যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় পড়েছেন বাংলাদেশের সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ। তার সঙ্গে তার পরিবারও এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসবেন। তারা কেউ এখন আর যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকতে পারবেন না।
তিন বছর আগে র্যাবের ওপর আরোপিত যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা তোলার বিষয়ে যখন আলোচনা চলছে, তখন ওয়াশিংটনের তরফে জেনারেল আজিজের ওপর নিষেধাজ্ঞা এল।
যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু বাংলাদেশ ঘুরে যাওয়ার সপ্তাহ না যেতেই সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলারের মাধ্যমে আজিজ আহমেদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিবৃতিটি আসে।
আজিজ আহমেদ ২০১৮ সালের জুন মাসে বাংলাদেশের সেনাপ্রধানের দায়িত্ব পাওয়ার পর তিন বছর ওই পদে ছিলেন। তার আগে তিনি বিজিবির মহাপরিচালকের দায়িত্বও পালন করেন।
চার তারকা জেনারেল আজিজ অবসর নেন ২০২১ সালের জুন মাসে। তার তিন বছর পর তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা এল। আর তা তার দায়িত্ব পালনের সময়কার কার্যক্রম ধরে।
যে কারণ দেখাল যুক্তরাষ্ট্র
আজিজের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের ক্ষেত্রে তার দুর্নীতিকে প্রধান কারণ হিসাবে দেখিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর। পাশাপাশি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো নষ্ট এবং এগুলোর ওপর জনগণের আস্থা কমে যাওয়ায় তার ভূমিকার কথাও বলা হয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের অবমূল্যায়ন এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান ও প্রক্রিয়ার ওপর জনগণের আস্থা কমে যাওয়ার পেছনে আজিজ আহমেদের কর্মকাণ্ডের ভূমিকা আছে।
এতে বলা হয়, আজিজ আহমেদ তার ভাইদের বাংলাদেশে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য জবাবদিহি এড়াতে সহায়তা করেন। সেনাপ্রধান হিসাবে সরকারি প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় দুর্নীতি করেন। এছাড়া সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন কাজ দুর্নীতির মাধ্যমে পাইয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে ভাইদের সঙ্গে কাজ করেন তিনি।
ঘুষ নিয়ে সরকারি নিয়োগ দিতেও আজিজ আহমেদ ভূমিকা রাখেন বলে বিবৃতিতে দাবি করা হয়।
আজিজ আহমেদের সেনাপ্রধান হওয়ার আগের মাসে তার ভাই তোফায়েল আহমেদ জোসেফ রাষ্ট্রপতির ক্ষমায় কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। হত্যামামলায় তার মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল, তবে আপিল বিভাগের রায়ে তার শাস্তি হয়েছিল যাবজ্জীবন কারাবাস।
ফ্রিডম পার্টির নেতা মোস্তফা হত্যামামলায় সাজা খাটছিলেন জোসেফ। আজিজের ভাই সাঈদ আহমেদ টিপুকে গত শতকের ৯০ এর দশকে এই ফ্রিডম পার্টির নেতা-কর্মীরা খুন করে বলে অভিযোগ রয়েছে।
জোসেফ পুলিশের তালিকায় শীর্ষ সন্ত্রাসী ছিলেন। তার আরেক ভাই হারিস আহমেদের নামও পুলিশের করা সন্ত্রাসীর তালিকায় ছিল। তার আরেক ভাই আনিস আহমেদ।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বিবৃতিতে বলা হয়, অ্যানুয়াল ডিপার্টমেন্ট অব স্টেট, ফরেইন অপারেশনস অ্যান্ড রিলেটেড প্রোগ্রামস অ্যাপ্রোপ্রিয়েশনস অ্যাক্টের ৭০৩১ (সি) ধারার আওতায় বাংলাদেশের সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এর ফলে আজিজ আহমেদ এবং তার পরিবারের সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকার অযোগ্য হিসাবে বিবেচিত হবেন।
যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা নিয়ে আজিজ আহমেদের তাৎক্ষণিক কোনও প্রতিক্রিয়া জানা যায়নি।
তবে একই অভিযোগ তুলে আল জাজিরায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশের পর ২০২১ সালে সংবাদ সম্মেলন করে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন আজিজ আহমেদ। তখন তিনি সেনাপ্রধানের পদে ছিলেন।
ও্ই প্রতিবেদনে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে প্রশ্ন তোলার বিষয়ে তিনি বলেছিলেন, তাকে জড়িয়ে তার ভাইদের নিয়ে অপপ্রচার হচ্ছে। তাকে হেয় করার মাধ্যমে সরকারকে হেয় করাই আল জাজিরার প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য।
র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞার পর নতুন ভিসা নীতি
গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন জড়িত থাকার অভিযোগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের বাহিনী র্যাব এবং এর সাবেক ও বর্তমান কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। সেই নিষেধাজ্ঞা এসেছিল দেশটির অর্থ দপ্তর থেকে।
তখন যাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল, তারা হলেন- বাহিনীর সাবেক প্রধান বেনজির আহমেদ, তৎকালীন প্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, তৎকালীন অতিরিক্ত মহাপরিচালক খান মোহাম্মদ আজাদ, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক তোফায়েল মুস্তাফা সরওয়ার, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক মোহাম্মদ আনোয়ার লতিফ খান।
তখন বেনজির আহমেদের ওপর ভিসা বিধিনিষেধ আরোপের ঘোষণাও দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর।
তবে বেনজির ওই নিষেধাজ্ঞা নিয়েই ২০২২ সালে পুলিশ প্রধান হিসাবে জাতিসংঘে এক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্র ঘুরে এসেছিলেন।
জাতিসংঘের কোনও অনুষ্ঠানে যাওয়ার ক্ষেত্রে ‘রীতি অনুযায়ী’ যুক্তরাষ্ট্র অনেক সময় ভিসা নিষেধাজ্ঞায় ছাড় দিয়ে থাকে বলে তখন জানিয়েছিল সরকার।
বেনজির এখন অবসরে রয়েছেন। তবে সম্প্রতি তার সম্পদ অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন।
র্যাবের ওপর সেই নিষেধাজ্ঞা আরোপের দেড় বছর পর ২০২৩ সালে সংসদ নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসা নীতি গ্রহণের ঘোষণা দেয় যুক্তরাষ্ট্র।
সেই নীতিতে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকা বন্ধ হয়ে যাবে।
তখন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে বলা হয়েছিল, এই নীতি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত যেকোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অন্য অনেকের সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান বা সাবেক কর্মকর্তা/কর্মচারী, সরকারের সমর্থক এবং বিরোধী দলীয় সদস্যরা এর অন্তর্ভুক্ত। এ ধরনের ব্যক্তিদের নিকটতম পরিবারের সদস্যরাও এর অন্তর্ভুক্ত থাকবে।