বাংলাদেশজুড়ে বড় ধরনের বিভেদের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছেন জানিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, বাংলাদেশ একটি বড় পরিবার। এখানে ধর্মের ভিত্তিতে বিভেদ সৃষ্টি করার প্রশ্নই আসে না।
মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকার লালবাগে ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির পরিদর্শন শেষে হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় এসব কথা বলেন।
ড. ইউনূস বলেন, “বড় রকমের একটা বিভেদের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। এমন বাংলাদেশ আমরা গড়তে চাচ্ছি, যেটা একটা পরিবার, এটাই হচ্ছে মূল জিনিস। এই পরিবারের মধ্যে কোনও পার্থক্য করা, বিভেদ করার প্রশ্নই আসে না। আমরা বাংলাদেশের মানুষ, বাংলাদেশি।”
তীব্র আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। রাজনৈতিক এই পট পরিবর্তনের পর দেশজুড়ে শুরু হয় নানা অরাজকতা। বিভিন্ন সরকারি স্থাপনার পাশাপাশি হামলার শিকার হয় হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের ঘরবাড়ি-মন্দির।
দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসতে থাকে হামলার খবর। আবার কোথাও কোথাও মন্দির ও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘর পাহারা দেওয়ার খবরও পাওয়া যায়।
এমন পরিস্থিতিতে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল ও ধর্ম বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আ. ফ. ম. খালিদ হোসেনকে নিয়ে ঢাকেশ্বরী মন্দির পরিদর্শনে যান ড. ইউনূস। সঙ্গে ছিলেন সনাতন ধর্মাবলম্বীদের শীর্ষ নেতারা।
গণতান্ত্রিক অধিকার ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মূল্য লক্ষ্য জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান, বিভেদ সৃষ্টি করার কোনও সুযোগ নেই।” সবাইকে ধৈর্য ধরে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অন্যতম লক্ষ্য।
“ন্যায় বিচার হলে কে বিচার পাবে না এটা আমাকে বলেন? এটা কি দেখার সুযোগ আছে? কে কোন ধর্মের, কোন জাতের, কোন সম্প্রদায়ের। এটা কি আইনে বলা আছে যে, এই ধর্মের, এই সম্প্রদায়গুলো এই আদালতে যাবে, ওই সম্প্রদায়গুলো অন্য আদালতে যাবে? আইন একটা, কার সাধ্য আছে এখানে বিভেদ করে?”
হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “আপনারা বলবেন যে, আমরা মানুষ, আমরা বাংলাদেশের মানুষ। আমার সাংবিধানিক অধিকার এই, এটা আমাকে দিতে হবে। সব সরকারের কাছে এটাই চাইবেন, আর কিছুই না।”
“এক মানুষ, এক অধিকার” এই নীতি মেনে চলবেন জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “আমাদের একটু সাহায্য করুন আপনারা, ধৈর্য ধরুন। কী করতে পারলাম কী পারলাম না, সেটা পরে বিবেচনা করবেন।”
এসময় ৫৩ বছরে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ওপর অত্যাচার নির্যাতন ও বৈষম্যের বিচারে একটি কমিশন গঠনের দাবি জানান সম্প্রদায়ের জ্যেষ্ঠ নেতারা।
মাঠে থাকবেন সংখ্যালঘু নেতারা
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দেওয়া আশ্বাসে আশ্বস্ত হলেও অন্তর্বর্তী সরকারের দেওয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন না হওয়ার পর্যন্ত মাঠে থাকার ঘোষণা দিয়েছেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা।
দুপুরে প্রধান উপদেষ্টাসহ একাধিক উপদেষ্টাদের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় বৈঠক করেন সংখালঘু সম্প্রাদায়ের নেতারা। বিভিন্ন সংগঠনের ৪০ প্রতিনিধির উপস্থিতিতে প্রায় এক ঘণ্টা চলে এই বৈঠক।
সেখান থেকে বেরিয়ে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত বলেন, “গত ৫ আগস্টের পর থেকে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা চলেছে। যা এখন পর্যন্ত বিভিন্ন জেলায় অব্যাহত। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে তারা এমন একটি পরিবেশ তৈরি করতে চান যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের মনে আশা এবং আস্থা জাগাতে পারে। এজন্য ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকলের সহযোগিতা কামনা করেছেন।”
যদিও অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে সবকিছু বাস্তবায়ন করা সম্ভব না বলে মনে করেন রানা দাশগুপ্ত। তিনি বলেন, কোথাও না কোথাও থেকে বিষয়টা শুরু করতে হবে। উপদেষ্টারাও চাইছেন আমরা যেন কাজটা শুরু করি।
সরকার পতনের পর ৫ আগস্ট বিকাল থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মন্দির, বাড়িঘরে হামলার খবর আসতে থাকে। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে শুরু করেন এসব সম্প্রদায়ের মানুষ। যার পরিপ্রেক্ষিতে নিরাপত্তার দাবিতে আন্দোলনে নামেন তারা।
এরই ধারাবাহিকতায় প্রধান উপদেষ্টা গিয়েছিলেন ঢাকেশ্বরী মন্দির পরিদর্শনে, বৈঠক করেন বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতাদের সঙ্গে।
রানা দাশগুপ্ত বলেন, “প্রধান উপদেষ্টা যে আশার বাণী শুনিয়েছেন তা বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত আমরা মাঠে থাকব। আমাদের নানা সময়ে নানা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তা পূরণ হয়নি। এবার যেন তার পুনরাবৃত্তি না হয় সে জন্যই আমরা মাঠে থাকব।”
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সন্তোষ শর্মা বলেন, “ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, তিনি এমন একটি রাষ্ট্র তৈরি করতে চান যেখানে আর কোনোদিন মন্দির পাহারা দিতে হবে না। আমরা আশান্বিত আমদের দাবি- দাওয়া বাস্তবায়িত হবে।
“আমরা আরেকটা কথা বলেছি যে বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। উনি আমাদের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন।”
দূর্গা পূজায় তিনদিনের সরকারি ছুটির দাবি জানিয়েছেন উল্লেখ করে রানা দাশগুপ্ত বলেন, এছাড়া বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রবারণা পূর্ণিমা উপলক্ষ্যে এক দিন ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের ইস্টার সানডে উপলক্ষ্যে এক দিনের ছুটি দাবি করা হয়েছে।
ইসকনের সাধারণ সম্পাদক চারুচন্দন দাস ব্রক্ষাচারী বলেন, “আমরা আশাবাদী। উনি আশ্বাস দিয়েছেন, আমরা উনার কথা বিশ্বাস করি। ড. মুহাম্মদ ইউনূস আশ্বাস দিয়েছেন যে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা সুখে-শান্তিতে বাস করবে।”
আপাতত কোনো কর্মসূচি নেই জানিয়ে তিনি বলেন, “প্রধান উপদেষ্টার আশ্বাস যদি পূরণ না হয় তাহলে আমরা বিবেচনা করে দেখব যে পরবর্তীতে কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়।”
সংখ্যালঘু অধিকার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ও শিক্ষার্থী প্রতিনিধি অর্থী দে বলেন, যেহেতু সব দাবি বাস্তবায়নের বিষয়ে আশ্বস্ত করা হয়েছে, তাই তাদের এই সময়টুকু আমরা দেবো। এরপরই পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের ৮ দফা
সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন ও সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় গঠন, অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনের যথাযথ প্রয়োগে যাবতীয় আমলাতান্ত্রিক বাধা অপসারণ, ট্রাইব্যুনালের রায়ের আলোকে জমির মালিকানা ও দখল ভুক্তভোগীদের বরাবরে অনতিবিলম্বে প্রত্যর্পণ, জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে সরকারে, সংসদে, জনপ্রতিনিধিত্বশীল সব সংস্থায় অংশীদারত্ব ও প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা, দেবোত্তর সম্পত্তি সংরক্ষণে আইন প্রণয়ন, বৈষম্য বিলোপ আইন প্রণয়ন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন এবং তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইনের যথাযথভাবে কার্যকর করা এবং দূর্গাপূজায় অষ্টমী থেকে দশমী তিন দিন, প্রবারণা পূর্ণিমায় এক দিন ও ইস্টার সানডেতে এক দিন সরকারি ছুটি ঘোষণা।
সংখ্যালঘু অধিকার আন্দোলনের ৮ দফা
সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিচারের জন্য ‘দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল’ গঠন করে দোষীদের দ্রুততম সময়ে শাস্তি দেওয়া, যথাযথ ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন, সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন, হিন্দুধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টকে ‘হিন্দু ফাউন্ডেশনে’ উন্নীত করা, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টকেও ফাউন্ডেশনে পরিণত, ‘দেবোত্তর সম্পত্তি পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ আইন’ প্রণয়ন এবং ‘অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনের’ যথাযথ বাস্তবায়ন, সরকারি/ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের সংখ্যালঘু শিক্ষার্থীদের জন্য উপাসনালয় নির্মাণ এবং প্রতিটি হোস্টেলে প্রার্থনাকক্ষ বরাদ্দ, সংস্কৃত ও পালি শিক্ষা বোর্ডের আধুনিকায়ন এবং দুর্গাপূজায় পাঁচ দিন ছুটি, পাশাপাশি প্রতিটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রধান প্রধান ধর্মীয় উৎসবে প্রয়োজনীয় ছুটি দেওয়ার বিধান।