Beta
বুধবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০২৪
Beta
বুধবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০২৪

রতন টাটা : বৈভব মাঝে নির্মল একজন   

রতন টাটা
রতন টাটা
[publishpress_authors_box]

রতন টাটা। ভারতের জনমানসে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয় এই নামটি দেশের দুর্নীতিগ্রস্ত পরিস্থিতিতেও নির্মল ও অকলঙ্কিত রয়ে গেছে। তাই তো দেশটির প্রায় ১৪৫ কোটি জনগণের কাছে এই নামটি অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয়।

১৯৩৭ সালে মুম্বাইয়ে জন্ম নেওয়া রতন টাটা বুধবার ওই শহরেরই ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর।

ভারতের অন্যতম বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠান টাটা গ্রুপের ইমেরিটাস চেয়ারম্যান রতন টাটার মৃত্যুর খবর টাটা গ্রুপ এক বিবৃতিতে নিশ্চিত করেছে।

এই শিল্পপতি শতাধিক কোম্পানি নিয়ে গঠিত টাটা গ্রুপকে দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে নেতৃত্ব দিয়েছেন। প্রতিষ্ঠানটি ‘লবন থেকে সফটওয়্যার’ পর্যন্ত বিস্তৃত ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যের জন্য পরিচিত। এই গোষ্ঠীর বার্ষিক আয় একশ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি।

টাটা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা হলেন ভারতীয় শিল্প জগতের অগ্রদূত ব্যক্তিত্ব জামশেদজি টাটা। ১৫৫ বছরের পুরনো এই প্রতিষ্ঠানের অধীনে জাগুয়ার ল্যান্ড রোভার ও টাটা স্টিল থেকে শুরু করে বিমান চলাচল পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যবসা রয়েছে।

লেখক পিটার কেসি তার ‘দ্য স্টোরি অফ টাটা’ বইয়ে লিখেছেন, “টাটা গ্রুপের মূল মূল্যবোধ হলো ব্যবসায়িক সফলতাকে মানবসেবার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া।

“গ্রুপের হোল্ডিং কোম্পানি টাটা সন্সের অধীনে বেশ কিছু কোম্পানি রয়েছে। এর মধ্যে ব্যক্তিমালিকানাধীন ও কিছু জনগণের কাছে শেয়ার বিক্রয়যোগ্য কোম্পানিও আছে। তবে এসব কোম্পানির মালিকানা একটি দাতব্য ট্রাস্টের হাতেই সমর্পিত।”

রতন টাটা মূলত ভারতে আশ্রয় নেওয়া জরথুস্ত্রীয় মতবাদে বিশ্বাসী এক পার্সি পরিবারের সন্তান। শিক্ষিত ও সম্পদশালী এই সম্প্রদায়ে বেড়ে ওঠা রতন টাটার বাবা-মায়ের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে ১৯৪০ এর দশকে। তখন ১০ বছর বয়সী রতন টাটার দায়িত্ব নেন তারই নানি নবজবাই টাটা। মূলত নানির কাছেই তার জীবনের নৈতিক শিক্ষার ভিত্তি গড়ে ওঠে। এনিয়ে রতন টাটা পরবর্তী জীবনে অনেক স্মৃতিচারণও করেন।

মুম্বাই ও শিমলায় স্কুলশিক্ষা শেষে যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে গিয়েছিলেন রতন টাটা। নিউ ইয়র্কের কর্নেল ইউনিভার্সিটি থেকে তিনি ১৭ বছর বয়সে ১৯৬২ সালে স্থাপত্যে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। কর্মজীবনে প্রবেশ করে কয়েকবছর পর ১৯৭৫ সালে তিনি হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলে অ্যাডভান্স ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রামে ভর্তি হন।

যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষাজীবনের পাশাপাশি তিনি গাড়ি ও বিমান চালানোও শিখেছিলেন। এসময় তাকে কিছু ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল।

তিনি নিজেই সেই অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে জানিয়েছিলেন, “একবার কলেজে হেলিকপ্টার চালানোর সময় ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আমাকে গ্লাইড করে নামতে হয়েছিল।”

পরবর্তী জীবনে তাকে বহুবার তারই কোম্পানির ব্যবসায়িক জেট বিমান চালাতেও দেখা যায়।

১৯৬২ সালে তার নানি নবজবাই অসুস্থ হয়ে তাকে ডাকলে রতন ভারতে ফেরেন। এরপর পরিবারের অন্যতম সদস্য জেআরডি টাটা তাকে টাটা গ্রুপে যোগ দিতে বলেন। এ সম্পর্কে এক সাংবাদিককে তিনি বলেছিলেন, “জেআরডি টাটা ছিলেন আমার সর্বশ্রেষ্ঠ গুরু। তিনি আমার পিতা ও ভাইয়ের মতো ছিলেন। যদিও এভাবে তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক নিয়ে যথেষ্ট বলা হয় না।”

শুরুতে রতন টাটাকে পূর্ব ভারতের জামশেদপুরে অবস্থিত কোম্পানির একটি ইস্পাত কারখানায় পাঠানো হয়। সেখানে তিনি কয়েক বছর কারখানার একেবারে নিম্নপদস্থ কর্মচারীর মতো কাজ করেন। পরে অবশ্য পরিচালকের প্রযুক্তিগত সহকারী হন তিনি। ৭০ এর দশকের প্রথম দিকে তিনি দুটি ক্ষতিগ্রস্ত গ্রুপ ফার্ম, একটি রেডিও ও টিভি তৈরির এবং অন্যটি টেক্সটাইল তৈরির দায়িত্ব নেন। প্রথমটিকে তিনি সফলভাবে পরিচালনা করতে পারলেও দ্বিতীয় কোম্পানিতে তার ফলাফল ছিল মিশ্র।

অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে টাটা গোষ্ঠীর নেতৃত্ব দেওয়া জেআরডি টাটা ১৯৯১ সালে হঠাৎই অন্য অনেককে পেছনে রেখে রতন টাটাকে তার উত্তরসূরি করেন।

এবিষয়ে পরে রতন টাটা বলেছিলেন, “আপনি সেই সময়ের পত্রিকাগুলো খুঁজলে দেখতে পাবেন, এমন সিদ্ধান্তের কারণে তখন জেআরডি টাটাকে নেপোটিজমের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছিল। আমাকে পছন্দ করে তিনি ভুল করেছেন, এমনটাও বলা হয়েছিল।”

অবশ্য পিটার কেসির মতে, রতন টাটার নেতৃত্বে পুরনো ধাঁচের ভারতীয় প্রতিষ্ঠানটি বৈশ্বিক ব্র্যান্ড হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। শুধু তাই নয়, বিশ্বব্যাপী এই প্রতিষ্ঠানের পণ্য গ্রাহকের মন জয় করেছে।

অবশ্য তার ব্যবসায়িক জীবনের পুরোটাই যে খুব সরল ছিল তা নয়।

তাকে অ্যাঙ্গলো-ডাচ ইস্পাত কোম্পানি কোরাস ও যুক্তরাজ্যভিত্তিক গাড়ির ব্র্যান্ড জাগুয়ার ও ল্যান্ড রোভারকে অধিগ্রহণ করতে হয়েছিল। এই দুই সিদ্ধান্ত ছিল রতন টাটার জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। অবশ্য তিনি উৎরে গিয়েছিলেন। এর বাইরে একবার টেলিকম ব্যবসায় প্রচুর বিনিয়োগ করেছিলেন তিনি। কিন্তু সেই বিনিয়োগ ব্যর্থ হয়েছিল।

রতন টাটার সিদ্ধান্তে ২০০০ সালে টেটলি অধিগ্রহণের মাধ্যমে টাটা গ্রুপ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম চা কোম্পানিতে পরিণত হয়। এটি একটি ভারতীয় কোম্পানি মাধ্যমে একটি আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের বৃহত্তম অধিগ্রহণের ঘটনা ছিল।

ওই ঘটনার কয়েক বছর পর এক ব্রিটিশ সাংবাদিক রতন টাটাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, একটি ভারতীয় কোম্পানির যখন একটি প্রধান ব্রিটিশ ব্র্যান্ড অধিগ্রহণ করে, তখন এর অবস্থা সম্পর্কে তিনি কী ভাবেন। সেই সাংবাদিক পরে লিখেছিলেন, “টাটা খুব চতুর ও প্রজ্ঞাবান। তিনি কোনও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নবাবের মতো তার সাফল্য নিয়ে গর্ব করেন না।”

টাটার নিরাপদ ও সাশ্রয়ী ‘ন্যানো’ গাড়ি তৈরির উদ্যোগ ২০০৯ সালে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। কিন্তু প্রাথমিক সাফল্য ও উচ্ছ্বাসের পর উৎপাদন ও বিপণন সমস্যার কারণে ব্র্যান্ডটি সুবিধা করতে পারেনি। মাত্র এক লাখ রুপিতে মধ্যবিত্তের হাতে গাড়ি তুলে দেওয়ার চিন্তা তখন যুগান্তকারী হলেও বিভিন্ন কারণে ওই প্রকল্পে ব্যর্থ হয়েছিলেন রতন টাটা।

পরে টাটা অবশ্য বলেছিলেন, “ন্যানোকে বিশ্বের সবচেয়ে সস্তা গাড়ি হিসাবে ব্র্যান্ড করা একটি বিশাল ভুল ছিল। মানুষ বিশ্বের সবচেয়ে সস্তা গাড়ি চালানোর কথা ভাবতে চায় না।”

২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর মুম্বাইয়ে সন্ত্রাসী হামলায় তাকে ধৈর্য ও সহনশীলতার পরীক্ষা দিতে হয়েছিল। টাটা গোষ্ঠীর স্থাপনা তাজ হোটেলে হামলা হয় তখন। পাশাপাশি সেসময় একটি রেল স্টেশন, একটি হাসপাতাল, একটি ইহুদি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র এবং মুম্বাইয়ের আরও কিছু স্থান সন্ত্রাসীদের লক্ষ্যবস্তু হয়েছিল।

সন্ত্রাসী হামলায় তাজ হোটেলে অবরুদ্ধ থাকা ১৬৬ জনের মধ্যে ৩৩ জনের মৃত্যু হয়েছিল। এদের মধ্যে ১১ জনই ছিলেন হোটেলের কর্মচারী। টাটা গোষ্ঠী এই হতাহতদের পরিবারের দেখভাল করার প্রতিশ্রুতি দেয় এবং নিহতদের স্বজনদেরও দায়িত্ব নিয়েছিল। এছাড়া রতন টাটা ক্ষতিগ্রস্ত তাজ হোটেল পুনরুদ্ধারে ২০ মাসের মধ্যে ১ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি ব্যয় করেন।

কর্মজীবনের শেষের দিকে রতন টাটা একটি অপ্রীতিকর বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। টাটার চেয়ারম্যান পদ থেকে সাইরাস মিস্ত্রিকে অপসারণের পর তিনি কয়েক মাসের জন্য টাটা সন্সের অন্তর্বর্তী চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন। এই ঘটনায় বেশ তিক্ততা তৈরিও হয় তখন। পরে অবশ্য ওই পদে নটরাজন চন্দ্রশেখরনকে বসানো হয়। তিনি এর আগে টাটা কনসালটেন্সি সার্ভিসের প্রধান নির্বাহী ছিলেন। এই কোম্পানির বাজার মূল্য ছিল তখন ৬৭ বিলিয়ন ডলার।

অসংখ্য পদক ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন রতন টাটা। এর মধ্যে ভারতের তৃতীয় ও দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান – ২০০০ সালে পদ্মভূষণ ও ২০০৮ সালে পদ্মবিভূষণ অন্যতম। এছাড়া সিঙ্গাপুর, ইতালি, ফ্রান্স, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সরকারও তাকে সম্মাননা দিয়েছিল। ব্রিটিশ রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ হাত থেকে পেয়েছিলেন নাইট উপাধি।

ব্যবসায়িক জীবনের বাইরে রতন টাটার একজন মানবতাবাদী ও পরোপকারী হিসেবেও সুখ্যাতি আছে। অহেতুক কথা বলে মানুষের আকর্ষণ নেওয়ার বদলে তিনি কাজ করে গেছেন নিজের গতিতে। গত মার্চেও তিনি ২০ একর জমির উপর ১৬৫ কোটি রুপিতে নির্মিত একটি হাসপাতালের উদ্বোধন করেন। হাসপাতালটি বিশেষ করে কুকুরসহ বিভিন্ন প্রাণীর জন্য তৈরি করা হয়।

কুকুরের প্রতি রতন টাটার ভালোবাসা একটি প্রবাদপ্রতিম ঘটনা। টাটা গ্রুপের মুম্বাই সদরদপ্তরে আশ্রয় নেওয়া রাস্তার কুকুরগুলো ও তাজ হোটেল থাকা সেই কুকুরগুলোই হয়তো এই কথার সবচেয়ে ভালো প্রমাণ হতে পারে।

রতন টাটার তত্ত্বাবধানে টাটা গ্রুপ এবং টাটা ট্রাস্টস দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং ক্যান্সারের মতো রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে।

বছরের পর বছর রতন টাটা ও তার পরিবারের কোম্পানিগুলো বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে বিপুল পরিমাণ অর্থ দান করেছে। এর মধ্যে ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটিকে ৭০ মিলিয়ন ডলার এবং নিজের আলমা ম্যাটারকে ৫০ মিলিয়ন ডলার দান করার ঘটনা উল্লেখযোগ্য।

পিটার কেসি টাটাকে একজন ‘নম্র ও সংযত ব্যক্তি’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি টাটার মধ্যে এক ধরনের ‘গাম্ভীর্যপূর্ণ শান্ত’ এবং ‘কঠোর শৃঙ্খলা’ খুঁজে পেয়েছেন। প্রতিদিন হাতে লেখা একটি করণীয় তালিকা তৈরি করা ছিল তার এই শৃঙ্খলারই একটি অংশ।

টাটা একজন নম্র এবং চিন্তাশীল ব্যবসায়ী ছিলেন। ১৯৮৯ সালে পুনেতে তার একটি প্রতিষ্ঠানের কারখানায় হরতালের ফলে কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। তখন পুলিশকে ডেকে আনা হলে টাটা সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “সম্ভবত আমরা আমাদের কর্মীদের অবহেলা করেছি। আমরা ধরে নিয়েছিলাম যে আমরা তাদের জন্য যথাসর্বস্ব করছি, কিন্তু সম্ভবত তা ছিল না।”

২০০৯ সালে একটি স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের অনুষ্ঠানে টাটা তার স্বপ্নের কথা বলেছিলেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন, “প্রত্যেক ভারতীয়ের সমান সুযোগ থাকবে নিজের যোগ্যতার ভিত্তিতে উজ্জ্বল হওয়ার।”

তিনি আরও বলেছিলেন, “আমাদের মতো দেশে, আপনাকে উদাহরণ দিয়ে নেতৃত্ব দিতে হবে। আপনার ধনসম্পদ ও প্রভাবকে প্রদর্শন করতে নয়।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত