লোহিত সাগর এড়িয়ে চলছে বিশ্বের বৃহত্তম শিপিং কোম্পানিগুলো। এতে বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থায় গুরুতর জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে।
ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা লোহিত সাগরে চলাচলকারী বাণিজ্যিক জাহাজে ক্রমাগত হামলা চালাচ্ছে। এ কারণেই শিপিং কোম্পানিগুলো ওই পথ এড়িয়ে চলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ফিলিস্তিনের সশস্ত্র সংগঠন হামাসকে সমর্থনের ঘোষণা দিয়েছে হুতিরা। তারা বলছে, ইসরায়েলমুখী জাহাজগুলোই তাদের হামলার লক্ষ্য। তবে এ পর্যন্ত আক্রান্ত সব জাহাজই ইসরায়েলে যাচ্ছিল কি না, তা স্পষ্ট নয়।
লোহিত সাগরে হুতিদের হামলার প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের নৌবাহিনী ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহীদের লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালাচ্ছে।
কী হয়েছিল
গত ৭ অক্টোবরে ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই হুতিরা তাদের হামলা জোরদার করে।
ইরানের সমর্থনপুষ্ট হুতিরা গত কয়েক মাস ধরেই বাব-আল-মান্দেব প্রণালীতে চলাচলকারী বিদেশি জাহাজে ড্রোন ও রকেট হামলা করছে। আফ্রিকার দিকে ইরিত্রিয়া ও জিবুতি এবং আরব উপদ্বীপে ইয়েমেনের মধ্যে অবস্থিত এই প্রণালীটি মাত্র ২০ মাইল চওড়া।
জাহাজগুলো সাধারণত দক্ষিণ থেকে এই পথ ধরে আরও উত্তরে মিশরের সুয়েজ খালে পৌঁছায়। লোহিত সাগর থেকে ভূমধ্যসাগরে যাওয়ার সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত পথ হল সুয়েজ খাল। এটি মিশরের সিনাই উপদ্বীপের পশ্চিমে অবস্থিত।
কিন্তু চলমান ও ভবিষ্যৎ হামলার হুমকির কারণে, মেডিটারেনিয়ান শিপিং কোম্পানি ও মায়েরস্কের মতো বিশ্বের বেশ কয়েকটি বৃহৎ শিপিং কোম্পানি তাদের জাহাজ অনেক দীর্ঘ পথে চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই রুটটি আফ্রিকার কেপ অফ গুড হোপ ঘুরে পশ্চিম দিকে মহাদেশটির উপকূল ধরে এগিয়ে যায়।
ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম (বিপি) কোম্পানিও লোহিত সাগরের মধ্য দিয়ে তেলের সব চালান স্থগিত করেছে। এমন সিদ্ধান্তের জন্য প্রতিষ্ঠানটি ‘নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি’কে দায়ী করেছে। দীর্ঘ যাত্রায় জাহাজের পণ্য সরবরাহের সময় কমপক্ষে ১০ দিন বাড়ে। কোম্পানিগুলোকে অতিরিক্ত লাখ লাখ ডলার খরচ করতে হচ্ছে।
রুটটি কেন গুরুত্বপূর্ণ
সুয়েজ খাল দিয়ে ভারত মহাসাগর থেকে চলাচলকারী যেকোনও জাহাজকে বাব-আল-মান্দেব প্রণালী এবং লোহিত সাগর দিয়ে আসতে হবে। খালটি এশিয়ার সঙ্গে ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে দ্রুততম সমুদ্রপথ। তেল এবং তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) পরিবহনের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
জাহাজ ভাড়া বিশ্লেষণ সংস্থা ভরটেক্সার মতে, ২০২৩ সালের প্রথমার্ধে সুয়েজ খাল দিয়ে দিনে প্রায় ৯০ লাখ ব্যারেল তেল পরিবহন করা হয়।
এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল মার্কেট ইন্টেলিজেন্সের বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় আমদানি করা প্রায় ১৫ শতাংশ পণ্য সাগরপথে এশিয়া ও উপসাগর থেকে আসে। এর মধ্যে ২১ দশমিক ৫ শতাংশ পরিশোধিত এবং ১৩ শতাংশের বেশি অপরিশোধিত তেল।
তবে শুধু তেলই নয়। কন্টেইনার জাহাজগুলো দোকানে দেখা যায় এমন সব ধরনের ভোগপণ্য বহন করে। এর মধ্যে রয়েছে টেলিভিশন, পোশাক, জুতা এবং খেলার সরঞ্জাম।
ভোক্তাদের উপর প্রভাব
এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল মার্কেট ইন্টেলিজেন্সের সরবরাহ ব্যবস্থা গবেষণার প্রধান হলেন ক্রিস রজার্স। বিবিসিকে তিনি বলেন, “লোহিত সাগর থেকে জাহাজগুলো অন্য রুটে চালানোর কারণে সরবরাহ ব্যবস্থায় অবধারিতভাবেই প্রভাব পড়বে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে ভোগপণ্যে।” তবে বর্তমান এই ব্যাঘাত পণ্য পরিবহনের ব্যস্ত মৌসুমে ঘটেনি বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
কেপ অব গুড হোপের রুটটি প্রায় সাড়ে তিন হাজার নটিক্যাল মাইল দীর্ঘ। এ কারণে দোকানগুলোতে পণ্য পৌঁছাতে দেরি হতে পারে।
আসবাবপত্র জায়ান্ট প্রতিষ্ঠান ইকিয়া এবং যুক্তরাজ্যের খুচরা বিক্রেতা নেক্সট উভয়ই সতর্ক করেছে যে, জাহাজ পরিবহনে ব্যাঘাত চলতে থাকলে পণ্যের সরবরাহ হতে দেরি লাগবে।
ইকিয়ার প্রধান নির্বাহী মার্টিন ল্যান্ডোর্ট বলেছেন, “সুয়েজ খালের ঘটনা বিশ্বব্যাপী সরবরাহ ব্যবস্থায় ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। এটি আমাদের ব্যবসায়ও প্রভাব ফেলতে পারে।”
নেক্সটের প্রধান নির্বাহী থিও হার্ডি বলেছেন, “সুয়েজ খালের ঘটনায় আমরা এখনও সম্ভাব্য পরিণতির মূল্যায়ন করছি।”
টেসলা তার একমাত্র ইউরোপীয় বৈদ্যুতিক গাড়ি কারখানায় উৎপাদন স্থগিত করেছে সরবরাহ ব্যাহত হওয়ার কারণে। এর ফলে টেসলার ইউরোপীয় বিপণনে একটি বড় ধাক্কা লাগবে। কারণ কারখানাটি ২০২২ সালের মার্চে চালু হয়। এটি টেসলার ইউরোপীয় চাহিদার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মেটাচ্ছে।
অতিরিক্ত দূরত্বের কারণে কোম্পানিগুলোকেও অতিরিক্ত খরচ করতে হবে। সরবরাহ ব্যবস্থা বিশেষজ্ঞ ড্রুরির মতে, গত সপ্তাহে একটি ৪০ ফুটের কন্টেইনার ব্যবহারের মূল্য ১৫ শতাংশ বেড়েছে। এই অতিরিক্ত খরচ গ্রাহকদের উপর চাপিয়ে দিতে পারে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো।
তবে কন্টেইনার ভাড়া এখনও ২০২১ সালের তুলনায় অনেক কম। তখন কভিড বিধিনিষেধের সঙ্গে চাহিদার সামঞ্জস্য রেখে পরিবহন ভাড়া অনেক বেড়েছিল।
সুয়েজ খালের ব্যাঘাতের ফলে তেলের দাম বাড়তে পারে বলেও আশঙ্কা রয়েছে।
তেলের দাম বাড়লে গাড়ির জ্বালানির দাম বাড়বে। তেলের পাম্পেও দাম বাড়বে। একই সঙ্গে মুদ্রাস্ফীতি বাড়াতেও ভূমিকা রাখবে তেল। যুক্তরাজ্যে বর্তমানে মুদ্রাস্ফীতির হার ৩ দশমিক ৯ শতাংশ।
এলএনজির সরবরাহ ব্যাহত হলে জ্বালানির পাইকারি বাজারেও মূল্য বাড়ে। তবে এই মূল্যবৃদ্ধি আগামী এপ্রিলের আগে বাসা-বাড়ির বিলে প্রভাব ফেলবে না। জ্বালানির মূল্য পূর্বেই নির্ধারণ করে দেওয়ার কারণে এমনটা হবে। কারণ ইতোমধ্যেই জানুয়ারি মাসের জন্য মূল্য নির্ধারিত হয়েছে।
সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনই কি একমাত্র বিকল্প? রজার্স বলেন, “রেলপথে পণ্য পরিবহনের জন্য ‘রাশিয়া অতিক্রম’ করতে হবে। ইউক্রেনে অভিযান চালানোর কারণে রাশিয়ার উপর এখন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা চলছে। অন্যদিকে উপসাগর থেকে ইসরায়েলে স্থলপথে পণ্য পাঠালে মাত্র ৩ শতাংশ শিপিং ব্যয় কমবে।”
প্রতিক্রিয়া
লোহিত সাগরে চলাচলকারী জাহাজগুলোকে হুতি হামলা থেকে রক্ষায় গত ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র একটি আন্তর্জাতিক নৌ অভিযান চালু করেছে। এই অভিযানে যুক্তরাজ্য, কানাডা, ফ্রান্স, বাহরাইন, নরওয়ে এবং স্পেনসহ কয়েকটি দেশ অংশ নিয়েছে। কিন্তু এর পরেও শিপিং কোম্পানি আবারও এই রুটটি ব্যবহার শুরু করতে দ্বিধাগ্রস্ত।
সাগরে নিরাপত্তা অভিযান শুরুর পর সাময়িকভাবে মায়ারস্ক তাদের জাহাজ চলাচল শুরু করেছিল। কিন্তু এর মধ্যেই তাদের একটি জাহাজ হামলার শিকার হলে ফের চলাচল বন্ধ করে দেয় প্রতিষ্ঠানটি।
লোহিত সাগরে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের নৌবাহিনী ইয়েমেনের বিভিন্ন জায়গায় হুতি বিদ্রোহীদের লক্ষ্যবস্তুতে বিমান হামলা চালিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, “এই লক্ষ্যবস্তুতে হামলাগুলো স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্র এবং আমাদের অংশীদাররা আমাদের কর্মীদের উপর হামলা সহ্য করবে না।”
তথ্যসূত্র : বিবিসি