দেশের অর্থনীতির উদ্বেগজনক সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের অন্যতম প্রধান উৎস প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়ছে। ফেব্রুয়ারির প্রথম ১৬ দিনে ১১৫ কোটি (১.১৫ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছে ৭ কোটি ১৯ লাখ ডলার।
রেমিটেন্সে প্রতি ডলারে ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। সে হিসাবে টাকার অঙ্কে এই ১৬ দিনে ১২ হাজার ৫৯২ কোটি টাকা পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছে ৭৮৭ কোটি টাকা।
মাসের বাকি ১৩ দিনে (১৭-২৯ ফেব্রুয়ারি) এই হারে এলে জানুয়ারির মতো এই মাসেও রেমিটেন্সের অঙ্ক ২ বিলিয়ন (২০০ কোটি) ডলার ছাড়িয়ে ২০৮ কোটি ৪৩ লাখ (২.০৮ বিলিয়ন) ডলারে গিয়ে ঠেকবে বলে হিসাব বলছে।
ফেব্রুয়ারি মাস ২৯ দিনে। এই মাসেও যদি ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিটেন্স আসে তাহলে রিজার্ভের উপর চাপ কমবে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর।
নতুন বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে ২১০ কোটি (২.১০ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা, যা ছিল সাত মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এ মাসে প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছিল ৬ কোটি ৭৭ লাখ ডলার।
আগের মাস গত বছরের ডিসেম্বরে এসেছিল প্রায় ২ বিলিয়ন (১৯৯ কোটি ১২ লাখ) ডলার।
তার আগের দুই মাস অক্টোবর ও নভেম্বরেও বেশ ভালো রেমিটেন্স এসেছিল দেশে। অক্টোবরে এসেছিল ১৯৭ কোটি ৭৫ লাখ (১.৯৮ বিলিয়ন) ডলার; নভেম্বরে ১৯৩ কোটি (১.৯৩ বিলিয়ন) ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংক রবিবার রেমিটেন্স প্রবাহের সাপ্তাহিক যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি ফেব্রুয়ারি মাসের ১৬ দিনে ১১৫ কোটি রেমিটেন্সের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ১৩ কোটি ৮৪ লাখ ৪০ হাজার ডলার। বিশেষায়িত কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ৫ কোটি ২৫ লাখ ২০ হাজার ডলার। বেসরকারি ৪৩ ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ৯৫ কোটি ৬৫ লাখ ৩০ হাজার ডলার। আর নয়টি বিদেশি ব্যাংক এনেছে ২৪ লাখ ৯০ হাজার ডলার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) ১২ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৩ দশমিক ৬০ শতাংশ বেশি।
এর সঙ্গে চলতি ফেব্রুয়ারি মাসের ১৬ দিনের ১১৫ কোটি ডলার যোগ করলে চলতি অর্থবছরের সাড়ে সাত মাসে (২০২৩ সালের ১ জুলাই থেকে চলতি মাসের ১৬ ফেব্রুয়ারি) মোট ১৪ দশমিক শূন্য ৫ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা।
গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২১ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স এসেছিল দেশে, যা ছিল আগের অর্থবছরের (২০২১-২২) চেয়ে ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ বেশি।
ব্যাংকগুলোর আড়াই শতাংশ বাড়তি প্রণোদনায় প্রবাসী আয় বাড়ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা। এছাড়া অনেক ব্যাংক বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে বেশি দামে রেমিটেন্স সংগ্রহ করায় প্রবাসী আয় বাড়ছে বলে জানিয়েছেন তারা।
তবে এতে খুশি নন অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।
সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “প্রবাসী আয় যেটা বাড়ছে, সেটা কাঙ্ক্ষিত নয়। কারণ, প্রতিবছর যে পরিমাণ জনশক্তি রপ্তানি হয়ে থাকে, সে অনুযায়ী প্রবাসী আয়ে তেমন প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে না। গত বছর রেকর্ড পরিমাণ—১৩ লাখ ৭ হাজার ৮০৫ জন জনশক্তি রপ্তানি হয়েছে। কিন্তু সে অনুপাতে রেমিটেন্স বাড়ছে না।”
“তবে জানুয়ারিতে ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিটেন্স দেশে এসেছে। চলতি ফেব্রুয়ারি মাসেও যদি ২ বিলিয়ন ডলার আসে, তাহলে রিজার্ভের উপর চাপ খানিকটা কমবে।”
গত বছরের সেপ্টেম্বরে ১৩৩ দশমিক ৪৪ কোটি (১.৩৩ বিলিয়ন) ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। একক মাসের হিসাবে যা ছিল সাড়ে তিন বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম।
২০২০ সালের প্রথম দিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। দেশে দেশে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। শুরু হয় লকডাউন; সব কিছু বন্ধ হয়ে যায়।
কমতে শুরু করে রেমিটেন্স। সেই ধাক্কায় ২০২০ সালের মার্চে রেমিটেন্স ১২৭ কোটি ৬২ লাখ ডলারে নেমে আসে। এপ্রিলে তা আরও কমে ১০৯ কোটি ২৯ লাখ ডলারে নেমে আসে। এর পর থেকে অবশ্য রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়তে থাকে।
প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সে সরকারের বিদ্যমান প্রণোদনার বাইরে গত বছরের ২২ অক্টোবর থেকে আরও আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দিচ্ছে ব্যাংকগুলো।
সরকার রেমিটেন্সে ২ দশমিক ৫ শতাংশ প্রণোদনা দিচ্ছে। অর্থাৎ কোনও প্রবাসী ১০০ টাকা দেশে পাঠালে তার সঙ্গে ২ টাকা ৫০ পয়সা বা আড়াই টাকা যোগ করে তার পরিবার-পরিজনকে (যার নামে প্রবাসী টাকা পাঠান) ১০২ টাকা ৫০ পয়সা দেওয়া হয়। গত ২২ অক্টোবর থেকে ১০২ টাকা ৫০ পয়সার সঙ্গে আরও আড়াই টাকা অর্থাৎ মোট ১০৫ টাকা পাচ্ছেন। এই আড়াই টাকা দিচ্ছে ব্যাংকগুলো।
রিজার্ভ বাড়ছে না
রেমিটেন্সের পাশাপাশি রপ্তানি আয়ও বাড়ছে। তারপরও রিজার্ভ বাড়ছে না। দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে একই জায়গায় ‘স্থির’ রয়েছে রিজার্ভ।
নানা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যেও জানুয়ারি মাসে রপ্তানি আয়ে নতুন রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ। এই মাসে পণ্য রপ্তানি করে ৫৭২ কোটি ৪৩ লাখ (৫.৭২ বিলিয়ন) ডলার দেশে এনেছেন রপ্তানিকারকরা, যা গত বছরের জানুয়ারির চেয়ে ১১ দশমিক ৪৫ শতাংশ বেশি। একক মাসের হিসাবে জানুয়ারির আয় অতীতের যেকোনো মাসের চেয়ে বেশি।
এর আগে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে পণ্য রপ্তানি থেকে ৫৩৬ কোটি ৫২ লাখ (৬.৩৬ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ, যা ছিল একক মাসের হিসাবে সর্বোচ্চ।
বাংলাদেশ ব্যাংক সবশেষ গত সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ হিসাবে ওই দিন রিজার্ভ ছিল ১৯ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন ডলার। আর ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৫ দশমিক শূন্য পাঁচ বিলিয়ন ডলার।
তার আগের সপ্তাহের সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ১৯ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৫ দশমিক শূন্য নয় বিলিয়ন ডলার।
চলতি মাসের প্রথম দিন ১ ফেব্রুয়ারি বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ১৯ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৫ দশমিক শূন্য ৮ বিলিয়ন ডলার।
গত ২৪ জানুয়ারি বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক শূন্য ২ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৫ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার।