সংস্কারপন্থী মাসুদ পেজেশকিয়ান ইরানের নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। দ্বিতীয় ধাপের ভোটে কট্টর রক্ষণশীল প্রতিদ্বন্দ্বী সাঈদ জালিলিকে হারিয়ে তিনি ইরানের প্রেসিডেন্ট হলেন।
বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৩ কোটি ভোট গণনা করার পরই মাসুদ পেজেশকিয়ানকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। মাসুদ পেয়েছেন ৫৩ দশমিক ৩ শতাংশ ভোট। আর জালিলি পেয়েছেন ৪৪ দশমিক ৩ শতাংশ ভোট। দেশটির মোট ভোটার সংখ্যা ৬ কোটির ওপরে।
ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপের ভোটহগ্রহণ হয় শুক্রবার। গত ২৮ জুন অনুষ্ঠিত প্রথম ধাপের নির্বাচনে চার প্রার্থীর কেউ ৫০ শতাংশের বেশি ভোট না পাওয়ায় নির্বাচন দ্বিতীয় ধাপে গড়ায়। প্রথম ধাপে সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়া দুই প্রার্থী দ্বিতীয় ধাপে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
ইরানে এবার নির্ধারিত সময়ের এক বছর আগেই নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হলো। পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি গত মে মাসে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ায় আগাম এই নির্বাচনের আয়োজন করা হয়।
পেজেশকিয়ানের সমর্থকরা বিজয় উদযাপন করতে তেহরান ও অন্যান্য শহরের রাস্তায় নেমে এসেছে।
সোশাল মিডিয়ায় পোস্ট করা ভিডিওগুলোতে দেখা গেছে, তরুণরা আনন্দে নাচছে এবং গাড়ির হর্ন বাজাতে বাজাতে পেজেকশিয়ানের নির্বাচনী প্রতীক সবুজ পতাকা নাড়াচ্ছে।
প্রাক্তন হার্ট সার্জন ডা. মাসুদ পেজেশকিয়ান ইরানের নৈতিকতা পুলিশের সমালোচক এবং জাতীয় ‘ঐক্য ও সংহতির’ পাশাপাশি বিশ্ব থেকে ইরানের ‘বিচ্ছিন্নতা’ দূর করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন।
তিনি পশ্চিমা শক্তিগুলোর সঙ্গে ২০১৫ সালের পরমাণু সমঝোতা পুনর্নবায়নের জন্য ‘গঠনমূলক আলোচনা’ শুরু করার আহ্বানও জানিয়েছেন। ওই সমঝোতায় ইরান পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাগুলো শিথিল করার বিনিময়ে পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধ করতে সম্মত হয়েছিল।
অন্যদিকে, তার প্রতিদ্বন্দ্বী সাইদ জালিলি ছিলেন স্থিতাবস্থার পক্ষে। পারমাণু বিষয়ক আলোচনা নেতৃত্ব দেওয়া জালিলি ইরানের ধার্মিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে জনপ্রিয় ছিলেন।
জালিলি তার কট্টর পশ্চিমাবিরোধী অবস্থান এবং পারমাণবিক চুক্তি পুনর্নবায়নের বিরোধিতার জন্য পরিচিত।
দ্বিতীয় ধাপে ভোটার উপস্থিতি ছিল ৫০ শতাংশ, যা গত সপ্তাহে প্রথম রাউন্ডের তুলনায় ১০ শতাংশ বেশি। এবারের নির্বাচনের প্রথম ধাপে ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের পর থেকে সবচেয়ে কম ভোট পড়েছিল।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্ষমতাসীনদের প্রতি ব্যাপক অসন্তোষের কারণে এবার লাখ লাখ মানুষ নির্বাচন বর্জন করেছে। প্রার্থী বাছাইয়ে স্বাধীনতার অভাব, কট্টর ইসলামপন্থীদের আধিপত্য এবং সর্বোচ্চ নেতার কঠোর নিয়ন্ত্রণের কারণে বাস্তব পরিবর্তন অসম্ভব হওয়ার হতাশা থেকে তারা নির্বাচন বর্জন করেন।
তবে পেজেশকিয়ানের জয়ের সম্ভাবনায় প্রথম রাউন্ডে ভোট না দেওয়া অনেক মানুষ দ্বিতীয় রাউন্ডে ভোট দেন। ফলে দ্বিতীয় রাউন্ডে ১০ শতাংশ বেশি ভোট পড়ে।
জালিলির বিরোধীদের আশঙ্কা ছিল, জালিলি প্রেসিডেন্ট হলে ইরান বহির্বিশ্বের সঙ্গে আরও সংঘর্ষের দিকে এগিয়ে যাবে এবং তিনি ইরানের জন্য আরও নিষেধাজ্ঞা এবং আরও বিচ্ছিন্নতা ছাড়া আর কিছুই আনবেন না।
ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হতে চাইলে দেশটির গার্ডিয়ান কাউন্সিল বা অভিভাবক পরিষদের যাচাই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এটি ১২ জন ধর্মগুরু ও আইনবিদদের সমন্বয়ে গঠিত একটি ক্ষমতাশালী সংস্থা। সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি এর প্রধান।
সেই প্রক্রিয়ায় এবার প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হওয়ার জন্য আবেদনকারীদের মধ্য থেকে বেশ কয়েকজন নারীসহ ৭৪ জনকে বাদ দেওয়া হয়।
অভিযোগ রয়েছে, গার্ডিয়ান কাউন্সিল ইসলামি শাসনের প্রতি যথেষ্ট অনুগত নয় এমন প্রার্থীদের অযোগ্য ঘোষণা করে।
ইরানের কঠোর পোশাকবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে নৈতিকতা পুলিশের হাতে ২২ বছর বয়সী কুর্দি তরুণী মাহসা আমিনির মৃত্যুর পরে ২০২২ সালে বিক্ষোভের বিশাল তরঙ্গে কেঁপে উঠেছিল ইরান।
ওই বিক্ষোভ দমনে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির কঠোর ভূমিকা নিয়ে নানা মহলে সমালোচনা হয়। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, ওই সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দমন-পীড়নে শতাধিক ইরানি নিহত হন এবং হাজার হাজার বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এ কারণেই এবার অনেক তরুণ নির্বাচন বর্জন করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ভোটের সময় ইরানের সোশাল মিডিয়ায় ফার্সি হ্যাশট্যাগ ‘বিশ্বাসঘাতক সংখ্যালঘু’ ভাইরাল হয়। এতে জনগণকে প্রার্থীদের মধ্যে কাউকেই ভোট না দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। আর যারা ভোট দেবে তাদের ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলে অভিহিত করা হয়।
কিন্তু ইরানর সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি মানতে নারাজ যে, ইসলামী শাসনের প্রতি অসন্তোষের কারণেই এবার লোকে কম ভোট দিয়েছে।
তার মতে, “কম মানুষের ভোট দেওয়ার পেছনে অন্য কোনও কারণ রয়েছে। রাজনীতিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানীরা সেগুলো খতিয়ে দেখবেন। কিন্তু কেউ যদি মনে করেন যে, যারা ভোট দেয়নি তারা ইসলামী শাসনের বিরুদ্ধে, তারা স্পষ্টতই ভুল করছেন।”
তবে এক বিরল পদক্ষেপে খামেনি স্বীকার করেছেন যে, কিছু ইরানি বর্তমান ইসলামী শাসনকে মেনে নেয় না। তিনি বলেন, “আমরা তাদের কথা শুনি এবং আমরা জানি তারা কী বলছে এবং এমন নয় যে তারা লুকিয়ে আছে এবং তাদের দেখা যায় না।”