Beta
রবিবার, ১০ নভেম্বর, ২০২৪
Beta
রবিবার, ১০ নভেম্বর, ২০২৪

কত সম্পদ রেখে গেলেন রতন টাটা, উত্তরাধিকারী কারা

ratan-tata-death-101024
Picture of সকাল সন্ধ্যা ডেস্ক

সকাল সন্ধ্যা ডেস্ক

[publishpress_authors_box]

ভারতের অন্যতম বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠান টাটা সন্সের ইমেরিটাস চেয়ারম্যান এবং বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী শিল্পপতি রতন টাটা মারা গেছেন। তিনি ছিলেন ভারতের সবচেয়ে সম্মানিত ব্যবসায়ী নেতাদের একজন। যিনি ব্যবসায়, জনসেবায় এবং ভারতীয় উদ্যোগের বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।

টাটা গ্রুপ তার অধীনে লবণ থেকে ইস্পাত এবং সফটওয়্যার থেকে অটোমোবাইল ও বিমান চলাচলের মতো বৈচিত্র্যময় ব্যবসায় উদ্যোগের সাক্ষী হওয়া সত্ত্বেও বিশ্বের শীর্ষ বিলিয়নেয়ারের কোনও তালিকায় তার নামে ওঠেনি।

রতন টাটা ছয়টি মহাদেশ জুড়ে ১০০টিরও বেশি দেশে পরিচালিত ৩০টিরও বেশি কোম্পানি পরিচালনা করলেও খুব সাধারণ জীবনযাপন করতেন। গ্রুপটির বার্ষিক আয় একশ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি।

২০২২ সালের আইআইএফএল ওয়েলথ হুরুন ইন্ডিয়া রিচ লিস্টে রতন টাটা ৩ হাজার ৮০০ কোটি রুপির সম্পদ নিয়ে ৪২১তম স্থানে ছিলেন। তিনি ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার পদ্ম বিভূষণ পেয়েছিলেন।

১৯৬২ সালে রতন টাটা পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন। তিনি প্রাথমিকভাবে টাটা গ্রুপের বেশ কয়েকটি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের ফ্লোরে কাজ করে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন। ১৯৭১ সালে তাকে ন্যাশনাল রেডিও অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স কোম্পানির দায়িত্ব দেওয়া হয়।

তার এক দশক পরে ১৯৯১ সালে তিনি টাটা ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান হন। চাচা জেআরডির কাছ থেকে তিনি টাটা গ্রুপের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন। তার চাচা অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে টাটা গ্রুপের দায়িত্বে ছিলেন।

তার দায়িত্ব নেওয়ার বছর থেকেই ভারত মুক্তবাজার অর্থনীতি চালু করে এবং রতন টাটা দ্রুতই গ্রুপটিকে একটি ‘বৈশ্বিক পাওয়ার হাউসে’ পরিণত করেন, যেটি ১৮৮৬ সালে একটি ছোট টেক্সটাইল ও ট্রেডিং ফার্ম হিসাবে যাত্রা শুরু করেছিল।

দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে গ্রুপের প্রধান হোল্ডিং কোম্পানি টাটা সন্সের চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। তার সময়েই টাটা গ্রুপের বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যিক সাম্রাজ্য গড়ে উঠে। ২০০০ সালে টাটা গ্রুপ লন্ডন-ভিত্তিক টেটলি টি ৪৩১.৩ মিলিয়ন ডলারে অধিগ্রহণ করে। ২০০৪ সালে ১০২ মিলিয়ন ডলারে দক্ষিণ কোরিয়ার দায়েউ মোটরসের ট্রাক-উৎপাদন কার্যক্রম কিনে নেয়।

একই সময়ে অ্যাংলো-ডাচ ইস্পাত প্রস্তুতকারক কোরাস গ্রুপ কিনতে ১১.৩ বিলিয়ন ডলার দেয় টাটা। আর ফোর্ড মোটর কোম্পানি থেকে অভিজাত ব্রিটিশ গাড়ি ব্র্যান্ড জাগুয়ার ও ল্যান্ড রোভার কেনার জন্য ২.৩ বিলিয়ন ডলার খরচ করে।

নৈতিক ব্যবসা

বলা হয়, হাড়ে-মজ্জায় একজন মানবহিতৈষী রতন টাটা তার দাদা এবং টাটা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা জামশেদজি টাটার ডিএনএ পেয়েছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, ব্যবসায় উদ্যোগগুলোকে শুধু তাদের নিজেদের কোম্পানির স্বার্থেই নয়, বরং যে জনগোষ্ঠীগুলোকে তারা সেবা দেয় তাদের স্বার্থেও পরিচালিত করতে হবে।

রতন টাটা তার নৈতিক ব্যবসায়িক অনুশীলনের জন্য বিখ্যাত। তার মেয়াদকালে তিনি ব্যবসায় সততা, কর্পোরেট শাসন এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার উপর জোর দিয়েছিলেন, যার ফলে টাটা গ্রুপ বিশ্বস্ততার জন্য খ্যাতি অর্জন করে।

টাটা ন্যানো (সাশ্রয়ী গাড়ি) এবং টাটা সোয়াচ (একটি কম খরচে পানি বিশুদ্ধকারী) এর মতো পণ্য তৈরির জন্য তার স্বপ্ন সাধারণ মানুষের চাহিদা পূরণের প্রতি তার মনোযোগকে প্রতিফলিত করে। টাটার মনোযোগ সবসময়ই তার দেশের মানুষদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করার দিকে ছিল।

মানবসেবা

ভারতের অন্যতম সফল ব্যবসায়িক টাইকুন হওয়ার পাশাপাশি তিনি তার জনহিতকর কার্যকলাপের জন্যও পরিচিত। পরোপকারে তার ব্যক্তিগত সম্পৃক্ততা ক্যারিয়ারের প্রথম দিকেই শুরু হয়। ১৯৭০-এর দশকে তিনি আগা খান হাসপাতাল এবং মেডিকেল কলেজ প্রকল্পের সূচনা করে ভারতের প্রধান স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর একটির ভিত্তি স্থাপন করেন।

টাটা গ্রুপের চেয়ারম্যানরা তাদের সম্পত্তি টাটা ট্রাস্টে দান করে গেছেন, যেগুলো টাটা সন্সের দুই-তৃতীয়াংশ অংশীদারত্বের অধিকারী। টাটা সন্স থেকে পাওয়া লভ্যাংশের প্রায় ৬০ শতাংশ দাতব্য কাজের জন্য বরাদ্দ করা হয়।

রতন টাটার সময় টাটা ট্রাস্ট আসাম, ঝাড়খণ্ড, অন্ধ্রপ্রদেশ এবং কর্ণাটকে ১০টি ক্যান্সার হাসপাতাল তৈরি করেছে এবং উন্নত করেছে। এই হাসপাতালগুলোতে দরিদ্র মানুষের বিশ্বমানের চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়।

রতন টাটা সক্রিয়ভাবে টাটা ট্রাস্টকে অত্যাবশ্যকীয় সামাজিক চাহিদা পূরণের দিকে পরিচালিত করেছিলেন। তিনি টাটা ইনস্টিটিউট অফ সোশ্যাল সায়েন্সের মতো শ্রেষ্ঠ গবেষণা ইনস্টিটিউট স্থাপন করেছিলেন এবং ভারত জুড়ে শিক্ষামূলক উদ্যোগে অর্থায়ন করেছিলেন।

স্টার্ট-আপের বিকাশে অবদান

অবসর গ্রহণের পর রতন টাটা একজন সক্রিয় অ্যাঞ্জেল ইনভেস্টর বা পৃষ্ঠপোষক বিনিয়োগকারী হয়ে উঠেন। তরুণ উদ্যোক্তা এবং স্টার্ট-আপগুলোকে বিনিয়োগ সহায়তা করে ভারতের স্টার্ট-আপ ইকোসিস্টেমের বিকাশে অবদান রাখেন তিনি।

টাটা সন্সের ইমেরিটাস চেয়ারম্যান থাকাকালে রতন টাটা অভূতপূর্ব এক উদ্যোগ নেন। তিনি ২১ শতকের তরুণ উদ্যোক্তাদের সাহায্য এবং নতুন যুগের প্রযুক্তি-চালিত স্টার্ট-আপগুলোতে বিনিয়োগ করতে শুরু করেন, যা দেশের ভবিষ্যৎ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

তার ব্যক্তিগত ক্ষমতায় এবং কিছুটা তার বিনিয়োগ কোম্পানি আরএনটি ক্যাপিটাল অ্যাডভাইজারের মাধ্যমে রতন টাটা ওলা ইলেকট্রিক, পেটিএম, স্ন্যাপডিল, লেন্সকার্ট এবং জিভামে সহ ৩০টিরও বেশি স্টার্ট-আপে বিনিয়োগ করেছেন।

দাতব্যের প্রতি তার ভালবাসা মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। একজন কুকুর-প্রেমিক টাটা একবার আদেশ দিয়েছিলেন, মুম্বাইয়ের কেন্দ্রস্থলে তার প্রতিষ্ঠানের সদর দপ্তরের বাইরে যে কোনও পথকুকুরকে আশ্রয় দেওয়া হবে। সেখানে আশ্রয় পাওয়া অনেক কুকুর কোনোদিনই তাকে ছেড়ে যায়নি।

তিনি শুধু একটি আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যই গড়ে তোলেননি বরং এর মুনাফা থেকে সমাজে অর্থপূর্ণভাবে অবদান রাখার বিষয়টিও নিশ্চিত করেছেন।

তাকে এক অনন্য মর্যাদা ও উপাধি দেওয়া হয়— একজন কর্পোরেট টাইটান যিনি শালীনতা এবং সততার জন্য খ্যাতি সহ ‘সেক্যুলার জীবন্ত সাধু’ হিসাবে বিবেচিত হন।

রতন টাটার সম্ভাব্য উত্তরাধিকারী মায়া টাটা, লিয়া টাটা ও নেভিল টাটা।

উত্তরাধিকারী কারা

রতন টাটার মৃত্যুর পর সবার চোখ এখন টাটার পরবর্তী প্রজন্মের উত্তরাধিকারীদের দিকে রয়েছে। টাটা পরিবারের পরবর্তী প্রজন্মের কয়েকজন ইতোমধ্যে টাটা গ্রুপের নেতৃত্বের ভূমিকায় রয়েছেন। এরা হলেন- লিয়া টাটা, মায়া টাটা ও নেভিল টাটা, যারা রতন টাটার পরিবারের সদস্য এবং দায়িত্ব নেওয়ার জন্য প্রস্তুত।

রতন টাটা স্যার দোরাবজি টাটা ট্রাস্ট এবং স্যার রতন টাটা ট্রাস্টের ট্রাস্টি হিসেবে লিয়া, মায়া ও নেভিলের নিয়োগকে সমর্থন করেছিলেন, যেগুলো টাটা ট্রাস্টের প্রাথমিক জনহিতকর প্রতিষ্ঠান। এই ট্রাস্টগুলো টাটা পরিবারের দাতব্য কাজে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে।

টাটা পরিবারের তরুণ প্রজন্ম বর্তমানে গ্রুপের পাঁচটি প্রধান জনহিতকর সংস্থায় পরিচালনা বোর্ডের পদে রয়েছেন।

রতন টাটা বিয়ে করেননি। তাই তার নিজের কোনও সন্তান নেই। তার আপন ভাই জিমি টাটাও বিয়ে করেননি। রতন টাটার বয়স যখন মাত্র ১০ বছর, তখন তার মা-বাবার বিয়েবিচ্ছেদ ঘটে। মা-বাবার অসুখী জীবন দেখেই দুই ভাইয়ের কেউই আর বিয়ের পথে হাঁটেননি বলে ধারণা করা হয়।

লিয়া, মায়া ও নেভিল হলেন রতন টাটার সৎ ভাই নোয়েল টাটার সন্তান।

তিনজনই সম্ভাব্য উত্তরসূরি হিসাবে গ্রুপের অপারেটিং কোম্পানিতেও পরিচালনা বোর্ডের পদ গ্রহণ করতে পারে, যেখানে তারা ইতোমধ্যেই বিভিন্ন ব্যবস্থাপকীয় ভূমিকায় অভিজ্ঞতা অর্জন করছেন।

মায়া টাটা, লিয়া টাটা, নেভিল টাটা

লিয়া টাটা স্পেনের অভিজাত আইই বিজনেস স্কুলে পড়াশোনা শেষে টাটা গ্রুপের হসপিটালিটি শাখায় বিশেষ করে ভারতীয় হোটেল কোম্পানি এবং তাজ হোটেলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি বিশ্বব্যাপী হোটেল শিল্পে তার গ্রুপের উপস্থিতি বাড়াতে অবদান রেখেছেন।

মায়া টাটা গ্রুপের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব এবং ব্যায়েস বিজনেস স্কুল ও ওয়ারউইক ইউনিভার্সিটি উভয়টিতেই পড়াশোনা করেছেন। তিনি টাটা অপর্চুনিটিজ ফান্ড এবং টাটা ডিজিটালের সঙ্গেও কাজ করেছেন। গ্রুপের সুপার অ্যাপ টাটা নিউ লঞ্চেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। গ্রুপের ডিজিটাল উদ্যোগের মধ্যে মায়া দৃঢ় নেতৃত্ব এবং কৌশলগত দূরদর্শিতা প্রদর্শন করেছেন।

নেভিল টাটা বর্তমানে স্টার বাজারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, যেটি টাটা কোম্পানি ট্রেন্ট লিমিটেডের অধীনে কাজ করে। তার নেতৃত্বের দক্ষতা এবং ব্যবসায়িক দক্ষতা তার খুচরা ব্যবসা পরিচালনায় স্পষ্ট।

নেভিল মানসী কির্লোস্করের সঙ্গে বৈাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ, যাকে টাটা গ্রুপের মধ্যে ভবিষ্যতের নেতৃত্বের জন্য আরেকজন শক্তিশালী প্রতিযোগী হিসাবে দেখা হয়।

তথ্যসূত্র : ইন্ডিয়া ডটকম, লাইভ মিন্ট, ইকোনমিক টাইমস, হিন্দুস্তান টাইমস

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত