Beta
রবিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৫
Beta
রবিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৫

লাল সাগরে সংঘাত আঁচ ফেলছে বাংলাদেশেও

ইউরোপের সঙ্গে এশিয়ার বাণিজ্য মূলত লোহিত সাগর দিয়েই চলে।
ইউরোপের সঙ্গে এশিয়ার বাণিজ্য মূলত লোহিত সাগর দিয়েই চলে।
[publishpress_authors_box]

এক হাজার বছর আগে ভাস্কো দা গামা আফ্রিকা ঘুরে এসেছিলেন ভারতে। তার ৪০০ বছর পরে সুয়েজ খাল খনন হলে রেড সি বা লোহিত সাগর হয়ে বাণিজ্য পথ চালু হয়। তা কমিয়ে দেয় এশিয়ার সঙ্গে ইউরোপের পণ্য বাণিজ্যে সময় ও অর্থের ব্যয়।

তবে সম্প্রতি ইয়েমেনের হুতিদের হামলার কারণে পণ্যবাহী জাহাজগুলো লোহিত সাগর এড়িয়ে চলায় বিশ্ববাণিজ্যে পড়ছে তার প্রভাব। এর আঁচ লাগছে বাংলাদেশেও।

দেশের ব্যবসায়ীরা বলছেন, লোহিত সাগরের বর্তমান অস্থিরতার কারণে উচ্চ ফ্রেইট চার্জ, বেশি লিড টাইম এবং রপ্তানিকারক ও আমদানিকারকদের জন্য কনটেইনারের সংকট তৈরি হয়েছে।

গত ৩ ডিসেম্বর থেকে ইয়েমেনের ইরান সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীরা লোহিত সাগরের সমুদ্রগামী জাহাজে হামলা চালাচ্ছে। গাজায় ইসরায়েলি হামলার প্রতিক্রিয়ায় তাদের এই পদক্ষেপ।

এরপরেই অধিকাংশ বাণিজ্যিক জাহাজ সংস্থা ঠিক করে, তারা লোহিত সাগর এড়িয়ে অন্য পথ বেছে নেবে। শিপিং কোম্পানিগুলো ভিন্ন পথে পণ্য পরিবহনের কথা উল্লেখ করে সারচার্জ আরোপ করায় বাংলাদেশ থেকে ইউরোপ ও আমেরিকায় কনটেইনার পরিবহনের ফ্রেইট চার্জ ইতোমধ্যে অন্তত ৪০ শতাংশ বেড়েছে বলে ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন। 

বাংলাদেশে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় সব কটি শিপিং কোম্পানির ব্যবসা রয়েছে। শিপিং–বিষয়ক তথ্য সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান আলফালাইনারের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের শীর্ষ পাঁচ শিপিং কোম্পানি হলো এমএসসি, মায়ারস্ক, সিএমএ–সিজিএম, কসকো ও হাপাগ লয়েড। এ পাঁচটি কোম্পানি বাংলাদেশের আমদানি–রপ্তানি পণ্যের প্রায় অর্ধেক কনটেইনারে পরিবহন করে। 

লোহিত সাগর যে কারণে গুরুত্বপূর্ণ  

এশিয়া থেকে ইউরোপের পথে লোহিত সাগর হলো সবচেয়ে সহজ রাস্তা। সুয়েজ খাল দিয়ে বিশ্বের ১২ শতাংশ বাণিজ্য সঞ্চালিত হয়। সেই ব্যস্ত পথ এখন কার্যত খালি। 

লোহিত সাগর থেকে সুয়েজ খাল ধরে ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে যাওয়া যায় ইউরোপে। এই পথ এড়াতে হলে আফ্রিকার উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে যেতে হয়। এখন আফ্রিকার সেই ঘুরপথেই চলাচল করছে অধিকাংশ পণ্যবাহী জাহাজ।

লোহিত সাগরের বাণিজ্যপথ এড়াতে হলে জাহাজগুলোকে আফ্রিকা ঘুরে যেতে হয় ইউরোপ ও আমেরিকার পূর্ব উপকূলে।

এর ফলে জাহাজগুলোর চলাচলের সময় অন্তত এক সপ্তাহ বেড়ে গেছে। পাড়ি দিতে হচ্ছে অতিরিক্ত তিন হাজার ৫০০ নটিকাল মাইল। এশিয়া থেকে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব উপকূলে পণ্য পরিবহনে দুই সপ্তাহ বেশি সময় লাগছে। তাই শিপিং কোম্পানিগুলো এ জন্য বাড়তি খরচ গ্রাহকদের কাছ থেকে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। 

বাংলাদেশের বাণিজ্যে প্রভাব 

শিপিং কোম্পানিগুলোর বাড়তি মাশুল আরোপের প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশেও। কারণ, বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি পণ্যের বড় অংশই যায় এই পথে। অবশ্য আমদানি পণ্যের এক–দশমাংশ আনা হয় এই পথ ব্যবহার করে।  

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি পণ্যের ৬৩ শতাংশের গন্তব্য ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের আমদানি পণ্যের ৮ শতাংশ আসে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে। সেই হিসাবে, লোহিত সাগরের সংকটে বাংলাদেশের প্রায় ৪ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের আমদানি–রপ্তানি পণ্য পরিবহনে বাড়তি মাশুল গুনতে হবে। 

বাড়তি মাশুলের কারণে মূলত বাংলাদেশের আমদানিকারকেরা সরাসরি ভুক্তভোগী হবেন। পণ্য আমদানিতে তাদের বাড়তি ভাড়া দিতে হবে।

অবশ্য আমদানি বাণিজ্যের বড় অংশে এই প্রভাব পড়বে না। কারণ, বাংলাদেশের পণ্য আমদানির বড় উৎস এশিয়ার দেশগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চীন, ভারত, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া এই চার দেশ থেকে আমদানি পণ্যের ৫০ শতাংশ এসেছে গত ২০২২–২৩ অর্থবছরে। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছে ৮ শতাংশ। 

তবে বাড়তি মাশুলের কারণে বাংলাদেশি পণ্যের ইউরোপ–যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। কারণ, রপ্তানি পণ্য পরিবহনের ভাড়া পরিশোধ করেন বিদেশি ক্রেতারা। 

রপ্তানিকারকদের সংকট 

আমদানি কম হলেও বাংলাদেশের রপ্তানির মূল রাস্তা এটি।

ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, সারচার্জ আরোপের ঘোষণায় কনটেইনার পরিবহনের ভাড়া দ্বিগুণের কাছাকাছি বেড়ে যাচ্ছে। লোহিত সাগরের সংকট এ ভাড়া বাড়িয়ে দিচ্ছে। 

সাধারণত বিদেশি ক্রেতারাই পরিবহন খরচটি বহন করে। তবে বিদেশি ক্রেতারা বাড়তি মাশুল পরিশোধ করলেও দেশীয় রপ্তানিকারকদেরও ভুগতে হতে পারে বলে মনে করছেন রপ্তানিকারকেরাও।  

বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের জাহাজীকরণ হয় মূলত চট্টগ্রাম বন্দরে।

তৈরি পোশাক শিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহ-সভাপতি শহিদুল আজিম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এখনও ক্রয় আদেশ বাতিল হয়েছে এরকম কিছু আমি শুনি নাই। তবে এটা নিয়ে আমরা এবং বায়াররা উভয়ই দুশ্চিন্তার মধ্যে আছি।”

দুশ্চিন্তার কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “প্রচুর খরচ বেড়ে যাচ্ছে। ট্রান্সপোর্টের সময় ১৫-১৬ দিন বেড়ে যাচ্ছে। এর ফলে আমাদের প্রোডাক্ট পৌছানোর লিড টাইম ঠিক রাখতে পারছি না।”

পরিবহন খরচ বিদেশি ক্রেতারা পরিশোধ করলে দেশের রপ্তানিকারকরাদের দুশ্চিন্তা কেন- প্রশ্নে বিজিএমইএ সহসভাপতি আজিম বলেন, “ট্রান্সপোর্ট খরচ বেড়ে গেলে ওরা আমাদের পোশাকের দাম বাড়ানো তো দূরে থাক, বরং তারা কমিয়ে দিতে পারে।

“খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণে পোশাকের দাম যখন বেড়ে যাবে, তখন ক্রেতারা খুঁজবে কোথা থেকে কম দামে পোশাক পাওয়া যায়। দেখা গেল, আমাদের এখান থেকে ক্রয় আদেশ কমে যাচ্ছে।”

অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুরের শঙ্কা, লোহিত সাগরে সংঘাতের একটা ধাক্কা বাংলাদেশে লাগতে পারে।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “রপ্তানি বাণিজ্যে একটা ধাক্কা খেতে পারে। কারণ ইউরোপ আমেরিকা পণ্য পরিবহনের এইটাই মূল পথ। এর ফলে বিদেশি ক্রেতাদের খরচ অনেক বেড়ে যাবে, এর ফলে পণ্য কেনার পরিমাণ কমে যাবে। সময়মত পণ্য না পৌঁছানোর কারণে পণ্যের দাম পেতে রপ্তানিকারকদের সমস্যা হবে।”

তবে এই সংকট বেশিদিন স্থায়ী হবে না বলে মনে করেন আহসান মনসুর।

তার ভাষ্যে, “এ সংকট শুধু আমাদের না। যারাই ইউরোপ বা আমেরিকায় রপ্তানি করে এমন সকল দেশের জন্যই সংকট। ফলে সবাই মিলে নিশ্চয় এ সংকট দূর করার জন্য একত্রে কাজ করবে।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত