বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আগস্টের ধারাবাহিকতায় সেপ্টেম্বরেও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের প্রবাহে গতি দেখা গেছে। সেপ্টেম্বরেও ২০০ কোটি ডলারের বেশি রেমিটেন্স এসেছে। যার ওপর ভর করে ঠেকানো গেছে রিজার্ভের পতন।
দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে উদ্বেগজনক সূচক হিসেবে ধরা হয় বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভকে। যার অন্যতম উৎস প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স।
মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশিত রেমিটেন্স প্রবাহের সাপ্তাহিক তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে ২৪০ কোটি ৪৮ লাখ (২ দশমিক ৪০ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। একক মাসের হিসাবে যা তৃতীয় সর্বোচ্চ রেমিটেন্স।
সদ্য সমাপ্ত সেপ্টেম্বরের রেমিটেন্স এর আগের বছরের একই মাসের তুলনায় ৮০ দশমিক ২২ শতাংশ বেশি। গত বছর সেপ্টেম্বরে রেমিটেন্স এসেছিল ১০৭ কোটি ০৫ লাখ ডলার বা ৮০ দশমিক ২২ শতাংশ বেশি।
বর্তমান বিনিময় হার প্রতি ডলার ১২০ টাকা হিসাবে টাকার অঙ্কে চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে রেমিটেন্স হিসেবে ২৮ হাজার ৮৫৭ কোটি ৬০ লাখ টাকা এসেছে। অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন এসেছে ৮ কোটি ডলারের বেশি; টাকার অঙ্কে যা ৯৬৩ কোটি টাকা।
এর আগে এক মাসের হিসাবে সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স এসেছিল ২০২০ সালের জুলাই মাসে, ২৫৯ কোটি ৭৭ লাখ বা ২ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এসেছিল গত জুন মাসে, ২৫৩ কোটি ৮৬ লাখ বা ২ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, চলতি সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে অর্থাৎ ১ থেকে ৭ সেপ্টেম্বর ৫৮ কোটি ৪৫ লাখ ৪০ হাজার ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। দ্বিতীয় সপ্তাহে অর্থাৎ ৮ থেকে ১৪ সেপ্টেম্বর এসেছে ৫৮ কোটি ২৬ লাখ ৬০ হাজার ডলার।
তৃতীয় সপ্তাহে অর্থাৎ ১৫ থেকে ২১ সেপ্টেম্বর এসেছে ৪৬ কোটি ৭০ লাখ ডলার। চতুর্থ সপ্তাহে অর্থাৎ ২২ থেকে ২৮ সেপ্টেম্বর এসেছে ৪৭ কোটি ৮৯ লাখ ডলার।
আর মাসের বাকি দুই দিনে অর্থাৎ ২৯ ও ৩০ সেপ্টেম্বর এসেছে ২৯ কোটি ১৭ লাখ ডলার।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রেমিটেন্স প্রবাহে যে ধাক্কা লেগেছিল, তা কাটতে শুরু করেছে। বাড়তে শুরু করেছে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে দেশজুড়ে সহিংসতা, মৃত্যু, ইন্টারনেট বন্ধ, কারফিউ, মামলা, গ্রেপ্তার ও প্রবাসীদের উৎকণ্ঠার প্রেক্ষাপটে জুলাই মাসে রেমিটেন্স কমে গিয়েছিল। আবার ওই সময় আন্দোলনকে ঘিরে সংঘাত-সহিংসতার জন্য তৎকালীন সরকারকে দায়ী করে দেশে রেমিটেন্স না পাঠাতেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রবাসীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন অনেকে।
এর আগে অর্থবছরের দ্বিতীয় মাস আগস্টে ২২২ কোটি ১৩ লাখ বা ২ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। যা ছিল গত বছরের আগস্টের চেয়ে ৩৯ শতাংশ বেশি।
প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছিল ৭ কোটি ১৬ লাখ ডলার; টাকার অঙ্কে ছিল ৮৬০ কোটি টাকা। ২০২৩ সালের আগস্টে দেশে এসেছিল ১৬০ কোটি বা ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার।
গত ২০ আগস্ট থেকে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের দাম আরও ২ টাকা বেড়েছে। এখন আন্তঃব্যাংক মুদ্রা বাজারে প্রতি ডলার ১২০ টাকায় লেনদেন হচ্ছে। ব্যাংকগুলোও রেমিটেন্স সংগ্রহসহ সব ক্ষেত্রেই ১২০ টাকা দরে ডলার লেনদেন করছে।
২০ আগস্টের আগে আন্তঃব্যাংক লেনদেনসহ সব ক্ষেত্রেই ১১৮ টাকায় ডলার লেনদেন হচ্ছিল।
দেশে দীর্ঘদিন ধরে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট চলছে। কোভিড মহামারির সময়ে একপর্যায়ে দেশে রিজার্ভের পরিমাণ ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছিল। কিন্তু রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিশ্বে পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশের আমদানি খরচ অনেক বেড়ে যায়। একই সঙ্গে প্রবাসী আয় ও রপ্তানিতে যথেষ্ট প্রবৃদ্ধি না হওয়ায় রিজার্ভ দ্রুত কমতে থাকে।
সংকট কাটাতে ও রিজার্ভ বাড়াতে প্রবাসী আয়সহ বিদেশ থেকে অর্থ আনতে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত কয়েক মাসে এসব পদক্ষেপের ইতিবাচক প্রভাব পড়েছিল প্রবাসী আয় বা রেমিটেন্স দেশে আসার ক্ষেত্রে। তবে জুলাই মাসে সেই ধারায় কিছুটা ছন্দপতন হয়েছিল।
রিজার্ভ ১৯ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার
রেমিটেন্স বাড়ায় বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভও খানিকটা বেড়েছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে এই সূচক বেড়েছে ২০ কোটি ডলার।
গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংক যে ‘উইকলি সিলেক্টেড ইকোনমিক ইন্ডিকেটরস’ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন) হিসাবে বুধবার বাংলাদেশের রিজার্ভ ১৯ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২৪ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার।
এক সপ্তাহ আগে ১৯ সেপ্টেম্বর বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ১৯ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২৪ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার।
এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, সপ্তাহের ব্যবধানে বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ বেড়েছে ২০ কোটি ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে বেড়েছে ১৬ কোটি ডলার।