Beta
শনিবার, ১৭ মে, ২০২৫
Beta
শনিবার, ১৭ মে, ২০২৫

রপ্তানির বিকল্প বাজার খোঁজার পরামর্শ রেহমান সোবহানের

‘ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক এবং বাংলাদেশের প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখছেন রেহমান সোবহান
‘ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক এবং বাংলাদেশের প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখছেন রেহমান সোবহান
[publishpress_authors_box]

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পাল্টা শুল্কের সমাধান কীভাবে হবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান।

এই অনিশ্চয়তা থেকে বের হয়ে আসতে বাংলাদেশকে নতুন রপ্তানি বাজার খোজার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। এছাড়া কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের বাজারে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি বাড়ানোর সুযোগ তৈরির পরামর্শ দিয়েছেন রেহমান সোবহান।

দক্ষিণ, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সম্প্রসারণমুখী বাজারে রপ্তানি বাজার তৈরির পরামর্শও তিনি দিয়েছেন বৃহস্পতিবার সিপিডি আয়োজিত ‘ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক এবং বাংলাদেশের প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া’ শীর্ষক আলোচনা সভায়।

ট্রাম্প গত ২ এপ্রিল হোয়াইট হাউসে সংবাদ সম্মেলন করে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানিকারক শতাধিক দেশের পণ্যের ওপর সম্পূরক শুল্ক হার পুনর্নির্ধারণ করেন। তাতে বাংলাদেশের পণ্যে নতুন করে ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ হয়েছে, যা এতদিন ছিল ১৫ শতাংশ।

পরবর্তীতে চীন ছাড়া অন্য সব দেশের জন্য ধার্য করা যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করেন তিনি। এই সময় দেশগুলোর পণ্যে পাল্টা শুল্ক ন্যূনতম ১০ শতাংশ কার্যকর হবে।

এর প্রতিক্রিয়ায় চীন যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর শুল্কারোপ করলে কয়েক ধাপে শুল্ক বাড়িয়ে ১৪৫ শতাংশে উন্নীত করেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। এর পাল্টায় আমেরিকান পণ্যে ১২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেয় বেইজিং। পরবর্তীতে দুই দেশই এই শুল্ক আরও বাড়িয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানিতে পাল্টা শুল্ক ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করায় দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ধন্যবাদ জানান বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

রাজধানী ঢাকার লেকশোর হোটেলে বৃহস্পতিবার এই আলোচনা সভায় মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান। সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে শিল্প উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি শ্রমিক নেতারাও অংশ নেন।

যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় পিছিয়ে পড়ে চীনের সঙ্গে ‘পাল্টা শুল্ক আরোপের খেলা’ শুরু করেছে বলে মনে করেন অধ্যাপক রেহমান সোবহান।

প্রধান আলোচকের বক্তব্যে তিনি বলেন, “সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র অভ্যন্তরীণ এবং বিশ্বব্যাপী উভয় বাজারেই চীনের কাছে তার প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে হারিয়েছে। ক্রয়ক্ষমতার সক্ষমতার বিচারে বর্তমানে চীনের অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও বৃহত্তর হওয়ার কারণে স্বাভাবিকভাবেই চীন এখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে।”

রেহমান সোবহান বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক বাণিজ্য নীতির প্রতিক্রিয়ায় চীন যেভাবে দৃঢ় পদক্ষেপ নিয়েছে, তা অন্য কোনো দেশের পক্ষে দেখানো সম্ভব হয়নি, যদিও কানাডা এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্যভাবে সাড়া দিয়েছে।”

গত ২ এপ্রিল ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, “দিন শেষে দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক বাজার উভয় ক্ষেত্রে চীনের কাছে সবচেয়ে বেশি প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারিয়েছে। সেই কারণে চীনই তাদের প্রধান লক্ষ্য হয়েছে।”

তিনি বলেন, “ক্রয় ক্ষমতার সক্ষমতারদিক থেকে এবং বর্তমানে চীনের অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও বড়। চীন যেভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে পেরেছে, অন্য কোনও দেশ সেভাবে পারেনি, কানাডাও ভালোভাবেই সাড়া দিয়েছে।”

“এখন স্পষ্টতই যেমন কর্ম, তেমন ফল খেলা চলছে’ মন্তব্য করে রেহমান সোবহান বলেন, “খেলাটা এভাবে খেলার কথা নয়। বাণিজ্য সম্পর্ক এবং বৈশ্বিক বিনিয়োগের গতিবিধির ক্ষেত্রে একটি ভিন্ন লেনদেনভিত্তিক বিশ্ব তৈরি হয়েছে। একইসঙ্গে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোও শক্তিশালী হয়েছে।”

তিনি বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শক্তিশালী অর্থনীতি তৈরি হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক ব্যবস্থা নিয়ে চীন ছাড়া অন্যান্য দেশগুলোর সঙ্গে পুনরায় আলোচনা করা হবে এবং এই আলোচনা চলতেই থাকবে। শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্কের প্রকৃতি কেমন হবে, তা নির্ধারণের জন্য দীর্ঘ পথ বাকি।”

একক দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার। মোট রপ্তানি আয়ের ২০ শতাংশের মতো আসে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির এই দেশ থেকে।

অনুষ্ঠানে রেহমান সোবহান বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র একক দেশ হিসেবে আমাদের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার হলেও (পাল্টা শুল্কের) সমাধান খুব কম সময়ে নাও হতে পারে।”

এজন্য কয়েক বছরের মধ্যে বিকল্প বাজারে মনোযোগ দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “যদি আপনি বৃহত্তর প্রতিযোগিতা সক্ষমতা দিয়ে বাজার আরও সম্প্রসারণ করতে চান, তবে আসলে আপনার আগামী দুই বছর ইইউ (ইউরোপীয় ইউনিয়নে) এর ওপর মনোযোগ দেওয়া উচিত।”

‘ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক এবং বাংলাদেশের প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া’ শীর্ষক আলোচনা সভা।

রেহমান সোবহান বলেন, “ইউরোপে আরও দুই বছর আমাদের শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা রয়েছে। এর সঙ্গে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের মতো আরও কিছু বাজারে রপ্তানি বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে।

এরপরও এশীয় অঞ্চলে বড় বাজারের সুযোগ রয়েছে, দক্ষিণ-পূর্ব এবং পূর্ব এশিয়ায়। যেখানে বৈশ্বিক বাণিজ্যের বৃদ্ধি, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং বিনিয়োগ পুঁজির বৃহত্তম উৎসগুলো অবস্থিত। আমাদের বৃহত্তম একক বাজারের নীতির কারণে সৃষ্ট অনিশ্চয়তা থেকে সরে এসে ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে হবে।”

অধ্যাপক সোবহান এশিয়ার বাজারও বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত সম্ভাবনাময় বলে মনে করেন।

তিনি বলেন, “এই মহাদেশ আগামী দিনে বিশ্বের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক প্রবৃদ্ধির মূল কেন্দ্র হবে। আগামী ২৫ বছরের মধ্যে এশিয়াই হবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সবচেয়ে বড় জায়গা। তাই, এই অঞ্চলের উদীয়মান অর্থনীতির সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার করা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত ফলপ্রসূ হতে পারে।”

অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধে অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যে বাংলাদেশের ৭৪ শতাংশ শুল্ক আরোপের তথ্য সঠিক নয় উল্লেখ করে বলেন, “২০২৪ সালে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া পণ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্র ১৫ দশমিক ১ শতাংশ হারে ১২৭ কোটি ডলারের শুল্ক আদায় করেছে। আর যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা পণ্য থেকে বাংলাদেশ গড়ে ২ দশমিক ২ শতাংশ হারে শুল্ক আদায় করেছে, পাওয়া গেছে মাত্র ১৮ কোটি ডলার।”

তিনি বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি হওয়া শীর্ষ তিন পণ্যে শুল্ক শূন্য করলে অন্য দেশকে সমান সুবিধা দিতে হবে। এতে বাংলাদেশের ১৭ কোটি ডলারের শুল্ক লোকসান হবে।”

এসময় তিনি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা- ডাব্লিউটিওর আইন তুলে ধরে বলেন, “কোনও পণ্যে একক কোনও দেশের জন্য বিশেষ সুবিধা দেওয়া যায় না। কোনও একটি দেশকে বিশেষ সুবিধা দিলে সেই সুবিধা সব দেশকেই দিতে হবে। সুতরাং কোনও পণ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার সুযোগও নেই।

বাংলাদেশ ট্যারিফ অ্যান্ড ট্রেড কমিশনের সাবেক সদস্য মোস্তফা আবিদ খান বলেন, “আমি বিশ্লেষণ করে দেখেছি যুক্তরাষ্ট্র যে শুল্ক আরোপ করেছে, এটা পারস্পরিক শুল্ক নয়। ফলে আমরা যতই সাড়া দেই না কেন, লাভ নেই। আমাদের বুঝতে হবে, যুক্তরাষ্ট্র কী চায়। সে জন্য আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে।”

তিনি বলেন, “কোনও পণ্যে শুল্ক কমালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে আমদানি বাড়বে, তা নিশ্চিত নয়। আবার তাদের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করতে চাইলেও অবকাঠামোগতভাবে বাংলাদেশ এফটিএর জন্য প্রস্তুত নয়।”

অনুষ্ঠানে থাই চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি শামস মাহমুদ সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত বিনিয়োগ সম্মেলনে কোরিয়া ইপিজেডকে সরকারিভাবে জমির দলিল বুঝিয়ে দেওয়ার সমালোচনা করেন।

তিনি বলেন, “দেশের সব বিনিয়োগকারীর জন্য সমান সুযোগ থাকা উচিত। আমরা কারখানা করার জন্য জমির কাগজ নিয়ে বছরের পর বছর সরকারের দপ্তরে ঘুরছি।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত