বিদেশে থাকা বাংলাদেশিরা গত ডিসেম্বরে যে পরিমাণ অর্থ দেশে পাঠিয়েছেন, তার অর্ধেকেই অবদান তিনটি জেলার। সামনে থাকা এই জেলাগুলো হল ঢাকা, সিলেট ও চট্টগ্রাম। অন্যদিকে উত্তরাঞ্চল ও পার্বত্যাঞ্চলের ছয়টি জেলা রয়েছে সবচেয়ে পিছিয়ে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিচাশক্তি হচ্ছে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ বা রেমিটেন্স। ডলার সংকটের এই সময়ে প্রবাসীদের পাঠানো বিদেশি মুদ্রা রিজার্ভ সুসংহত করতে রাখছে ভূমিকা।
বাংলাদেশের এক কোটি মানুষ বিদেশে থাকছে। গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে তারা প্রায় ২ বিলিয়ন (২০০ কোটি) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। এই অঙ্ক ছয় মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। আর আগের বছরের ডিসেম্বরের চেয়ে ১৭ শতাংশ বেশি।
আগের দুই মাস অক্টোবর ও নভেম্বরেও বেশ ভালো রেমিটেন্স এসেছিল দেশে। অক্টোবরে এসেছিল ১৯৭ কোটি ৭৫ লাখ (১.৯৮ বিলিয়ন) ডলার; নভেম্বরে ১৯৩ কোটি (১.৯৩ বিলিয়ন) ডলার।
সব মিলিয়ে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথমার্ধে অর্থাৎ জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে ১ হাজার ৭৯ কোটি ৮৩ লাখ (১০.৮০ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে চেয়ে ২ দশমিক ৯১ শতাংশ বেশি।
কোন জেলায় বেশি
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ জেলাভিত্তিক প্রবাসী আয়ের তথ্যে দেখা যায়, গত ছয় মাসে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট এই তিন জেলায় মোট ৫৩০ কোটি (৫.৩০ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স এসেছে।
এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি এসেছে ঢাকা জেলায় ৩৬৩ কোটি ৪৩ লাখ (৩.৬৩ বিলিয়ন) ডলার। চট্টগ্রাম জেলায় এসেছে ১০২ কোটি ৫৮ লাখ (১.০২ বিলিয়ন) ডলার। আর সিলেটে এসেছে ৬৪ কোটি ডলার।
গত কয়েক অর্থবছরে চিত্র একই। সর্বশেষ গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২ হাজার ১৬১ কোটি ডলার প্রবাসী আয় দেশে আসে। এর মধ্যে প্রায় ১ হাজার ১০০ কোটি ডলারই এসেছে ওই তিনটি জেলায়, যা ছিল ওই অর্থবছরের মোট প্রবাসী আয়ের ৪৬ দশমিক ২৭ শতাংশ।
তার মধ্যে ঢাকা জেলায় এসেছিল সর্বাধিক ৬৯৬ কোটি ৭৩ লাখ ডলার, চট্টগ্রামে ১৬১ কোটি ১৮ লাখ ডলার এবং সিলেটে ১২৪ কোটি ৪১ লাখ ডলার।
২০২১–২২ অর্থবছরেও মোট ২ হাজার ১০৩ কোটি ডলারের প্রবাসী আয়ের ৪১ দশমিক ২৩ শতাংশ এসেছিল এই তিন জেলায়।
২০২০–২১ অর্থবছরে মোট ২ হাজার ৪৭৮ কোটি ডলারের প্রবাসী আয়ে এই তিন জেলার হিস্যা ছিল ৪৩ দশমিক ৫৩ শতাংশ। এক অর্থবছরের হিসাবে সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স এসেছিল সেবার।
ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটের বাইরে কুমিল্লা জেলাতেও বেশ ভালো রেমিটেন্স আসে। গত ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) কুমিল্লায় রেমিটেন্স এসেছে ৫৯ কোটি ৪৩ লাখ ডলার।
প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে এই চার জেলার বড় হিস্যার কারণে বিভাগের বিবেচনায়ও এগিয়ে আছে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগ। দেশে প্রবাসী আয় সবচেয়ে বেশি আসে ঢাকা বিভাগে। আর দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগ।
এই অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে মোট প্রবাসী আয়ের মধ্যে ৪২৩ কোটি ৬৯ লাখ ডলার বা ৩৯ দশমিক ২৩ শতাংশই এসেছে ঢাকা বিভাগের ১৩টি জেলায়।
৩০৫ কোটি ৪৩ লাখ ডলার বা ২৮ দশমিক ২৮শতাংশ এসেছে চট্টগ্রাম বিভাগের ১১ জেলায়। সিলেট বিভাগের চার জেলায় এসেছে ১২০ কোটি ৪১ লাখ ডলার, যা মোট প্রবাসী আয়ের ১১ দশমিক ১৫ শতাংশ।
নামমাত্র আসে ৬ জেলায়
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, প্রবাসী আয় প্রাপ্তিতে দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে আছে ছয়টি জেলা। এর মধ্যে তিনটি পার্বত্য জেলা বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি। অন্য তিনটি জেলা হচ্ছে উত্তরাঞ্চলের লালমনিরহাট, পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও।
২০২৩–২৪ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে এ ছয় জেলার মধ্যে সবচেয়ে কম প্রবাসী আয় এসেছে লালমনিরহাটে ৮৫ লাখ ডলার।
এরপর রয়েছে রাঙামাটি, এ জেলায় এসেছে ৮৬ লাখ ডলার। ঠাকুরগাঁওয়ে এসেছে ৯৬ লাখ ডলার, পঞ্চগড়ে ১ কোটি ২৫ লাখ, খাগড়াছড়িতে ১ কোটি ৩১ লাখ এবং বান্দরবান জেলায় এসেছে ১ কোটি ৩৮ লাখ ডলারের প্রবাসী আয়।
কোথাও বেশি কোথাও কম কোন কারণে
রেমিটেন্স কেন ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম ও কুমিল্লায় বেশি- সে প্রশ্নে জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) সভাপতি মোহাম্মদ আবুল বাশার কয়েকটি কারণ দেখান।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, ঐতিহাসিকভাবে এ চার জেলার মাইগ্রেশন চেইন বা বিদেশে যাওয়া লোকের সংখ্যা বেশি। এ কারণে ঐতিহাসিকভাবে এসব এলাকায় প্রবাসী আয়ও বেশি।
এর পাশাপাশি মানুষের সামর্থ্যের দিকটি তুলে ধরে বাশার বলেন, “প্রবাসে যাওয়া এক ধরনের বিনিয়োগঘন উদ্যোগ। বিদেশে যেতে হলে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করতে হয়। এ সক্ষমতা পিছিয়ে পড়া জেলার মানুষের ক্ষেত্রে কম।
“ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটে উচ্চ আয়শ্রেণির মানুষ বেশি, এসব এলাকার সম্পদমূল্যও বেশি। ফলে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটের মানুষ যত সহজে বিদেশে যাওয়ার জন্য বিনিয়োগের অর্থ জোগাড় করতে পারেন, অন্য জেলার মানুষের পক্ষে তা জোগাড় করা কষ্টসাধ্য।”
ঐতিহাসক কারণও দেখান তিনি; বলেন, “বিদেশে কাজের জন্য যাওয়ার ক্ষেত্রে পারিবারিক একটা বিষয়ও আছে। দেখা যায়, এক পরিবার থেকে একজন বিদেশে গেলে ওই পরিবার থেকে পরে একে একে আরও অনেকেই যান। সিলেট বিভাগের জেলাগুলোতে প্রতিটি পরিবারেই এমনটি লক্ষ্য করা যায়।”
একই কথা বলছেন অর্থনীতি গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআইবি) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। তবে পিছিয়ে পড়া জেলাগুলোকে এগিয়ে আনতে সরকারের পদক্ষেপ চেয়েছেন তিনি।
আহসান মনসুর সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, প্রবাসী আয়ের মাধ্যমে দেশের সব অঞ্চলে সুষম উন্নয়ন বা অগ্রযাত্রা নিশ্চিত করতে হলে পিছিয়ে থাকা জেলাগুলো থেকে অধিকসংখ্যক মানুষকে বিদেশে প্রেরণে সরকারি উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।
এজন্য বিদেশযাত্রার খরচ যতটা সম্ভব কমিয়ে আনা, বিদেশে অবস্থানরত শ্রমিকদের সরকারিভাবে নানা ধরনের সহায়তা দেওয়া, ফেরত আসা কর্মীদের পুনর্বাসনে পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেন তিনি।
গুরুত্ব যেখানে
সরকারি প্রতিষ্ঠান জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্যে দেখা যায়, গত পাঁচ বছরে জনশক্তি রপ্তানি বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।
২০১৯ সালে ৭ লাখ ১৫৯ জন কাজের জন্য বিভিন্ন দেশে গিয়েছিল। কোভিড মহামারির কারণে ২০২০ সালে তা ২ লাখ ১৭ হাজার ৬৬৯ জনে নেমে আসে। ২০২১ সালে আবার বেড়ে হয় ৬ লাখ ১৭ হাজার ২০৯ জন।
২০২২ সালে এক লাফে জনশক্তি রপ্তানি প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে ১১ লাখ ৩৫ হাজার ৮৭৩ জনে গিয়ে দাঁড়ায়। অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গত বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে তা আরও বেড়ে ১৩ লাখ ৭ হাজার ৮০৫ জনে গিয়ে ঠেকেছে।
অর্থনীতিতে প্রবাসীদের ভূমিকাটি তুলে ধরে আহসান মনসুর বলেন, “একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, যখনই আমাদের অর্থনীতি চাপের মধ্যে পড়েছে, তখনই আমাদের প্রবাসীরা সবার আগে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।
“দেশের অর্থনীতিতে এখন সংকট চলছে, রিজার্ভ কমে যাচ্ছে, এ পরিস্থিতিতে গত তিন মাস ধরে কিন্তু প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার করে রেমিটেন্স পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা।”
রেমিটেন্স আরও বাড়াতে উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে আমরা দক্ষ শ্রমিক পাঠানোর কথা বলে আসছি। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। প্রতি বছরই আমরা বেশি লোক পাঠাচ্ছি; কিন্তু সে অনুপাতে রেমিটেন্স বাড়ছে না। হুন্ডি বন্ধের পাশপাশি দক্ষ শ্রমিক পাঠানোর দিকে জরুরিভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে হবে।”
তাহলে রেমিটেন্স বেড়ে ৪০ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকবে বলে আশাবাদী আহসান মনসুর।