ঈদের আগে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সে ঢল নেমেছে; চলতি জুন মাসের তিন দিনেই ৬০ কোটি ৪০ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রবাসীরা।
রেমিটেন্সে প্রতি ডলারে ১২৩ টাকা টাকা দিচ্ছে এখন ব্যাংকগুলো। সে হিসাবে টাকার অঙ্কে এই তিন দিনে (১ থেকে ৩ জুন) ৭ হাজার ৪২৯ কোটি টাকা দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। প্রতিদিনের গড় হিসাবে এসেছে ২০ কোটি ১৩ লাখ ডলার; টাকার অঙ্কে যা ২ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকা।
এমনিতেই গত কয়েক মাস ধরে বেশি রেমিটেন্স আসছে। ৭ জুন শনিবার দেশে কোরবানির ঈদ উদযাপিত হবে; এই উৎসবকে সামনে রেখে প্রতিবারের মতো এবারও কোরবানির পশু কেনাসহ অন্যান্য খরচ মেটাতে পরিবার-পরিজনের কাছে আরও বেশি রেমিটেন্স পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের শুরু থেকেই প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের চমক অব্যাহত রয়েছে; গড়তে চলেছে অনন্য রেকর্ড।
সদ্য সমাপ্ত মে মাসে প্রায় ৩ বিলিয়ন (৩০০ কোটি) ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। যা একক মাসের হিসাবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
সব মিলিয়ে অর্থ বছরের ১১ মাস ৩ দিনে (২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ৩ জুন) ২ হাজার ৮১১ কোটি ৪০ লাখ (২৮.১১ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা।
চলতি জুন মাসের বাকি ২৭ দিনে ১৮৯ কোটি (১ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন) ডলার আসলেই বিদায়ী ২০২৪-২৫ অর্থ বছর শেষে রেমিটেন্সের অঙ্ক ৩ হাজার কোটি (৩০ বিলিয়ন) ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করবে। আর সেটা যদি হয়, তাহলে রেমিটেন্স আহরণে নতুন ইতিহাস গড়বে বাংলাদেশ।
এর আগে এক অর্থ বছরে সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স এসেছিল ২ হাজার ৪৭৮ কোটি (২৪.৭৮ বিলিয়ন) ডলার, ২০২০-২১ অর্থবছরে।
রোজা ও ঈদ সামনে রেখে গত মার্চে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ৩২৯ কোটি ৫৬ লাখ (৩ দশমিক ২৯ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স আসে দেশে, যা ছিল গত বছরের মার্চ মাসের চেয়ে ৬৫ শতাংশ বেশি।
তৃতীয় সর্বোচ্চ ২৭৫ কোটি ১৯ লাখ (২ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন) ডলার এসেছিল গত এপ্রিল মাসে।
এই রেমিটেন্সের ওপর ভর করেই বেশ কিছুদিন ধরে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে থাকা বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভে স্বস্তি ফিরে আসতে শুরু করেছে।
গত ৬ মে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পরও বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারের ওপরে অবস্থান করছে। গ্রস হিসাবে রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে সাড়ে ২৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি।
আকুর বিল শোধের আগে বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২২ দশমিক ০৬ বিলিয়ন ডলার। গ্রস হিসাবে ছিল ২৭ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্যে দেখা যায়, ২৯ মে বিপিএম-৬ হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার। গ্রস হিসাবে ছিল ২৫ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার।
দেশের অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলোর মধ্যে এখন সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে রেমিটেন্স বা প্রবাসী আয়। বলা যায়, সঙ্কটের এই সময়ে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে রেমিটেন্স।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসও তা অকপটে স্বীকার করেছেন। প্রবাসী বাংলাদেশিদের অবদানের কথা তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, “বাংলাদেশকে ‘ধ্বংসাবশেষ থেকে ঘুরে দাঁড়াতে’ প্রবাসীরাই মূল ভূমিকা পালন করেছেন।”
গত ৩০ মে টোকিওতে বাংলাদেশ দূতাবাস আয়োজিত অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “এটাই সত্য যে কঠিন সময়ে দেশের যে টিকে থাকা, তা সম্ভব হয়েছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের কারণে।”
বিগত সরকারের সমালোচনা করে ইউনূস বলেন, “ক্ষমতাচ্যুত পতিত সরকার রাষ্ট্রীয় কোষাগার এবং ব্যাংক শূন্য করে গিয়েছিল। যদি প্রবাসীরা সহায়তা না করতেন, তাহলে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াতে পারত না।”
এর আগে কাতার সফরকালেও তিনি একই কথা বলেছিলেন। ২৪ এপ্রিল কাতারের রাজধানী দোহায় প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “প্রবাসীদের সহযোগিতার কারণে বাংলাদেশের ভঙ্গুর অর্থনীতি আবার ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে। আমরা আজ যে শক্ত হয়ে দাঁড়াতে পেরেছি, তার মূলে আপনারা (প্রবাসীরা)। আপনারা সহযোগিতা না করলে আমরা আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারতাম না। আপনারা কখনও আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন ভাববেন না।”
প্রতিবারই দুই ঈদ সামনে রেখে প্রবাসীরা বেশি রেমিটেন্স পাঠান। তারপর কমে যায়। কিন্তু এবার তার ব্যতিক্রম দেখা যায়।
গত ৩১ মার্চ ঈদুল ফিতর উদযাপিত হয়েছে। ঈদের পর এপ্রিল মাসেও সেই আগের গতিতেই রেমিটেন্স আসে। কোরবানির ঈদের আগে তা আরও বেড়েছে।
রেমিটেন্সের এই উচ্চ প্রবৃদ্ধির কারণে ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকা বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। টাকা-ডলার বিনিময় হার বাজারের উপর ছেড়ে দেওয়ার পর ডলারের দর স্থিতিশীল রয়েছে। ১২২ থেকে ১২৩ টাকার মধ্যে লেনদেন হচ্ছে। আগের মতো ডলার নিয়ে হাহাকার নেই ব্যবসায়ীদের।
রেমিটেন্স কেন বাড়ছে—এ প্রশ্নের উত্তরে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “মূলত হুন্ডি কমে যাওয়ার কারণেই রেমিটেন্স বাড়ছে। নানা ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার ফলে হুন্ডি কমে গেছে। এখন দেশে যে রেমিটেন্স আসছে তার পুরোটাই বৈধ পথে অর্থাৎ ব্যাংকিং চ্যানেলে আসছে।
“আর প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের ঊর্ধ্বগতির কারণেই রিজার্ভ বাড়ছে।”
আরিফ খান বলেন, “বেশ কিছুদিন ধরে ডলারের দর স্থিতিশীল রয়েছে। টাকা-ডলার বিনিময় হার বাজারের উপর ছেড়ে দেওয়ার পরও বাজার স্বাভাবিক রয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য এটা সুখবর।”
গত ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে রেমিটেন্স এসেছিল ২৩ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার। ২০২২-২৩ অর্থ বছরে এসেছিল ২২ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার। ২০২১-২২ অর্থ বছরে এসেছিল ২১ দশমিক শূন্য তিন বিলিয়ন ডলার।
২০১৯-২০ অর্থ বছরে এসেছিল ১৮ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার।
অর্থ বছরজুড়েই উল্লম্ফন
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থ বছর শুরু হয়েছিল গত বছরের জুলাই থেকে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের কারণে ওই মাস ছিল উত্তাল; দেশজুড়ে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছিল। কয়েক দিন ব্যাংক ও ইন্টারনেট সেবা বন্ধ ছিল।
সে কারণে জুলাই মাসে রেমিটেন্স প্রবাহ কিছুটা কমেছিল; এসেছিল ১৯১ কোটি ৩৭ কোটি (১.৯১ বিলিয়ন) ডলার। তার আগের তিন মাস অবশ্য ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি এসেছিল।
তবে তারপর থেকে প্রতি মাসেই ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিটেন্স দেশে এসেছে; মার্চে এসেছে তিন বিলিয়ন ডলারের বেশি। এপ্রিলে আসে পৌনে ৩ বিলিয়ন ডলার। মে মাসে এসেছে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার।
২০২৫ সালের প্রথম মাস জানুয়ারিতে ২১৮ কোটি ৫২ লাখ (২.১৮ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।
গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে এসেছিল ২৬৪ কোটি (২.৬৪ বিলিয়ন) ডলার।
চলতি অর্থ বছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ১৯১ কোটি ৩৭ লাখ (১ দশমিক ৯১ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। দ্বিতীয় মাস আগস্টে তারা পাঠান ২২২ কোটি ৪১ লাখ (২ দশমিক ২২ বিলিয়ন) ডলার। তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে এসেছিল ২৪০ কোটি ৪৮ লাখ (২ দশমিক ৪০ বিলিয়ন) ডলার।
চতুর্থ মাস অক্টোবরে আসে ২৩৯ কোটি ৫১ লাখ (২ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন) ডলার। পঞ্চম মাস নভেম্বরে এসেছিল ২১৯ কোটি ৯৫ লাখ (২ বিলিয়ন) ডলার।