বলা হয় সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে সাদা জামা গায়ের এক দেবতা থাকেন। তিনিই মাঠে রিয়ালকে বর দেন। শেষ বাঁশির আগে প্রতিপক্ষ জিতবে, এটা কল্পনা করা কঠিন। আর যদি সাদা জার্সির (রিয়ালের) কেউ ভুল করে, তবে রিয়ালকেই শাস্তি দেন তিনি।
ওই দেবতার জোরে সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে রচিত হয়েছে এত রূপকথা। তাদের মাঠ যেন সাদা দুর্গ। যেখানে ম্যাচের ৯০ মিনিট বড় লম্বা মনে হয় প্রতিপক্ষের। আর এটা এখন বানী চিরন্তনীতে স্থান পাওয়ার মতো সত্যি হয়ে উঠেছে। তবে ১৪টি চ্যাম্পিয়ন্স লিগকে শিরোপার দান বলা যাবে না মোটেই। এর পেছনে আছে আরেক জাদু। ভালদেবেবাস নামের এক জাদুর বাক্স !
ভালদেবেবাস কি?
সত্যিই এটা জাদুরই বাক্স। রিয়াল মাদ্রিদ দল যেখানে অনুশীলন করে সেটাই ভালদেবেবাস। মাদ্রিদ শহরের অদূরে বারেহাস বিমানবন্দরের পাশেই অবস্থিত ক্লাবটির অনুশীলন কমপ্লেক্স। নাম – সুইদাদ রিয়াল মাদ্রিদ ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ। রিয়ালের প্রেসিডেন্টের নামেই এটার নামকরণ। কারণ আগের অনুশীলন গ্রাউন্ডটি তার অধীনেই সুইদাদ দেপোর্তিভো’র বিশাল কমপ্লেক্সে রূপ নেয় ২০০৫ সালে।
আধুনিক ফুটবলে যা দরকার হয় তার সবকিছু আছে এখানে। এ যেন গ্রীক দেবী প্যান্ডোরকে দেওয়া ঈশ্বরের উপহার বাক্স। তাতে হাত দিয়ে যা চাইবে তাই পাওয়া যায়। এই জাদুর বাক্সের ম্যানেজার এখন গুতি। সাবেক স্পেন ও রিয়াল মাদ্রিদ মিডফিল্ডার। তার তত্বাবধানেই চলছে এর কার্যক্রম।
ভালদেবেবাসে কি আছে?
রিয়ালের এই আয়োজনকে কোন ফুটবল ক্লাবের তৈরি বিশ্বের সেরা ফুটবল ফ্যাসিলিটি বলা হয়। এর আয়তন ১ হাজার ৬৭ একর বা ১২ লাখ স্কয়ার মিটার। যা রিয়ালের মূল স্টেডিয়াম সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর ৪০ গুন বড়। আর ইতালির মাঝের দেশ ভ্যাটিকান সিটির চেয়েও ২.৭ গুন বড়।
অনুশীলন ফ্যাসিলিটিজের মাঝে ৯ হাজার স্কয়ার মিটারের ইংরেজি অক্ষর ‘টি’ এর আদলে করা সুদৃশ্য দালান আছে। যেখানে ড্রেসিংরুম, জিমনেশিয়াম, ক্লাসরুম, কনফারেন্স রুম, অফিস, হাইড্রোথেরাপি রুম, চারটি সুইমিং পুল (দুটি গরম পানি ও দুটি ঠান্ডা পানির), সাওনা ও টার্কিশ বাথের কক্ষ। এই দালানের দুই পাশে মোট ১০টি অ্যাস্ট্রো টার্ফ ও ঘাসের ফুটবল মাঠ আছে। এর মধ্যে তিনটি ফুটবল মাঠে বার্নাব্যুতে ব্যবহার করা ঘাস লাগানো হয়েছে। যেন ফুটবলাররা সঠিক পিচে অনুশীলন করতে পারে।
নিজেদের এই বিশ্বসেরা অনুশীলন সুবিধা নিয়ে গুতি বলেছেন, “অনুশীলন একজনকে নিঁখুত করে তোলে। আমরা বিশ্বাস করি আপনার হাতে সেরা যন্ত্র থাকলে আপনি সেরা মেশিন তৈরি করতে পারবেন। আমরা ভালদেবেবাসে সেরা টুলস তৈরি রেখেছি। যেন ফুটবলাররা সর্বোচ্চ সুবিধায় অনুশীলন করে সেরা পারফরম্যান্সের জন্য তৈরি হতে পারে।”
আছে ডাটা ল্যাব
২০১৫ সালে এই অনুশীলন ফ্যাসিলিটিজে নতুন দিগন্ত যোগ করে মাদ্রিদ। গ্লোবাল স্পোর্টস ইনোভেশন সেন্টার নামে ডাটা সাইন্স ল্যাবের উদ্বোধন করে তারা। এতে অনুশীলন মাঠ, মূল স্টেডিয়াম এবং বিপক্ষের মাঠের ম্যাচের ভিডিও ফুটেজ ব্যবহার করে ফুটবলারদের প্রতিটি পদক্ষেপের ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়।
প্রতি ম্যাচ শেষে সমন্বয়কৃত ভিডিও থেকে কোন ফুটবলারের কোন পাস, কোন মুভমেন্ট বা কোন শটটি একটি নির্দিষ্ট ম্যাচের নির্দিষ্ট মুহুর্তে কাজে দিয়েছে বা ভুল হয়েছে তা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ হয়। সেসব ভিডিও আকারে কোচদের কাছে তুলে ধরেন অ্যানালিস্ট। সেই অনুযায়ী দলের মূল কোচ কাজ শুরু করেন।
আনচেলোত্তির চোখে
দুই মেয়াদে রিয়াল মাদ্রিদের কোচ থাকা কার্লো আনচেলোত্তি ক্লাবটির অনুশীলন সুবিধার পুরোটাই উপভোগ করেছেন। ২০১৫ সালে প্রথম দফায় রিয়াল ছেড়ে চলে যাওয়ার পর দ্বিতীয় দফার দায়িত্ব নিয়ে পেয়েছেন এই সুবিশাল ডাটা সম্ভার। তাই সব কিছু আনচেলোত্তির কাছে আরও সহজ ও উন্নত মনে হয়েছে।
তবুও এই কোচ পুরো কৃতিত্ব শুধু ভালদেবেবাসকেই দিতে চাচ্ছেন না। তার মতে রিয়াল এত সফল কেন এ নিয়ে লেখাপড়া হওয়া উচিত। বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের বিপক্ষে ফাইনালের আগে বলেছেন, “আপনি যাই বলুন, রিয়াল ভাগ্যের জোড়ে এত সফল এটা বলতে পারবেন না। এই ক্লাবটির বিশেষ কিছু আছে। যা নিয়ে পড়ালেখা করা গুরুত্বপূর্ণ।”
আনচেলোত্তি আরও যোগ করেন, “এই মুহুর্তে বিশেষ বস্তুটা কি তা বলতে পারছি না। হতে পারে ঐতিহ্য, কন্ডিশন, ফুটবলারদের মান বা মানসিকতা। মূল কথা রিয়াল এতবার সফল হয়েছে যে আপনি কাকতালীয় বলতে পারবেন না।”
পরিশেষে
আনেচেলোত্তি রিয়ালের সাফল্যকে কাকতালীয় বলছেন না। রিয়ালের লিগে রেকর্ড ৩৬টি শিরোপা আর ইউরোপে রেকর্ড ১৪টি চ্যাম্পিয়ন লিগ কোন ভাবেই কাকতালীয় সাফল্যের ফসল না। তার পেছনে আছে পরিকল্পনা, পরিশ্রম। এবং অবশ্যই ভালদেবেবাস। সেখানে চর্চার পর ফল মেলে মূল ম্যাচে। শনিবার রাতের ফাইনালে আরও একবার সেই প্রতিফলন হবে কি!