পরিবারের সদস্যদের দেখভাল, অসুস্থ রোগীর সেবা করার মতো নারীর নিত্যদিনের অবৈতনিক কাজের স্বীকৃতি দেওয়া নিয়ে বিতর্ক নতুন নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নারীর এসব কাজ ‘কেয়ার ইকোনমি’র জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তাই নারীর প্রতি আচরণগত পরিবর্তন, জেন্ডার বৈষম্য রোধের পাশাপাশি তার পেশার প্রতিও গতানুগতিক ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
সোমবার ঢাকার একটি হোটেলে ‘বাংলাদেশে কেয়ার ইকোনমির জন্য একটি কৌশলগত রোডম্যাপ তৈরি’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় এসব কথা উঠে আসে। আয়াত এডুকেশন এই আলোচনার আয়োজন করেছিল।
নিজের বক্তব্যে বেসরকারি সংস্থা অ্যাকশন এইডের নির্বাহী পরিচালক ফারাহ কবির বলেন, “নারীর অবৈতনিক কাজকে যেমন স্বীকৃতি দেওয়া হয়না, তেমনি তাদের মানসিক স্বাস্থ্য ও মর্যাদার কথাও ভাবাও হয়না। ফলে এটি একদিকে যেমন নারীর পেশাগত স্বীকৃতিকে বাধা দেয় তেমনি এটি জিডিপিতে নারীর অংশগ্রহণকেও অবমূল্যায়িত করে।”
এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের জেন্ডার ও সোশ্যাল ইনক্লুশন স্পেশালিস্ট নাসিবা সেলিম একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।
সেখানে বলা হয়, মানুষের আচরণগত পরিবর্তন, জেন্ডার বৈষম্যের পাশাপাশি নারীর পেশার প্রতি গতানুগতিক ধারণার পরিবর্তন আনতে হবে।
বাংলাদেশে নারীরাই পরিচর্যামূলক কাজের বোঝা বেশি বহন করলেও তার যথাযথ স্বীকৃতি পাওয়া যায় না বলে মনে করেন গোলটেবিলের সঞ্চালক ও আয়াত এডুকেশনের সিইও নুসরাত আমান।
এ প্রসঙ্গে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, “এসব কাজের সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত, তাদের কাজের অবশ্যই অর্থনৈতিক মূল্য রয়েছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তাদের কাজকে অর্থনৈতিক মানদণ্ডে মূল্যায়ন করা হয় না, যার ফলে এই খাতে আমরা নারীর অবদানকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারি না।”
আলোচনায় উঠে আসে কিছু পরিসংখ্যানও। সেখানে দেখানো হয়, ২০২২ সালে জনসংখ্যা ও আবাসন শুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশে ৬০ বা এর বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা ১৫ দশমিক তিন মিলিয়ন বা ১৩ লাখ। যা মোট জনসংখ্যার নয় দশমিক ২৮ শতাংশ।
অর্থাৎ, এই বিপুল পরিমাণ বয়স্ক বা অসুস্থ মানুষের দেখভালের জন্য কেয়ার গিভারের চাহিদা বাড়বে।
ফলে এই খাতে সরকারি-বেসরকারি টেকসই বিনিয়োগ বৃদ্ধি, সহায়ক কৌশলগত পরিকল্পনা এবং পলিসি প্রয়োজন বলে মনে করেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি। তিনি বলেন, এসব কেয়ার গিভারদেরকে মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন ও দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর করা প্রয়োজন।
কেয়ার গিভিং পেশার আধুনিকায়ন ও যুগোপযোগী করার মাধ্যমে সমাজ ও পরিবারের অসুস্থ সদস্যদের জন্য বাড়তি কাজের দায়িত্বকে সুষ্ঠুভাবে বন্টন করা সম্ভব বলে মনে করেন বক্তারা।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে সমাজকল্যাণ মন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, “সমাজে যেখানে অর্থ প্রাপ্তির সুযোগ আছে সেখানে পুরুষের অংশগ্রহণ। আর যেখানে অর্থ প্রাপ্তির সুযোগ নেই সেখানে নারীরা জড়িত।”
নারীর অগ্রযাত্রাকে গতিশীল রাখতে তার কাজকে মর্যাদা ও স্বীকৃতি দেওয়া জরুরি উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমরা গৃহস্থালি কাজে নারীর শ্রমের অবদানকে স্বীকৃতি দেই না। এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনা খুব জরুরি।”
দেশের পাশাপাশি বিদেশেও কেয়ার গিভার পাঠানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে জানিয়ে দীপু মনি বলেন, “আগামী দিনে এটি একটি কর্মসংস্থানের সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে তৈরি হবে, তাই এই খাতকে সমৃদ্ধ করার এখনই সঠিক সময়।”
এই খাতকে এগিয়ে নিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়কেও এগিয়ে আসতে আহ্বান জানালেন তিনি।
মন্ত্রী বলেন, “সবাই মিলে চেষ্টা করলে এই কেয়ার ইকোনমিটাকে আরও সুবিন্যস্তভাবে গড়ে তোলা সম্ভব, পাশাপাশি এই খাতে যারা কর্মরত আছেন, তাদের সার্বিক সুস্থতার জন্যও সবাইকে ভাবতে হবে।”
আলোচনায় একটি সমৃদ্ধ কেয়ার ইকোনমির জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে পরিচর্যা বিষয়ে অবকাঠামো তৈরি ও প্রয়োজনীয় বিনিযোগ, পরিচর্যার কাজকে উৎসাহিত করার জন্য নীতি সংস্কার, পরিচর্যা কাজে জেন্ডার সমতা আনার লক্ষ্যে সচেতনতামূলক প্রচার ও শিক্ষামূলক উদ্যোগ নেওয়া, পেশাদারিত্ব বৃদ্ধিতে প্রশিক্ষণ কর্মসূচিকে আরও উন্নত করার সুপারিশ করা হয়।