Beta
শনিবার, ১২ জুলাই, ২০২৫
Beta
শনিবার, ১২ জুলাই, ২০২৫

ইরান ইস্যুতে রিপাবলিকান পার্টিতে বিভক্তি, কোন পক্ষে যাবেন ট্রাম্প

Trumps
[publishpress_authors_box]

ইসরায়েল যখন ইরানে একের পর এক বিমান হামলা চালাচ্ছে, তখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রিপাবলিকান পার্টির অভ্যন্তরীণ মতপার্থক্যের মধ্যে পথ খোঁজার চেষ্টা করছেন। আর এই মতপার্থক্য মূলত যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি বিদেশি যুদ্ধে জড়ানো উচিত কি না, তা নিয়ে।

রিপাবলিকানদের একাংশের ভয়, ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রকে আবারও মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধে টেনে নিতে পারে। অন্যদিকে আছেন ইরান-বিরোধী ও ইসরায়েল-সমর্থকরা। তারা বহু বছর ধরে এ ধরনের সামরিক অভিযানের পক্ষে আহ্বান জানিয়ে আসছেন।

ট্রাম্প এখন এই দুই পক্ষের মাঝখানে পড়ে গেছেন। তিনি কখনও ইসরায়েলের হামলা থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে দূরে রাখার চেষ্টা করছেন। আবার কখনও হামলার সফলতা উদযাপন করছেন ও ইরানকে আরও হামলার হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন।

আর ট্রাম্পের এমন পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ডানপন্থী অ্যাক্টিভিস্ট ও পডকাস্টার চার্লি কার্ক বৃহস্পতিবার তার পডকাস্টে বলেন, “এটা এখনই মাগা (মেইক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন) অনলাইন সম্প্রদায়ের মধ্যে বড় ধরনের বিভক্তি ঘটাবে।”

ট্রাম্প এই বছর একাধিকবার ইসরায়েলকে হামলা না চালানোর অনুরোধ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, তিনি ইরানের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় পৌঁছাতে চান। হামলা শুরুর পরপরই হোয়াইট হাউজ পররাষ্ট্র মন্ত্রী মার্কো রুবিওর একটি বিবৃতি প্রকাশ করে জানায়, এ অভিযানে যুক্তরাষ্ট্রের কোনও ভূমিকা নেই।

মার্কো রুবিও বলেন, “ইসরায়েল ইরানের বিরুদ্ধে একতরফাভাবে পদক্ষেপ নিয়েছে। ইরানে হামলায় আমাদের কোনও সম্পৃক্ততা নেই। আমাদের প্রধান অগ্রাধিকার হলো অঞ্চলে অবস্থানরত যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনীকে নিরাপদ রাখা।”

তবে পরে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট জানান, তিনি বৃহস্পতিবার ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি হামলার পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতেন এবং হামলাকে ‘চমৎকার’ বলে অভিহিত করেন। ট্রুথ সোশালে এক পোস্টে তিনি লেখেন, ইসরায়েল “আরো কঠোর হামলার পরিকল্পনা” করেছে। 

যুক্তরাষ্ট্রের একজন কর্মকর্তা জানান, ইরানের পাল্টা হামলায় ছোড়া কিছু ব্যালিস্টিক মিসাইল প্রতিহত করতে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী ইসরায়েলকে সহযোগিতা করেছে।

প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার সময় ট্রাম্প প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিনি বিশ্বের বিভিন্ন যুদ্ধ বন্ধ করবেন। তার অভিষেক বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, তিনি যেন শান্তির প্রতীক হিসেবে স্মরণীয় থাকেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত তিনি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করতে পারেননি। অথচ তিনি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ওই লড়াই থামানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। একইভাবে ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধও তিনি থামাতে পারেননি।

গত কয়েক মাস ধরে ট্রাম্প প্রশাসন ইরানের সঙ্গে নতুন একটি পারমাণবিক চুক্তি করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইসরায়েলকে বলেছিলেন, আলোচনার সময় কোনও সামরিক পদক্ষেপ না নিতে।

হামলার ঠিক আগ মুহূর্তে হোয়াইট হাউজে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “আমি চাই না ওরা এখনই এগিয়ে যাক। এতে সবকিছু ভেস্তে যাবে।”

ইসরায়েল মিসাইল ছোড়ার পর ট্রাম্প দোষ চাপান ইরানের ওপর। তিনি বলেন, দেশটির শীর্ষ নেতারা ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ বন্ধ করতে একটি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল।

শুক্রবার সকালে ট্রুথ সোশালে ট্রাম্প লেখেন, “আমি ইরানকে একের পর এক সুযোগ দিয়েছি চুক্তি করতে। আমি কঠোর ভাষায় বলেছি, ‘এটা করো,’ কিন্তু তারা যতই চেষ্টা করুক না কেন, যতই কাছাকাছি আসুক, তারা সফল হতে পারেনি।”

কাউন্সিল অন ফরেইন রিলেশনসের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক জ্যেষ্ঠ ফেলো এলিয়ট আব্রামস বলেন, “ট্রাম্প ইসরায়েল ইরানে হামলা করুক কি না, এ বিষয়ে আগের অবস্থান থেকে সরে এসেছেন। ইসরায়েল হিসাব করে এই পদক্ষেপ নিয়েছে যে ট্রাম্প শেষ পর্যন্ত তাদের পক্ষে থাকবেন।”

তিনি বলেন, “ইসরায়েল প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ঘিরেই বাজি ধরেছে। অধিকাংশ সময় ট্রাম্প বলতেন, ‘না, আমরা আলোচনায় আছি, এখনই কিছু কোরো না।’ এরপর ইসরায়েল হামলা চালায়, আর আজ ট্রাম্প এটাকে চমৎকার বলছেন।”

অনেক রিপাবলিকান নেতার কাছে ইসরায়েলের এই সামরিক অভিযান বহু প্রতীক্ষিত ছিল। তারা মনে করেন, ইরান পারমাণবিক সক্ষমতার দিকে অগ্রসর হচ্ছে, যা ইসরায়েল এবং গোটা বিশ্বের জন্য হুমকি।

সাউথ ক্যারোলিনা অঙ্গরাজ্যের রিপাবলিকান সিনেটর ও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ মিত্র লিন্ডসে গ্রাহাম বলেন, “রিপাবলিকানদের মধ্যে এমন মানুষের সংখ্যা খুবই কম, যারা পারমাণবিক অস্ত্রধারী ইরানকে ইসরায়েল ও বিশ্বের জন্য হুমকি মনে করেন না। বিপুল সংখ্যক রিপাবলিকান ইরানের পারমাণবিক হুমকি ঠেকাতে ইসরায়েলের সামরিক পদক্ষেপকে সমর্থন করছেন।”

তবে ট্রাম্পের কিছু কট্টর সমর্থক এই ঘটনাকে ভিন্নভাবে দেখছেন। তাদের মতে, ইসরায়েলের এই হামলা ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য সম্পৃক্ততা ট্রাম্পের “আমেরিকা ফার্স্ট” পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

চার্লি কার্ক বৃহস্পতিবার রাতে বলেন, “আমার শ্রোতারা যে ইমেইল পাঠাচ্ছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, প্রায় ৯৯ শতাংশ মানুষ ইসরায়েলের এই কাজের বিরুদ্ধে।”

কিছু মাগা সমর্থকের দাবি, ইসরায়েল ইচ্ছাকৃতভাবে পারমাণবিক স্থাপনাগুলো এবং শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে, যাতে করে বড় আকারের সংঘাত সৃষ্টি হয় এবং যুক্তরাষ্ট্র এতে জড়িয়ে পড়ে। 

যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা শুক্রবার জানান, পেন্টাগন মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধজাহাজ ও অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম মোতায়েন করছে, যাতে ইসরায়েল ও ওই অঞ্চলে অবস্থানরত যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনীকে ইরানের সম্ভাব্য প্রতিশোধমূলক হামলা থেকে রক্ষা করা যায়।

শুক্রবার “ওয়ার রুম” নামক পডকাস্টে ট্রাম্পের সাবেক শীর্ষ উপদেষ্টা স্টিফেন কে. ব্যানন বলেন, “মূল বিষয় হলো—আমরা যেন জোর করে ধাপে ধাপে মধ্যপ্রাচ্য বা পূর্ব ইউরোপের যুদ্ধে জড়িয়ে না পড়ি।”

ইসরায়েল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “হ্যাঁ, তোমরা এটা করেছো। তোমরা তোমাদের দেশের নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছো। এটা ঠিক আছে। কিন্তু আমাদেরকেও আমাদের নিরাপত্তাকে আগে ভাবতে হবে।”

তবে আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ ফেলো মাইকেল রুবিন বলেন, ট্রাম্প প্রশাসন এখন কেবল বাইরে থেকে মন্তব্য করে যাচ্ছে।

তিনি এক ইমেইলে লেখেন, “ট্রাম্প সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি সংঘাতে জড়াবেন না এবং মধ্যস্থতার প্রস্তাব দেবেন। কিন্তু বর্তমানে তিনি কেবল সময় পার করছেন। বড় প্রশ্ন উঠবে কংগ্রেসে, যেখানে ইসরায়েলের জন্য সহায়তা ও অস্ত্রভাণ্ডার পূরণের বিষয় নিয়ে বিতর্ক হবে।”

টাকার কার্লসন একজন প্রভাবশালী রক্ষণশীল ভাষ্যকার। তাকে ট্রাম্পের মাগা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ মুখ হিসেবে দেখা হয়। তিনি বলেছেন, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর “যুদ্ধ-আগ্রাসী সরকার”কে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন দেওয়া উচিত নয়।

শুক্রবার ‘টাকার কার্লসন নেটওয়ার্ক’ এর সকালের নিউজলেটারে লেখা হয়, “ইসরায়েল যদি এই যুদ্ধ করতে চায়, তবে তার সম্পূর্ণ অধিকার আছে। তারা একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র। তাদের যা ইচ্ছা করার অধিকার রয়েছে। তবে তা যেন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে না হয়।”

নিউজলেটারে আরও বলা হয়, ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ হলে তা “পরবর্তী প্রজন্মের সন্ত্রাসবাদের জন্ম দিতে পারে” অথবা “একটি বিদেশি এজেন্ডার জন্য হাজার হাজার আমেরিকান নিহত হতে পারে।”

সেখানে আরও লেখা হয়, “এই দুটি সম্ভাবনার কোনোটিই যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর নয়, তা বলাই বাহুল্য। তবে আরেকটি পথও আছে: ইসরায়েলকে ছেড়ে দেওয়া। তাদের নিজেদের যুদ্ধ তারা নিজেরাই লড়ুক।”

রিপাবলিকান সিনেটর র‍্যান্ড পলও ইরানের সঙ্গে যুদ্ধের বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছেন। তিনি ওয়াশিংটনের যুদ্ধপন্থী রক্ষণশীল নেতাদের (নিওকনজারভেটিভ) কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেছেন।

সোশাল মিডিয়ায় দেওয়া এক পোস্টে তিনি লেখেন, “আমেরিকান জনগণ বারবার আমাদের অবিরাম যুদ্ধের বিরোধিতা করেছে। তারা সেই অভিমতই ব্যক্ত করেছে যখন ২০২৪ সালে তারা ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ভোট দেয়।”

তিনি লেখেন, “আমি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে আহ্বান জানাই—তিনি যেন তার অবস্থানে অটল থাকেন, আমেরিকাকে অগ্রাধিকার দেন এবং অন্য দেশের মধ্যে কোনও যুদ্ধে জড়ানোর পথ বেছে না নেন।”

ডানপন্থী কংগ্রেসওম্যান মারজোরি টেইলর গ্রিনও ইসরায়েলের হামলা নিয়ে আপত্তির ইঙ্গিত দিয়েছেন। এর আগে তিনি ট্রাম্পকে সতর্ক করে বলেছিলেন, যেন ইসরায়েলের এই দাবির ভিত্তিতে ইরানে হামলা না চালানো হয় যে, তেহরান খুব শিগগির পারমাণবিক অস্ত্র পেতে যাচ্ছে।

তিনি সোশাল মিডিয়া এক্সে লেখেন, “আমি শান্তির জন্য প্রার্থনা করছি। শান্তি। এটাই আমার সরকারি অবস্থান।”

ইসরায়েলপন্থীরা অনেক সময় বলে থাকেন, পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত ইরান একটি বড় হুমকি। তবে তেহরান সরকার দীর্ঘদিন ধরে এ অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নিজের গোয়েন্দা প্রধান তুলসী গ্যাবার্ডও মার্চ মাসে কংগ্রেসে সাক্ষ্য দিয়ে বলেছেন, “আমাদের মূল্যায়ন অনুযায়ী ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে না।”

চার্লি কার্ক একজন প্রভাবশালী রিপাবলিকান অ্যাক্টিভিস্ট ও ভাষ্যকার। তিনি ইসরায়েলের কট্টর সমর্থক—তিনিও ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।

তিনি তার পডকাস্টে বলেন, “আমি এখনই আপনাদের নিশ্চিত করে বলতে পারি, আমাদের মাগা ঘরানা কোনও যুদ্ধ চায় না—একদমই না। তারা চায় না যুক্তরাষ্ট্র এতে জড়াক। তারা চায় না যে, যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধে অংশ নিক।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত