শিশুরা প্রায়ই বাবা-মা বা পরিবারের বয়স্কদের কাছে নানা ধরনের তুলনার সম্মুখীন হয়। যেমন-
পাশের বাড়ির রাসেল ফার্স্ট হতে পারলে তুই পারিস না কেন?
ওই যে নাবিলা, পড়ালেখায় যেমন ভালো, ছবিও আঁকে দারুণ। তোমার এই অবস্থা কেন?
আমাদের সমাজে এইসব শুনে বড় হননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। অন্য কারও সঙ্গে তুলনা শুনেই আমরা ছোটবেলা থেকে বড় হই। বেশিরভাগ অভিভাবক মনে করেন, সন্তানের সঙ্গে এভাবে তুলনা দিয়ে কথা বললে তাদের ভেতর ‘ভালো’ করার প্রবল ইচ্ছা তৈরি হবে। আসলে কি তা ঘটে?
মনোবিদরা সন্তানদের এমন তুলনার মুখোমুখি করাকে রীতিমতো ‘ক্রাইম’ বা অপরাধ বলছে।
জেনে নেওয়া যাক সেগুলো-
আত্মমর্যাদার ঘাটতি এবং নিরাপত্তাহীনতা
অন্যের সঙ্গে তুলনা শিশুর মনে নিজের সম্পর্কে হীন ধারণা তৈরি হয়। তার মর্যাদাবোধ হ্রাস পেতে থাকে এবং তার মনে তৈরি হয় নিরাপত্তাহীনতা। এতে করে তার আত্মবিশ্বাস হয়ে পড়ে নড়বড়ে। সে বিশ্বাস করতে শুরু করে তাকে দিয়ে ‘ভালো’ কিছুই কখনো হবে না। এই বিশ্বাস থেকে যায় বড় বেলায়ও।
ভাই-বোনদের মধ্যে বিদ্বেষ
একই পরিবারে ভাই-বোনদের মধ্যে পড়ালেখার আগ্রহ এবং মনযোগের ধরন এক রকম নয়। কিন্তু বেশিরভাগ অভিভাবক চান একজন যদি খুব ভালো রেজাল্ট করে তাহলে বাকিদেরও তাই করা উচিত। অথচ প্রত্যেকেই পৃথক ব্যক্তিসত্তা এবং স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে বেড়ে উঠছে। কিন্তু অভিভাবকদের এমন চাওয়া পড়াশোনায় কম আগ্রহী শিশুটির মনে, কথিত ‘ব্রিলিয়ান্ট’ ভাই-বোনের ব্যাপারে বিদ্বেষ তৈরি করতে পারে। এই বিদ্বেষ এবং ঘৃণা তারা টেনে নিয়ে যেতে পারে তাদের পরিণত বয়সেও।
স্পৃহা কমে যাওয়া
শিশুদের অন্যের সঙ্গে তুলনা করা হলে তার ভেতর উদ্দীপনা কমে যায়। তার ভালো লাগার জায়গাগুলো থেকে সে নিজেকে গুটিয়ে নেয় এবং কোন বিষয়ে দক্ষতা অর্জনের স্পৃহা তার আর থাকেনা। নিজ আগ্রহের জায়গা থেকে কোন কাজ করার পরিবর্তে আশেপাশের মানুষ কী বলল সে বিষয়ে তার আগ্রহ বেড়ে যায়।
নিজস্বতা হারানো
প্রতিটি শিশু আলাদা। তাদের আছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য এবং ব্যক্তিত্ব। প্রতিটি শিশুর শেখার গতি এবং ধরণ পৃথক। কিন্তু অভিভাবকরা সাধারণত তাদের শিশুকে নির্দিষ্ট একটি ছকে গড়ে উঠতে বাধ্য করেন। এর ফলে শিশুরা তার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলে। আর এমন কিছু করতে বাধ্য হয় যেখানে তারা আদৌ নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে পারেনা।
মানসিক চাপ এবং উদ্বেগ তৈরি করে
নিরন্তর তুলনা শিশু মনে চাপ তৈরি করে। সে এমন কিছুকে নিজের লক্ষ্য হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য হয়, যা আদৌ তার আগ্রহের জায়গা নয়। ফলে এক অবাস্তব প্রত্যাশার ভেতর সে ঘুরপাক খায়। এতে করে তার ভেতর তৈরি উদ্বেগ। ব্যর্থতার ভয়। যার চূড়ান্ত পর্যায় ‘এংজাইটি ডিজঅর্ডার’। এই মানসিক সমস্যাগুলো প্রাপ্তবয়স্ক জীবনে তার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে থাকে।
অভিভাবকের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস কমে যাওয়া
তুলনা শিশুর মনে ভীতি তৈরি করে। সারাক্ষণ তার মনে হতে থাকে, নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কথা জানালেই সে বিচারের মুখোমুখি হবে। এভাবে অভিভাবকের প্রতি তার আস্থা এবং বিশ্বাস কমে যায়। ফলে বড়দের সঙ্গে সে কথা বলা কমিয়ে দেয় এবং নিজেকে গুটিয়ে নেয়।
অবাস্তব প্রত্যাশা
শিশুদের যখন আমরা তুলনা করি, তখন নিজের অজান্তেই আমরা তার সামনে কিছু অবাস্তব লক্ষ্য নির্ধারণ করি। যে লক্ষ্য পূরণ তার পক্ষে সম্ভব নয়। এই অবাস্তব লক্ষ্যগুলো যখন সে পূরণ করতে পারেনা, তখন তার মনে তৈরি হয় হতাশা, বিষণ্ণতা এবং নিজের ব্যাপারে সন্দেহ। আর এই সবগুলোই তার আত্মবিশ্বাস এবং উৎসাহ ভেঙ্গে দেয়।
সন্তান-অভিভাবক সম্পর্কের অবনতি
ক্রমাগত তুলনা সন্তানের সঙ্গে অভিভাবকের বৈরী সম্পর্ক তৈরি করে। সন্তানদের ক্রমাগত তুলনা করতে থাকলে, তারা ধরে নেয় বাবা-মা’র ভালোবাসা একটি শর্তসাপেক্ষ ব্যাপার। যা কিনা কেবল পড়েলেখায় ভালো ফল বয়ে আনার সঙ্গেই যুক্ত। এর ফলে সন্তানের সঙ্গে অভিভাবকের দূরত্ব সৃষ্টি হয়।