Beta
বৃহস্পতিবার, ১ মে, ২০২৫
Beta
বৃহস্পতিবার, ১ মে, ২০২৫

ইঞ্চি ইঞ্চি করে চিন রাজ্য দখলের পথে বিদ্রোহীরা

Chin
[publishpress_authors_box]

পশ্চিম মিয়ানমারের পাহাড়ি এলাকায় এক বিদ্রোহী সদরদপ্তরের প্রাচীরে ঝোলানো নিহত যোদ্ধাদের ছবি। স্মৃতি জাগানিয়া এসব ছবির মধ্যে ৮০ জন তরুণ যোদ্ধার ছবি রয়েছে। প্রথমে আছে ২০২১ সালের মে মাসে নিহত ২৮ বছর বয়সী সালাই চুঙ নাও পিয়াংয়ের ছবি।

চিন ন্যাশনাল ডিফেন্স ফোর্স (সিএনডিএফ) এখনও মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। তাদের ক্ষতি শুধু সদরদপ্তরের প্রাচীরে সীমাবদ্ধ নেই। এই ক্ষতি আরও বাড়ছে। বিশেষ করে ভারত সীমান্তে অবস্থিত খ্রিস্টান অধ্যুষিত অঞ্চল চিন রাজ্যে। সেখানে চিন জাতিগোষ্ঠীর যোদ্ধারা মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে তাদের অধিকাংশ অঞ্চল থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে।

সিএনডিএফের ভাইস প্রেসিডেন্ট পিটার থাং আল জাজিরাকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “তারা যদি আত্মসমর্পণও না করে, তবুও আমরা শেষ পর্যন্ত যাব, ধীরে ধীরে।”

নভেম্বর মাসে সিএনডিএফ গ্রুপ ফালাম শহর দখল করার জন্য ‘মিশন জেরুজালেম’ নামে একটি অভিযান শুরু করে। এ অভিযানের প্রথম ছয় সপ্তাহে প্রায় ৫০ জন সিএনডিএফ ও তাদের সহযোগী যোদ্ধা নিহত হয়। এর মধ্যে কয়েকজন সরাসরি বিমান হামলায় মাটিচাপা পড়ে মারা যায়।

থাং মিয়ানমারের সেনাবাহিনীরও একই ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা করে জানিয়েছেন, চলমান অভিযানে ১০০ জনের বেশি সেনাকে আটক করা হয়েছে।

২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর সাধারণ মানুষের গঠিত সিএনডিএফ মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছে। বর্তমানে তারা ফালাম শহরের পাহাড়ি এলাকার সেনা ক্যাম্প ঘেরাও করেছে। থাং বলেন, “আমরা কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।”

ফালাম শহর এক সময় চিন রাজ্যের রাজধানী ছিল। এটি দখল এবং এর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা মিয়ানমারের বিদ্রোহী বাহিনীর জন্য একটি বড় কৃতিত্ব হবে। কারণ এটি হবে প্রথম জেলা কেন্দ্র, যা জাতিগত সেনাবাহিনীর সহায়তা ছাড়াই দখল করা হবে।

থাং বলেন, “আমাদের চ্যালেঞ্জ অন্যদের তুলনায় বেশি। সেনাবাহিনীর কাছে অনেক প্রযুক্তি আছে। কিন্তু আমাদের হাতে সীমিত অস্ত্র রয়েছে। কিছু অস্ত্র আমরা চালাতে পারি না।”

সিএনডিএফের ভাইস প্রেসিডেন্ট পিটার থাং।

পাহাড়ি ঘাঁটি ঘেরাও

চিন রাজ্যে বিদ্রোহী দল সিএনডিএফ বর্তমানে ১৫টি নতুন সশস্ত্র গোষ্ঠীর সমর্থন পাচ্ছে। এর মধ্যে মিয়ানমারের বামার জাতিগোষ্ঠীও রয়েছে। প্রায় ৬০০ বিদ্রোহী ফালাম শহর এবং সেখানে অবস্থানরত প্রায় ১২০ জন সেনাকে ঘেরাও করে রেখেছে। এই সেনারা তাদের পাহাড়ি ঘাঁটিতে আটকে রয়েছে এবং টিকে থাকার জন্য হেলিকপ্টার থেকে সরবরাহকৃত সামগ্রীর ওপর নির্ভরশীল।

এদিকে মিয়ানমারের অন্যান্য জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো নিজেদের জন্য আরও অঞ্চল দখল করতে যুদ্ধ করছে। তবে চিন রাজ্যে জড়ো হওয়া বিদ্রোহী বাহিনী মূলত মিয়ানমারে সেনা শাসন পুরোপুরি উৎখাত করার লক্ষ্য নিয়ে লড়াই করছে।

চিন ব্রাদারহুড (সিবি) জোটের সিএনডিএফ এবং এর সহযোগীরা দক্ষিণে আরাকান আর্মির (এএ) সহায়তায় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কিছু সফল অভিযান পরিচালনা করেছে। তবে ফালাম শহর দখল করা মিয়ানমারের বিপ্লবের একটি নতুন পর্ব হিসেবে গণ্য হবে।

এই যুদ্ধে বিদ্রোহীদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিমান হামলা। ফালামের পাহাড়ি ঘাঁটিতে হামলা চালানোর সময় সেনাবাহিনীর রুশ ও চীনা যুদ্ধবিমান দিয়ে বোমাবর্ষণ শুরু করে। পাশাপাশি রকেট-গ্রেনেড, স্নাইপার ও মেশিনগান থেকে গুলি ছোড়া হয়।

সিএনডিএফ কমান্ডাররা জানিয়েছে, এক সময় ঘেরাও করা সেনারা স্থানীয়দের সঙ্গে অবাধে কথা বলত এবং কিছু সেনা স্থানীয় চিন নারীদের বিয়ে করেছিল। কিন্তু ২০২১ সালে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালিয়ে হত্যার পর পরিস্থিতি পাল্টে যায়।

বিক্ষোভকারীরা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। একে একে বিদ্রোহের সূত্রপাত হয়। ১৯ বছর বয়সী একজন বিক্ষোভকারী মিয়া থওয়ে থওয়ে খাইন ২০২১ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারের রাজধানী নেপিদোতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন। তিনি ছিলেন প্রথম শহীদ।

২০২১ সালের এপ্রিলে চিনের বাসিন্দারা শিকারী রাইফেল নিয়ে মিয়ানমারের বিপ্লবের প্রথম বড় যুদ্ধ শুরু করে মিন্দাত শহরে, যা পরে মুক্ত হয়। বর্তমানে বিদ্রোহীরা অ্যাসল্ট রাইফেল ও গ্রেনেড লঞ্চার নিয়ে সজ্জিত। তারা গ্রামাঞ্চল এবং কয়েকটি শহর নিয়ন্ত্রণ করছে। কিন্তু সেনাবাহিনী শহরাঞ্চলে শক্তিশালী অবস্থান নিয়েছে। সেনাবাহিনী তাদের সীমিত জনবল দিয়ে লড়াই করতে না পারায় সাধারণ জনগণকে বাধ্যতামূলক সেনাবাহিনীতে যোগদান করাচ্ছে। দেশব্যাপী বিমান হামলাও চালাচ্ছে সেনাবাহিনী।

অ্যাসিসট্যান্স অ্যাসোসিয়েশন ফর পলিটিক্যাল প্রিজনার্স (এএপিপি) জানায়, অভ্যুত্থানের পর সেনাবাহিনী কমপক্ষে ৬ হাজার ৩৫৩ জন সাধারণ মানুষকে হত্যা করেছে।

জাতিসংঘের মতে, দেশজুড়ে কমপক্ষে ৩৫ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। পর্যবেক্ষকরা এই বছর আরও তীব্র লড়াইয়ের পূর্বাভাস দিয়েছেন।

সেনাদের বিভ্রান্তি, বিদ্রোহীদের অগ্রগতি

মিয়ানমারের চিন রাজ্যের ফালাম শহরে ঘেরাও হওয়া সেনাদের মধ্যে বিভ্রান্তি ও হতাশা বাড়ছে।

সিএনডিএফের প্রতিরক্ষা সচিব অলিভিয়া থাং লুয়াই জানিয়েছেন, পাহাড়ি ঘাঁটিতে কিছু সেনাকে তাদের স্ত্রীদের সঙ্গে বসবাস করতে দেখা গেছে। তবে তাদের বেশিরভাগই ঘাঁটি ছাড়তে চাইলেও কমান্ডারের কড়া নিয়ন্ত্রণের কারণে তা পারছে না। তাদের ফোন ব্যবহারের অনুমতিও নেই।

সিএনডিএফের আরেক জ্যেষ্ঠ নেতা টিমি হটুত জানান, ঘেরাও করা ঘাঁটির কমান্ডারের কাছে এখনও ব্যক্তিগত ফোন রয়েছে। বিদ্রোহীরা নিয়মিত সেই নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করছে।

সরকারি বাহিনী ফালামে আরও সেনা পাঠানোর চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হয়েছে। বাধ্যতামূলকভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত নতুন সেনাদের হেলিকপ্টার থেকে শহরের বাইরে নামিয়ে দেওয়া হয় এবং তাদের ভেতরে ঢুকে যুদ্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু কেউই সফল হয়নি।

একজন আটক সেনা আল জাজিরাকে জানান, তাদের ইউনিটকে কোনও পরিকল্পনা ছাড়াই ফালামে নামিয়ে দেওয়া হয়। প্রবল গুলিবর্ষণের মুখে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের তাড়া খেয়ে তারা ছড়িয়ে পড়েছিল। কিছু সেনা নিহত হয়েছে, বাকিরা দিশেহারা হয়ে পালিয়েছে।

তিনি বলেন, “সেনা সদরদপ্তর জানিয়ে দেয়, আমাদের জন্য তারা যুদ্ধবিমান পাঠাবে না। এভাবেই সেনাবাহিনী অভ্যুত্থানের পর থেকে অনেক দক্ষ ও মূল্যবান সেনা হারিয়েছে। তারা কিছুই না হওয়ার জন্য জীবন দিয়েছে।”

তিনি আরও বলেন, “শেষ পর্যন্ত সামরিক নেতারা শান্তি আলোচনার প্রস্তাব দেবে এবং সম্ভবত গণতন্ত্র ফিরে আসবে।”

এদিকে ফালামের সংঘাতের কারণে বাস্তুচ্যুত হওয়া মানুষের মধ্যে একটি নতুন প্রজন্ম লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

১৫ বছর বয়সী জুনিয়র চিনের একটি হাসপাতাল ক্যাম্পে সহকারী হিসেবে কাজ করেন।

আল জাজিরাকে তিনি বলেন, “আমি যা পারি, তা করব। মিয়ানমারে পড়ালেখার কোনও সুযোগ নেই। আমি চাই না ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হোক।”

চিন প্রতিরোধে বিভাজন

মিয়ানমারের চিন রাজ্যে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হলেও বিদ্রোহীদের মধ্যেই অভ্যন্তরীণ বিভাজন তৈরি হয়েছে। চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (সিএনএফ) ও তার মিত্রদের নেতৃত্বে একদল রয়েছে, যা ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত। অন্যদিকে চিন ব্রাদারহুড (সিবি) নামে আরেকটি গোষ্ঠী ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর গঠিত ছয়টি প্রতিরোধ বাহিনীকে নিয়ে সংগঠিত হয়েছে। এর মধ্যে চিন ন্যাশনাল ডিফেন্স ফোর্স (সিএনডিএফ) অন্যতম।

তাদের প্রধান মতপার্থক্য চিন রাজ্যের ভবিষ্যৎ শাসনব্যবস্থা নিয়ে। সিএনএফ ভাষাভিত্তিক শাসন কাঠামোকে সমর্থন করে। অন্যদিকে সিবি শহরভিত্তিক প্রশাসন চায়। এই পার্থক্য ক্ষমতার বণ্টনেও প্রভাব ফেলছে। জাতিগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও ঐতিহ্যগত অবিশ্বাসের সম্পর্কের কারণে কখনও কখনও তাদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে।

মিয়ানমার-বিষয়ক বিশ্লেষক আর লাখ এই বিভাজনকে ‘গুরুতর’ বলে মন্তব্য করেছেন। তবে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মিজোরামের মধ্যস্থতায় সংলাপের কিছু অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে।

গত ২৬ ফেব্রুয়ারি প্রতিদ্বন্দ্বী দুই গোষ্ঠী একসঙ্গে কাজ করতে সম্মত হয়েছে এবং নতুন একটি সংগঠন, চিন ন্যাশনাল কাউন্সিল (সিএনসি) গঠনের ঘোষণা দিয়েছে। এর লক্ষ্য একক সামরিক নেতৃত্বের অধীনে চিন অঞ্চলের বিভিন্ন প্রতিরোধ বাহিনীকে ঐক্যবদ্ধ করা।

এই উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন লাখ। তবে তিনি সতর্ক করে বলেছেন, “প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত সুপরিকল্পিত ও কাঠামোবদ্ধ হতে হবে। শুধু আন্দোলনকারীরা নয়, উভয় পক্ষের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতাদেরও সম্পৃক্ত করতে হবে। চিন জনগণ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সামরিক শাসন থেকে মুক্তির পরও অনেক মানুষ অভ্যন্তরীণ সংঘাতের কারণে বাড়ি ফিরতে পারছে না।”

ফালাম শহর দখল বিদ্রোহীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হয়ে উঠেছে।

লাখ বলেন, “ফালাম দখল হলে, পাশের টেডিম শহর সহজেই বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। এটি সিবির জন্য আরও এলাকা মুক্ত করতে সাহায্য করবে এবং সিএনএফ জোটের সঙ্গে তাদের আলোচনার অবস্থান শক্তিশালী করবে।”

তিনি আরও বলেন, বর্তমানে চিন রাজ্যের ৭০ শতাংশের বেশি এলাকা সেনাবাহিনীমুক্ত। তবে বিদ্রোহীদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ একতা ধরে রাখা।

মিয়ানমারের ছায়া সরকার হিসেবে পরিচিত জাতীয় ঐক্য সরকারের (এনইউজি) প্রসঙ্গ টেনে লাখ বলেন, “এনইউজির দায়িত্ব হলো সব গণতান্ত্রিক শক্তিকে একত্রিত করা। কারণ বিভিন্ন জাতিগত ও রাজনৈতিক সশস্ত্র গোষ্ঠী রয়েছে, তাদের অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষের ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। জাতিগত অঞ্চলে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হয়ে পড়েছে। কিন্তু বামার জনগোষ্ঠীর এলাকাগুলো এখনও জান্তার অধীনে রয়েছে। মিয়ানমারের বিপ্লবের ভবিষ্যৎ এখন বামার জনগণের ওপর নির্ভর করছে।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত