কোভিডের সাথে অনেক যুদ্ধ করেও শেষে হার মেনেছিলেন শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। তবলার এরকম শিল্পী আর কি হবে? ২০২১ সালে তাঁর চলে যাওয়ার কষ্টই নিতে পারিনি। এরমধ্যে রশিদ ভাইও চলে গেলেন। ওরা দুজন প্রায় সমবয়সী, খুব ভালো বন্ধু ছিলেন। রশিদ ভাইর গান আন শুভঙ্কর দাদার তবলা বাদন— দুজন একসঙ্গে বহু আসর মাতিয়েছেন। খুব ভালো জুটি ছিল ওদের।
রশিদ খানকে প্রথম দেখি সম্ভবত ১৯৯৬ সালে। নৃত্য গবেষক ও নৃত্যশিল্পী লুবনা মরিয়মের বাড়িতে। ওখানে প্রায়ই বড় শিল্পীদের আসর বসত। কাছাকাছি সময় ঢাকার ভারতীয় দূতাবাসে রশিদ খানের গান শোনার সুযোগ হয়েছিল। সেখানে সবাই একবোরে মন্ত্রমুগ্ধ! রশিদ খান বাংলাদেশে হয়ত আরও কয়েকবার এসেছিলেন। তবে এই দুটো আসরই আমার মনে বেশি দাগ কেটেছিল।
ঢাকায় শাস্ত্রীয়সংগীত উৎসব আয়োজনের চেষ্টায় ২০১১ সালে কলকাতার আইটিসি সংগীত রিসার্চ একাডেমি’র (এসআরএ) সম্মানিত গুরু উলহাস কাশালকার, অজয় চক্রবর্তী, গিরিজা দেবী প্রমুখের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ দৃঢ় হয়। তখন রশিদ ভাই সংগীত রিসার্চ একাডেমি থেকে বেরিয়ে গেলেও, আসা-যাওয়া ছিল। এসআরএ’র ওস্তাদ মশকুর আলী খান সাহেব আগেরই পরিচিত, যেহেতু ২০০০ সালে তাঁর হাতে ঢাকায় বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের শাস্ত্রীয়সংগীত কর্মশালার যাত্রা শুরু হয়।
বাংলাদেশের মাটির প্রতি শাস্ত্রীয়সংগীত শিল্পীদের একটা দায় আছে। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের জন্ম এখানে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার শিবপুর গ্রামে। ভারতীয় উপমাহদেশে শাস্ত্রীয়সংগীতে তাঁর অবদান কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। আরও অনেকে আছেন যাদের শিকড় পূর্ব বাংলায়। এসব সম্পর্কের জোরে গুণীরা বাংলাদেশের আমন্ত্রণকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে থাকেন। বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব আয়োজনের পরিসর ও ব্যপ্তি এবং দর্শক সমাগম দেখে শিল্পীরা সবাই খুশী হতেন।
২০১৪ ছাড়া প্রতিবারই ওস্তাদ রশিদ খানকে আমরা বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সংগীত উৎসবে পেয়েছি। ওই বছর সময় মেলাতে না পারায় তিনি ঢাকায় আসতে পারেননি। রশিদ খানের লাইভ পরিবেশনা ঢাকার দর্শকের খুব প্রিয় ছিল। মনে পড়ে উত্তরায় বসবাসকারী কোনো এক দম্পতি প্রতিবার খোঁজ নিতেন, এবার রশিদ ভাই আসছেন তো? উনি না আসলে কিন্তু সব আয়োজন ম্লান হয়ে যাবে। আমরা কাছ থেকে ওঁর গান শোনার জন্যই বেঙ্গলের উৎসবে যাই।
২০১৭ সালের কথা। আবাহনী মাঠে তীব্র শীতের মধ্যে রশিদ খান কর্ণাটকী শিবরঞ্জনী এবং হিন্দুস্থানী মধুবন্তী রাগের মিশ্র রূপ ‘প্রিয়রঞ্জিনী’ পরিবেশন করেছিলেন। দুটোই রোমান্টিক রাগ, তবে ভিন্ন স্বাদের। রশিদ ভাইর দরদী কণ্ঠে সে এক দারুণ অভিজ্ঞতা। খুব দক্ষ না হলে এভাবে মিশিয়ে গাওয়া যায় না।
প্রথম বছর ২০১২ সালে ওস্তাদ রশিদ খানের একটা সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন নজরুল সংগীত শিল্পী ও শিক্ষক সাদিয়া আফরিন মল্লিক। সেবার তিনি বলেছিলেন, আমরা তো পৃথিবীর নানা জায়গায় গান করি তবে কেন যেন বাংলাদেশে আসলে আমার গানটা আরও ভালো হয়।
এখন যে উচ্চাঙ্গসংগীত সম্মেলন হচ্ছে না তা নিয়ে অনেকেই আশাহত। কারও সাথে দেখা হলেই আমাকে এই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। তবে আশা তো রাখি নিশ্চয়ই আবার আসর বসবে। রশিদ ভাইসহ আরও অনেকে ইতিমধ্যে গত হয়েছেন। তাঁদের ছাড়া কি আয়োজনে আগের মত জৌলুস হবে? জানি না…।
উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের সুবাদে রশিদ ভাই এবং ওঁর পরিবারের সঙ্গে একটা হৃদ্যতা গড়ে উঠেছিল। কলকাতায় গেলে ওঁদের সঙ্গে দেখা হতো। সুন্দর একটা পরিবার। সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল, বাড়িতে গেলে রশিদ ভাই নিজে রান্না করে খাওয়াবেন। খাবার ঘরে বসে শোনা যেত রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা তাঁর কণ্ঠে অনায়াস পাল্টা বা তান। রশিদ ভাইর হাতের বাহারি বিরিয়ানি আর শামি কাবাবের স্বাদ ভোলার নয়। ২০১৩ সালে তিনি আগরতলা নিয়ে গেলেন তাঁর মা’র নামে গড়ে তোলা শাকরি বেগম মেমোরিয়াল ট্রাস্ট পরিচালিত ‘সংগীতগ্রাম’ প্রকল্প দেখাতে।
মানুষ হিসেবে রশিদ খান অত্যন্ত সরল ও বন্ধুবৎসল ছিলেন। গানবাজনা নিয়েই ছিল তাঁর সমস্ত ধ্যানধারণা। ঢাকায় বসে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন যে মঞ্চে উঠে আমি সৃষ্টিকর্তার ওপর সব ছেড়ে দিই। তিনি যেভাবে গাওয়াবেন আমি সেভাবে গাইব। বহু সাধনায় এমন একজন গায়ক তৈরি হয়! কঠোর রেয়াজ করে গানবাজনায় নৈপুণ্য অর্জন করা গেলেও, সুরুচির যে স্বাদু পরিমার্জন রশিদ ভাইর গানে পাওয়া যায়, তা সত্যিই বিরল।
রশিদ খান রবীন্দ্রনাথের কয়েকখানা গান রেকর্ড করেছিলেন। আদতে বাঙালি না হওয়ায় উচ্চারণে সামান্য তারতম্য হলেও, গানগুলি তিনি দরদ দিয়েই গেয়েছিলেন। ওঁর খুব ইচ্ছা ছিল নজরুলের গান রেকর্ড করার। আমাদের দেশে যেহেতু নজরুলের শুদ্ধ সুর নিয়ে কাজ হচ্ছে তাই বলেছিলাম গানগুলো বাংলাদেশের কোনও শিল্পীর কাছ থেকে তুলে নিলে ভালো হয়। এই আলাপটা খুব বেশি আগের নয়, হয়ত ২০২২ সাল হবে। দুঃখের বিষয় যে কাজটা আর এগোয়নি। এখন আফসোস হচ্ছে তার কণ্ঠে নজরুলের গান আর শোনা হবে না।
নানা সংকটরে মধ্যে জীবন পার করলেও রশিদ খান কখনও গান ছেড়ে যাননি। সংগীত-মেধায় অতি উজ্জ্বল এই মানুষটি গানে লীন ছিলেন। রবীন্দ্রসংগীত বিশারদ ওয়াহিদুল হককে বলতে শুনেছি যে গান আর সংগীতের মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে। গান গাওয়া যায়। কিন্তু তা সংগীত হয়ে উঠবে কি না, বলা মুশকিল। রশিদ খান যা গাইতেন তা-ই সংগীত হয়ে উঠত।
লেখক: স্থপতি এবং বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক।