেকে আবার তাকে প্রার্থী হিসেবে গ্রহণ করতে রাজি নন।
অনেকের মনে প্রশ্ন, রানীর অর্থের উৎস কী? নির্বাচনের ব্যয় তিনি মেটাচ্ছেন কীভাবে?
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রানীর সমর্থকরা নিজেরাই রংপুরের নানা জায়গা থেকে টাকা তুলে ভোটের ব্যয় সংস্থান করছেন।
রংপুরবাসীর মিশ্র প্রতিক্রিয়ার মধ্যেই রানী যে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, এটিকে মোটাদাগে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন বেশিরভাগ মানুষ।