সংবিধানের সংস্কারে গঠিত কমিশনের প্রতিবেদন চূড়ান্ত হয়েছে, তাদের সুপারিশ গ্রহণ করা হলে বদলে যাবে বাংলাদেশের সাংবিধানিক বাংলা নাম। বদলে যাবে রাষ্ট্রের মূল নীতিও; সেখানে ধর্ম নিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র পড়বে বাদ।
বর্তমান ৩৫০ আসনের এক কক্ষের সংসদ ভেঙে ৫০৫ আসনের দুই কক্ষের পার্লামেন্ট গঠনের প্রস্তাব সংস্কার কমিশন রেখেছে। সেখানে নিম্ন কক্ষ হবে ৪০০ আসনের, উচ্চ কক্ষ হবে ১০৫ আসনের। পার্লামেন্টের মেয়াদ হবে চার বছর। সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ন্যূনতম বয়স কমিয়ে ২১ করার সুপারিশ করা হয়েছে।
রাষ্ট্রের তিন অঙ্গ আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও শাসন বিভাগের মধ্যে সমন্বয় রাখতে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল বা এনসিসি নামে নতুন একটি অঙ্গ গঠনের সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন। এই কমিশনের সুপারিশেই কেবল জরুরি অবস্থা জারি করা যাবে। প্রস্তাব করা হয়েছে দুই নির্বাচনের মধ্যবর্তী সময়ে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচন সংসদের মাধ্যমে না করে ইলেকটোরাল ভোটে করার নতুন একটি পদ্ধতির সুপারিশ করা হয়েছে কমিশনের প্রতিবেদনে। তাতে আরও বলা হয়েছে, কেউ দুই বারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না, আর প্রধানমন্ত্রী হলে কোনও রাজনৈতিক দলের প্রধান কিংবা সংসদ নেতার পদে থাকতে পারবেন না।
সংবিধান সংস্কার কমিশন বুধবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর সরবরাহ করা সার-সংক্ষেপে এই বিষয়গুলো দেখা যায়।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারে কমিশন গঠন করে। সংবিধান সংস্কারে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিককে প্রধান করে কমিশন গঠনের ঘোষণা দেওয়া হলেও তিনি অপরাগতা জানান।
এরপর যুক্তরাষ্ট্রের ইলিয়ন স্টেট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক আলী রীয়াজকে প্রধান করে গত ৬ অক্টোবর গঠিত হয় সংবিধান সংস্কার কমিশন।
রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক ও আলোচনা শেষে এই প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে তিন মাস পর আলী রীয়াজের নেতৃত্বে কমিশনের সদস্যরা প্রধান উপদেষ্টার হাতে তাদের প্রতিবেদন তুলে দেন।
এরপর সংস্কার কমিশনের ওয়েবসাইটে তাদের প্রতিবেদনের সার-সংক্ষেপ তুলে ধরা হয়। ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী এই কমিশনের সদস্যরা হলেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক সুমাইয়া খায়ের ও অধ্যাপক মুহাম্মদ ইকরামুল হক, ব্যারিস্টার ইমরান সিদ্দিকী, আইনজীবী শরীফ ভূঁইয়া, ব্যারিস্টার এম মঈন আলম ফিরোজী, কলামনিস্ট ফিরোজ আহমেদ, মানবাধিকারকর্মী মো. মুস্তাইন বিল্লাহ ও সালেহ উদ্দিন সিফাত।
মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর সংবিধান প্রণয়নের পর ওই বছরের ১৬ ডিসেম্বর তা কার্যকর হয়।
এরপর বিভিন্ন সময়ে এই পর্যন্ত ১৭ বার সংশোধন হয়েছে। ২০১৮ সালের ৮ জুলাই সর্বশেষ সংশোধনে সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত ৫০ আসনের মেয়াদ আরও ২৫ বছর বাড়ানো হয়।
এর আগে বিভিন্ন সময়ে সংবিধান সংশোধিত হলেও এভাবে খোলনলচে বদলে দেওয়ার উদ্যোগ আগে কখনও নেওয়া হয়নি।
অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছেন, তারা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করবেন।
আলী রীয়াজ সাংবাদিকদের বলেছেন, “একটা ব্যাপক গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে স্বপ্ন, সেই স্বপ্নের ধারাবাহিকতায় আজকে আসলে কমিশনের পক্ষ থেকে আমরা এই প্রস্তাবগুলো, সুপারিশগুলো রাখছি। আমরা আশা করছি, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো এক ধরনের ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারবে।”
সংস্কার প্রতিবেদনগুলো নিয়ে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসতে চাইছে অন্তর্বর্তী সরকার। তবে বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান প্রণয়নে নেতৃত্ব দেওয়া আওয়ামী লীগ এই আলোচনায় ডাক পাবে কি না, তা এখনও নিশ্চিত নয়।
ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগকে রাজনীতিতে সক্রিয় হতে না দেওয়ার ঘোষণা রয়েছে অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের। তবে আওয়ামী লীগ বলেছে, তাদের বাদ দিয়ে কিছু করা হলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না।
নাম-মূলনীতিতে পরিবর্তন
সংস্কার কমিশনের সুপারিশ গ্রহণ করা হলে বাংলাদেশের সংবিধানের শিরোনামই পাল্টে যাবে। এখন শিরোনাম রয়েছে- “গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান’। বদলে গিয়ে তা হবে ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান’।
কমিশন সংিবধানে ‘প্রজাতন্ত্র’ ও ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ এর পরিবর্তে ‘নাগরিকতন্ত্র’ ও ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ লেখার প্রস্তাব করেছে। তবে ইংরেজি নাম ‘রিপাবলিক’ ও ‘পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’ অবিকৃতই থাকবে।
এবিষয়ে আলী রীয়াজ বলেন, “বাংলাদেশকে যেভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ বলা হয়, তার মধ্যে আসলে যে প্রজাতন্ত্রের কথা হয়, সেটায় আমরা দ্বিমত পোষণ করেছি। আমরা বলেছি, বাংলাদেশের পরিচিত হওয়া উচিত ‘জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশ’।”
সংবিধানের বর্তমান চার মূলনীতির মধ্যে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিয়ে গণতন্ত্র রেখে নতুন অন্য চারটি অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করেছে সংস্কার কমিশন। সেগুলো হলো- সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্র।
বাহাত্তরে সংবিধানের এই মূলনীতিগুলো মাঝে জিয়াউর রহমান ও এইচ এরশাদের সামরিক শাসনামলে পরিবর্তিত হয়েছিল। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর আগের মূলনীতিগুলো ফেরায়।
এখন পাঁচটি মূলনীতি গ্রহণের বিষয়ে কমিশনের আলী রীয়াজ বলেন, “১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের মহান আদর্শ এবং ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের যে জনআকাঙ্ক্ষা, তার প্রতিফলন হিসেবে আমরা রাষ্ট্রের পাঁচটি মূলনীতি সুপারিশ করছি। সেগুলো হচ্ছে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ এবং গণতন্ত্র।”
মূলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ এবং এগুলোর সংশ্লিষ্ট সংবিধানের ৮, ৯, ১০ ও ১২ অনুচ্ছেদগুলো বাদ দেওয়ার সুপারিশ করছে সংস্কার কমিশন।
জিয়াউর রহমান সংবিধান থেকে ধর্ম নিরপেক্ষতা বাদ দিয়ে ‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ সংযোজন করেছিলেন। এরশাদ তা থেকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করেছিলেন। আওয়ামী লীগ মূলনীতিতে ধর্ম নিরপেক্ষতা ফেরালেও সংবিধানের ২ (ক) ধারায় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রেখেই দিয়েছিল।
বহু কিছু বদলে দিতে চাওয়ার মধ্যে এখন তা থাকবে কি না, তা সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের সার সংক্ষেপে স্পষ্ট হয়নি।
আলী রীয়াজ বলেন, “আমাদের লক্ষ্য ছিল সুস্পষ্ট- কার্যকর গণতন্ত্র, মৌলিক মানবাধিকার সুনিশ্চিতকরণ এবং জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা। সেদিক থেকে বিবেচনা করে আমরা সংবিধানের যে ধারাগুলোর, যে বিষয়গুলোর সংস্কার করা দরকার, সেগুলো আমরা বলেছি।”
অসাংবিধানিক পদ্ধতিতে সংবিধান সংশোধন করলে মৃত্যুদণ্ডের িবধান এবং সংবিধানের প্রথম ভাগের মৌলিক বিধানাবলি পরিবর্তনের ক্ষমতা রহিতের যে বিধান রয়েছে, সেগুলো বাতিলের সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন।
সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে কমিশনের সুপারিশ হচ্ছে, যেকোনো সংশোধনে উভয় কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার অনুমোদন প্রয়োজন হবে। প্রস্তাবিত সংশোধনী উভয় কক্ষে পাস হলে, এটি গণভোটে উপস্থাপন করা হবে। গণভোটের ফলাফল সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে।
দুই কক্ষের পার্লামেন্ট
সংস্কার কমিশন দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার প্রস্তাব করেছে। এরমধ্যে একটি নিম্নকক্ষ বা জাতীয় সংসদ (ন্যাশনাল এসেম্বলি) এবং একটি উচ্চকক্ষ (সিনেট)। উভয় কক্ষের মেয়াদ হবে চার বছর।
নিম্নকক্ষ গঠিত হবে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে সরাসরি নির্বাচিতদের নিয়ে। ৪০০ আসন নিয়ে নিম্নকক্ষ গঠিত হবে। ৩০০ জন সদস্য একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকা থেকে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবে। বাকি ১০০ জন নারী সদস্য দেশের সব জেলা থেকে নির্ধারিত ১০০ নির্বাচনী এলাকা থেকে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবে। এই ১০০ আসনে কেবল প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে।
রাজনৈতিক দলগুলো নিম্নকক্ষের মোট আসনের ন্যূনতম ১০ শতাশ আসনে তরুণ-তরুণীদের মধ্য থেকে প্রার্থী মনোনীত করবে। তবে তরুণ-তরুণীর বয়সের সীমারেখা দেওয়া হয়নি সুপারিশে।
সংসদীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ন্যূনতম বয়স কমিয়ে ২১ বছর করার সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন।
নিম্ন কক্ষ বা সংসদে দুজন ডেপুটি স্পিকার থাকবেন, যাদের মধ্যে একজন বিরোধী দল থেকে মনোনীত হবেন। নিম্নকক্ষের সদস্যরা অর্থবিল ছাড়া অন্য যে কোনও বিষয়ে দলের বিপক্ষে ভোট দিতে পারবে। বর্তমানে ৭০ অনুচ্ছেদের কারণ সংসদ সদস্যরা দলের বিপক্ষে ভোট দিতে পারেন না।
উচ্চকক্ষ মোট ১০৫ জন সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত হবে। এর মধ্যে ১০০ জন সদস্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রদত্ত মোট ভোটের সংখ্যানুপাতে নির্ধারিত হবে। রাজনৈতিক দলগুলো সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির ভিত্তিতে উচ্চকক্ষের মনোনয়ের জন্য সর্বোচ্চ ১০০ জন প্রার্থী মনোনয়ন দিতে পারবে।
এই ১০০ জন প্রার্থীর মধ্যে কমপক্ষে ৫ জন আইন দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে- সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করবে। অবশিষ্ট ৫টি আসন পূরণের জন্য রাষ্ট্রপতি নাগরিকদের মধ্য থেকে (যারা কোনও কক্ষেরই সদস্য ও রাজনৈতিক দলের সদস্য নন) প্রার্থী মনোনীত করবেন।
কোনো রাজনৈতিক দলকে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির ভিত্তিতে উচ্চকক্ষে প্রতিনিধিত্বের যোগ্য হতে হলে- জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের অন্তত ১ শতাংশ নিশ্চিত করতে হবে।
উচ্চকক্ষের স্পিকার সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে উচ্চকক্ষের সদস্যদের মধ্য থেকে নির্বাচিত হবেন। উচ্চকক্ষের একজন ডেপুটি স্পিকার থাকবেন, যিনি সরকারি দলের সদস্য হবেন না।
দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ চালুর প্রস্তাব নিয়ে আলী রীয়াজ বলেন, “দুই কক্ষ মিলে যাতে সকলের প্রতিনিধিত্ব থাকে, তার জন্য একইসঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে নিম্নকক্ষ, কিন্তু সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বে উচ্চকক্ষ তৈরি করার জন্য সুপারিশ করেছি।”
জাতীয় স্বার্থ বা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা প্রভাবিত করে এমন কোনও আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদনের আগে আইনসভার উভয় কক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে অনুমোদন নিতে হবে।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী
বর্তমানে সংসদ সদস্যদের ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়ে এলেও সেখানে পরিবর্তনের সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন।
কমিশন মনে করে রাষ্ট্রপতির নির্বাচনের যে পদ্ধতি এখন রয়েছে, তাতে ব্যক্তির ইচ্ছা প্রতিফলিত হয়। তাই তারা সুপারিশ করেছে, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করবে একটি ইলেকটোরাল কলেজ। এই ইলেকটোরাল কলেজে পার্লামেন্টের উচ্চ ও নিম্ন কক্ষের সদস্যদের সঙ্গে ভোটার হবে প্রতিটি জেলা কাউন্সিল ও সিটি করপোরেশন কাউন্সিল। এক্ষেত্রে প্রতিটি জেলা কাউন্সিল থেকে একটি ও সিটি কাউন্সিল থেকে একটি ভোট হবে।
আলী রীয়াজ বলেন, “রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের যে পদ্ধতি তৈরি করা হয়েছে, তাতে ব্যক্তির ইচ্ছা প্রতিফলিত হয় বলে আমরা প্রেসিডেন্ট নির্বাচন পদ্ধতি পরিবর্তনের পরামর্শ দিয়েছি। এক ধরনের নির্বাচকমণ্ডলীর মধ্য দিয়ে যেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, আমরা সেই সুপারিশ করেছি।”
রাষ্ট্রপতি পদে কেউ দুই বারের বেশি থাকতে পারবেন না। রাষ্ট্রদ্রোহ, গুরুতর অসদাচরণ বা সংবিধান লঙ্ঘনের জন্য রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসন করা যাবে। নিম্নকক্ষ অভিশংসন প্রস্তাবটি পাস করার পর তা উচ্চকক্ষে যাবে এবং সেখানে শুনানির মাধ্যমে অভিশংসন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে।
কমিশন রাষ্ট্রপতির কিছু সুনির্দিষ্ট দায়িত্বের কথা সুপারিশ করছে। এই বিশেষ কার্যাবলী কিংবা সংবিধানে উল্লেখিত বিষয় ছাড়া অন্য সকল বিষয়ে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে কাজ করবেন।
প্রধানমন্ত্রী হবেন পার্লামেন্ট সদস্যদের ভোটে। কেউ দুই বারের বেশি এই পদে থাকতে পারবেন না, সেই সুপারিশ রেখেছে সংস্কার কমিশন। সেই সঙ্গে বলেছে, একজন সংসদ সদস্য একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা এবং রাজনৈতিক দলের প্রধানের পদে থাকতে পারবেন না।
প্রধানমন্ত্রীর বিষয়ে সংসদে অনাস্থা ভোটের সুযোগ ফেরানোর অংশ হিসেবে ৭০ অনুচ্ছেদ কেন্দ্রীক কিছু পরিবর্তনের সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন।
আলী রীয়াজ বলেন, “আমরা মনে করি, প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় সংসদে অনাস্থা ভোটের মুখোমুখি হওয়া দরকার, সে ব্যবস্থা করা দরকার। সে কারণে ৭০ অনুচ্ছেদ দ্বারা যাতে প্রধানমন্ত্রী কেবলমাত্র সুরক্ষিত না হন, সেজন্য আমরা তার কিছু সংস্কারের প্রস্তাব করেছি।”
জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল
কমিশন মনে করে, গত ১৬ বছর বাংলাদেশ যে ‘স্বৈরতন্ত্রের’ মোকাবেলা করেছে, তার অন্যতম কারণ হচ্ছে ক্ষমতার কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ভারসাম্য ছিল না। সে কারণে যাতে একক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হতে না পারে, সেজন্য রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ ও নির্বাহী বিভাগের দুটি পদ- প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য কমিশন চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স হিসাবে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল নামে একটি সাংবিধানিক সংস্থা প্রবর্তনের সুপারিশ করেছে।
প্রস্তাবিত কমিশন থাকবেন রাষ্ট্রপতি, প্রধান বিচারপতি, সংসদের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলীয় নেতা, দুই কক্ষের স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার যারা আসবেন বিরোধী দল থেকে এবং একজন থাকবেন যিনি অন্যান্য দলগুলোর প্রতিনিধিত্ব করবেন।
আলী রীয়াজ বলেন, “এটা প্রায় স্পষ্ট যে প্রধানমন্ত্রী পদের একচ্ছত্র ক্ষমতা হ্রাস করা জরুরি এবং যাতে করে তিনি একক ইচ্ছায় নির্বাচন কমিশনসহ অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান এবং সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানদের নিয়োগ দিতে না পারেন, এজন্য এগুলোকে কমিশন জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের কাছে অর্পণ করার সুপারিশ করেছে।”
একমাত্র জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্তেই রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারবেন, এই সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন। তবে কমিশন মনে করে, জরুরি অবস্থার সময়ও নাগরিকদের কোনও অধিকার রদ বা স্থগিত করা যাবে না।
নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার
কমিশন অন্তর্বর্তী সরকারের সুস্পষ্ট কাঠামোর পরামর্শ দিয়েছে এবং সেক্ষেত্রে কমিশন মনে করে যে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা বাছাইয়ের দায়িত্বভার কোনো ব্যক্তি বা একক কোনো প্রতিষ্ঠানের ওপর থাকা ঠিক না, সেজন্য এই দায়িত্ব জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের ওপর দেওয়ার সুপারিশ রেখেছে।
আলী রীয়াজ বলেন, “আমরা মনে করি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা পদে বাছাইয়ের দায়িত্বভার কোনো ব্যক্তি বা একক প্রতিষ্ঠানের ওপর থাকা ঠিক নয়। সে কারণে আমরা জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের কাছে এই বাছাই প্রক্রিয়া অর্পণ করেছি বা সুপারিশ করেছি। আমরা আশা করছি, সেটা সম্ভব হবে।”
কমিশনের সুপারিশে আইনসভার মেয়াদ শেষের ১৫ দিন আগে অথবা ভেঙে দেওয়া হলে তার ১৫ দিনের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন। এই অন্তর্বর্তী সরকারের সদস্য সংখ্যা হবে ১৫ এবং মেয়াদ হবে সর্বোচ্চ ৯০ দিন।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নির্ধারণ করবে জাতীয় সাংবিধানকি কাউন্সিল। কাউন্সিলের ৯ সদস্যের মধ্যে ন্যূনতম ৭ জন সদস্যের সিদ্ধান্তে কেউ প্রধান উপদেষ্টা হতে পারবেন ।
বিচার বিভাগ
কমিশন বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণের সুপারিশ করেছে। কমিশন বলছে, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হলে এবং ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার সুগম করতে হলে এবং সবার কাছে পৌঁছে দিতে হলে কমিশন মনে করে বিচারবিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ করা দরকার।
কমিশন সুপ্রিম কোর্টের একক চরিত্র অক্ষুণ্ণ রেখেই দেশের সব বিভাগীয় শহরে হাই কোর্ট বিভাগের মর্যাদা এবং এখতিয়ার-সম্পন্ন একটি একক স্থায়ী আসন প্রবর্তনের সুপারিশ করেছে।
স্থানীয় সরকার
কমিশন মনে করে, একটি শক্তিশালী স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা থাকা জরুরি, সেজন্য কমিশন স্থানীয় সরকার কমিশন গঠনের সুপারিশ করেছে। তারা জেলা ও সিটি করপোরেশন পর্যায়ে সমন্বয়ক কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাবও করেছে।
এছাড়া কমিশন মৌলিক অধিকারের আওতা সম্প্রসারণের কথা বলেছে এবং সেগুলোকে সাংবিধানিকভাবে সুরক্ষার জন্য একটি সমন্বিত একক সনদের সুপারিশ করেছে।