বাড়তে বাড়তে ২০২১ সালের এপ্রিলে ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উঠেছিল বাংলাদেশের রিজার্ভ। কোভিড মহামারী আর ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় তা ২০ বিলিয়ন ডলারের কোঠায় এসে ঠেকেছিল। এই রিজার্ভ আরও কমে গেলে কী হবে, তা নিয়ে রয়েছে উদ্বেগ। দুই বছর আগে শ্রীলঙ্কার পরিণতি উৎকণ্ঠিতও করছে। এ নিয়ে ঘরে-বাইরেও রয়েছে আলোচনা। নিচের শিরোনামে ক্লিক করে বিস্তারিত পড়ুন।
রিজার্ভ কী?
রিজার্ভ বলতে বোঝায় কোনো দেশের বিদেশি মুদ্রার মজুত বা সঞ্চয়ন। কোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যত পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা মজুত থাকে, তা হল সেই দেশের রিজার্ভের পরিমাণ। কোনো দেশের অর্থনীতির স্বাস্থ্য কেমন, তা দেশটির রিজার্ভ দেখে অনেকটা বোঝা যায় বলে এটা অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ সূচক। সাধারণত শক্তিশালী বা অনমনীয় মুদ্রা, যা আন্তর্জাতিক বাজারে সহজে বিনিময়যোগ্য, ইংরেজিতে যাকে বলে হার্ড কারেন্সি, তা দিয়েই রিজার্ভ গড়ে তোলা হয়। যেমন- ডলার, ইউরো, পাউন্ড ইত্যাদি।
রিজার্ভ জমে কীভাবে? থাকে কোথায়?
রিজার্ভের প্রধান উৎস দুটি- রপ্তানি আয় ও রেমিটেন্স। এছাড়া বিদেশি ঋণ থেকে আসা অর্থ এবং সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআইও রিজার্ভে যোগ হয়। এক সময় সব দেশেই রিজার্ভের বিপরীতে সমমূল্যের সোনা সংরক্ষণ করা হত। পরে ধীরে ধীরে ডলার ও ইউরো সে স্থান দখল করেছে। তবে এখনও অধিকাংশ দেশই তাদের রিজার্ভে সোনা সংরক্ষণ করছে। সোনা রাখলে তার দাম ওঠানামা করতে পারে। এটার বিনিয়োগেও প্রভাব ফেলতে পারে। এজন্য বিদেশি মুদ্রাকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। কোনো দেশ তার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পাশাপাশি বিদেশে থাকা কোনো ব্যাংকেও রিজার্ভ সংরক্ষণ করতে পারে।
রিজার্ভ দিয়ে কী করা হয়?
মোটা দাগে রিজার্ভ দিয়ে রাষ্ট্রের খরচ মেটানো হয়। বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো থেকে নেওয়া ঋণের সুদ-আসল এবং আমদানি করা পণ্যের মূল্য পরিশোধ করতে রিজার্ভের প্রয়োজন পড়ে। রিজার্ভ না থাকলে কোনো দেশ আন্তর্জাতিক ঋণ পরিশোধ করতে পারে না। পরবর্তীকালে ঋণ পেতেও অসুবিধা হয়।
রিজার্ভ ফুরিয়ে গেলে কী হয়?
রিজার্ভ কমার মারাত্মক প্রভাব পড়ে অর্থনীতিতে, যা স্বর্ণ কিংবা প্রাকৃতিক সম্পদ দিয়ে পূরণ করা যায় না। যুদ্ধ কিংবা আন্তর্জাতিক সঙ্কটের ক্ষেত্রে বহু বৈদেশিক বিনিয়োগকারী রিজার্ভ কম আছে এমন দেশে বিনিয়োগ করতে চায় না। বিনিয়োগকারীদের কাছে নিজেদের বিশ্বস্ত করে তুলতে সেই দেশের যথেষ্ট পরিমাণের রিজার্ভ থাকা প্রয়োজন। কোনো দেশের রিজার্ভ ভালো পরিমাণে থাকলে বিনিয়োগকারীরা আত্মবিশ্বাসী হয়ে বিনিয়োগ করতে পারে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, ক্ষতিপূরণ ঋণ এবং বিল পরিষদের ক্ষেত্রে রিজার্ভে যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন প্রকল্প অর্থায়নের ক্ষেত্রেও বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন। সবচেয়ে বড় কথা- রিজার্ভ না থাকলে কোনো পণ্য আমদানি করা যাবে না। ধরা যাক, প্রাকৃতিক দুর্বিপাক বা অন্য কোনো কারণে কোনো দেশের খাদ্য উৎপাদন কম হয়েছে। সেই দেশের মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে অবশ্যই খাদ্য আমদানি করতে হবে। আর সে জন্য প্রয়োজন রিজার্ভ। যদি রিজার্ভে পর্যাপ্ত অর্থ থাকে, তাহলে কোনো সমস্যা নেই। আর যদি কম থাকে তাহলে বিপদ। তখন শ্রীলঙ্কার মতো পরিণতি আসতে পারে।
শ্রীলঙ্কায় কী হয়েছিল?
মহামারীতে পর্যটন শিল্পে ধস নামার পর ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কায় রিজার্ভ তলানীতে ঠেকেছিল। দুই সপ্তাহের আমদানি ব্যয় মেটানোর উপায়ও ছিল না। বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে পারেনি বলে কার্যত দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল দুই কোটি জনসংখ্যার দেশটি। তেলসহ সব আমদানি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ফলে নাগরিকদের বিদ্যুৎসহ প্রয়োজনীয় অনেক সেবা বন্ধ করতে হয়েছিল সরকারবে। এর প্রতিক্রিয়ায় দেখা দেয় জনবিক্ষোভ। তাতে পতন ঘটেছিল সরকারের।
দেউলিয়া রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ কী?
কোনো দেশের রিজার্ভ না থাকলে বা ফুরিয়ে গেলে সেই দেশ দেউলিয়া হয়ে যায়। অনেক সময় রাষ্ট্রটি নিজেই নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করে। অর্থাৎ রিজার্ভ নাই মানে ওই রাষ্ট্র বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে যে ঋণ নিয়েছিল, তা আর পরিশোধ করতে পারে না। কোনো কিছু আমদানি করতে পারে না। অভ্যন্তরীণ-আন্তর্জাতিক সব দিক দিয়েই মহাসঙ্কটে পড়ে দেশটি।
বাংলাদেশের রিজার্ভ এখন কত?
৪০ বছর আগে ১৯৮১-৮২ অর্থবছরে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ১২ কোটি ডলার। তা সর্বোচ্চ পর্যায়ে (৪৮ বিলিয়ন ডলার) উঠেছিল ২০২১ সালের এপ্রিলে। এরপর কমতে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার বিপিএম-৬ হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ২১ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘গ্রস’হিসাবে ছিল ২৬ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার। আইএমএফ স্বীকৃত বিপিএম-৬ হিসাবের রিজার্ভকে ‘তাৎক্ষণিক ব্যবহারযোগ্য’রিজার্ভ হিসাবে দাবি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা মজুদ থাকতে হয়। বাংলাদেশের ২১ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ দিয়ে প্রায় চার মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে।
কতটা শঙ্কা?
শ্রীলঙ্কা যখন ডুবছিল, তখন বাংলাদেশের রিজার্ভ তরতরিয়ে উঠছিল। এখন শ্রীলঙ্কা ঘুরে দাঁড়াচ্ছে; বাংলাদেশে উদ্বেগ বাড়ছে। যদিও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ৭০ কোটি ডলার, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের ৪০ কোটি ডলার এবং দক্ষিণ কোরিয়ার ৯ কোটি ডলার ঋণ এবং প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স বৃদ্ধি, ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে ডলার কেনার কারণে গত এক মাসে রিজার্ভ ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি বাড়ায় উদ্বেগ কিছুটা কেটেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক বলছেন, রেমিটেন্স বাড়ার পাশাপাশি বিভিন্ন ঋণের অর্থও যোগ হচ্ছে। জানুয়ারিতে আকুর (এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়ন) ১ বিলিয়নের (১০০ কোটি) মতো দেনা পরিশোধের পরও রিজার্ভ ভালো থাকবে বলে তিনি আশাবাদী। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলছেন, রিজার্ভ নিয়ে এখনও আত্মতুষ্টিতে ভোগার সুযোগ নেই। তাৎক্ষণিক ব্যবহারযোগ্য বা নিট রিজার্ভ যাতে কোনো অবস্থাতেই ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে না নামে, সেজন্য জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে।