Beta
বৃহস্পতিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
Beta
বৃহস্পতিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

রেজা কিবরিয়ার পদত্যাগের নেপথ্যে কী

গণঅধিকার পরিষদের কর্মসূচিতে রেজা কিবরিয়া। (ফাইল ছবি)
গণঅধিকার পরিষদের কর্মসূচিতে রেজা কিবরিয়া। (ফাইল ছবি)
Picture of মেরিনা মিতু

মেরিনা মিতু

আওয়ামী লীগ পরিবার থেকে গণফোরামে যোগ, সেখানেও থাকেননি, যুক্ত হয়েছিলেন গণঅধিকার পরিষদে, নতুন দলটিতে বিভেদে দিচ্ছিলেন একাংশের নেতৃত্ব, এখনও সেই দলও ছাড়লেন রেজা কিবরিয়া।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কয়েক দিন আগে তার এই পদত্যাগ সবার মধ্যে কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে। তার দলের দুই অংশের নেতারাও অখুশি নন তার এই পদক্ষেপে।

তবে পদত্যাগের কারণ যেমন ব্যাখ্যা করেননি কিবরিয়াপুত্র; তেমনি সাংবাদিকদের জিজ্ঞাসায়ও নিয়েছেন নিশ্চুপ থাকার কৌশল।

নুরুল হক নুরের সঙ্গে বিরোধের পর রেজা কিবরিয়া গণঅধিকার পরিষদের একাংশের আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন; সেই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন।

বুধবার রাতে রেজা কিবরিয়ার পদত্যাগের বিষয়টি প্রকাশ পায়। প্রথমে সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এবং পরে ফেইসবুক পোস্টে নিজের পদত্যাগের খবর জানান তিনি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বৃহস্পতিবার সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “নো কমেন্ট। সি রিটেন স্টেইটমেন্ট প্লিজ।”

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত ৩১ ডিসেম্বর দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদ বরাবর তিনি পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। একই সঙ্গে যুগ্ম আহ্বায়ক মিয়া মসিউজ্জামানকে ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

একইসঙ্গে দলটির পক্ষ থেকেও একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি এসেছে। সদস্য সচিব ফারুক হাসান স্বাক্ষরে আসা সেই বার্তায় রেজা কিবরিয়ার পদত্যাগের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বলা হয়, সাংগঠনিক কার্যক্রম গতিশীল রাখার লক্ষ্যে মশিউজ্জামানকে দলের ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক করা হয়েছে।

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে যা বলেছেন

বিজ্ঞপ্তিতে রেজা কিবরিয়া বলেন, “আপনাদের মাধ্যমে দেশবাসীর সদয় অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে, আমি গণঅধিকার পরিষদের আহ্বায়ক পদ থেকে পদত্যাগ করছি এবং আমার পদত্যাগপত্র কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদ বরাবর জমা দিয়েছি।

“এছাড়া আমি গণঅধিকার পরিষদের দলীয় সদস্যপদ থেকেও ইস্তফা দিয়েছি। দলের যুগ্ম আহ্বায়ক জনাব কর্নেল (অব) মিয়া মসিউজ্জামানকে ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করছি।”

দুই বছর দুই মাস আহ্বায়কের দায়িত্ব পালনে সহায়তার জন্য গণঅধিকার পরিষদের নেতাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তিনি।

তরুণ প্রজন্মের উপর ভরসা রেখে তিনি বলেন, “বাংলাদেশে যারা গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায়বিচার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে, আমি তাদের সাথে কাজ করে যাব। আমি আমাদের তরুণ প্রজন্মকে নিয়ে অনেক আশাবাদী। আমি মনে করি, তরুণরা বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনা সম্পর্কে ধীরে ধীরে সচেষ্ট হয়ে উঠছে।”

কোন কারণে?

হঠাৎ কেন পদত্যাগ- রেজা কিবরিয়ার জবাব না পেয়ে প্রশ্ন রাখা হয় দলটির বর্তমান কয়েকজন নেতার কাছে।

সহ দপ্তর সমন্বয়ক ও রেজা কিবরিয়ার ব্যক্তিগত সচিব শাহাবুদ্দিন শুভ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “গতকাল রাত ১০টায় ভার্চুয়াল মিটিংয়ে সবার সাথে আলোচনার মাধ্যমেই রেজা কিবরিয়ার পদত্যাগপত্র গৃহীত হয়। উনার পদত্যাগপত্রে যা লিখেছেন, তার বাইরে কিছু জানা নেই আমার।”

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের একাধিক নেতা জানান, বুধবার বিকালে গণঅধিকার পরিষদের যুগ্ম আহবায়ক মশিউজ্জামান (বর্তমান ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক) সহ বেশ কয়েকজন নেতাকে নিয়ে রেজা কিবরিয়া তার গুলশানের বাড়িতে বৈঠক করেন। সেখানে তিনি তার পদত্যাগের সিদ্ধান্ত জানান।

একজন নেতা বলেন, “সেখানে পরিস্থিতি এমন ছিল যে কিছু নেতা আগে থেকেই এই সিদ্ধান্তের কথা জানতেন। আর কেউ কেউ বিস্ময় প্রকাশ করে তার কাছে বার বার এর কারণ জিজ্ঞেস করেন। দলের নতুন কোনো কোন্দল কিংবা কেউ কিছু বলেছেন কি না, উনি কোনো কিছু নিয়ে অসন্তষ্ট কি না, রাগ-অভিমান আছে কি না, অন্য কোনো বিশেষ চিন্তা আছে কি না, বিচ্ছিন্নভাবে এমন কিছু প্রশ্ন সামনে আসে। তবে তিনি, দলে কোনো কোন্দল নেই। তিনি কারও প্রতি অসন্তুষ্টও নন।

দেশের স্বার্থে জনগণের স্বার্থে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি।”

দলটির যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুর রহমান তুহিন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “কোনো ধরনের বিরোধ নেই দলের সাথে। বরং দলের নেতাদের সাথে আলাপ আলোচনা করেই তিনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

“তিনি আমাদের বলেছেন যে তিনি ডেমোক্রেসি নিয়ে কাজ করতে চান। আরও তৎপর হতে চান। যে বা যারা দেশ থেকে কিংবা দেশের বাইরে থেকে বাংলাদেশের ডেমোক্রেসি নিয়ে কাজ করে তাদের সাথে আরও অ্যাক্টিভ হতে চান। দলে থেকে উনি সেটা ঠিকভাবে করতে পারছেন না বা পারবেন না।”

তবে কিছু স্পষ্ট না করায় তার অবস্থান নিয়ে ধোঁয়াশাই দেখছেন গণঅধিকার পরিষদের অনেকে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক নেতা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আসলে পশ্চিমাদের সাথে আঁতাত করতেই উনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি এখনও ভাবছেন এবং আশা করছেন জাতীয় সরকার গঠন হবে। আর সেখানে তিনি গুরুত্বপূর্ণ পদ পাবেন।”

তবে তিনি একই সঙ্গে বলেন, “তার এই ছেলে ভুলানো গল্প শুনতে শুনতে আমার চুল দাড়ি পেকে যাচ্ছে।

“এক সময় ভেবেছিলাম জাতীয় সরকার গঠনের পর তিনি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় যাবেন। তখন দলকে তিনি সামনে এগিয়ে নেবেন। কিন্তু পরবর্তীতে আমিসহ অধিকাংশই বুঝে গেছি যে এটা কেবল উনার নিজস্ব খেয়াল। এর কোনো গ্রাউন্ড নেই।”

এনিয়ে শুভ বলেন, “নিশ্চয়ই সামনে ভালো কিছুর সম্ভাবনা আছে বলেই তিনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ব্যক্তিগতভাবে আমার উনার সিদ্ধান্তের উপর ভরসা রয়েছে।”

‘ভালো কিছু’ মানে কি জাতীয় সরকার- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “উনি বিচক্ষণ মানুষ। সবকিছু তো ক্লিয়ার (পরিষ্কার)। সবাই সব জানেন। আমি এর বেশি কিছু বলতে পারব না।”

এদিকে দলটির আরেক নেতা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আসলে রেজা কিবরিয়া অভিমান করেছেন। তিনি জানতে পেরেছেন দলের কাউন্সিলে তাকে সঠিক মূল্যায়ন করা হবে না। জোটবদ্ধ হয়ে চেষ্টা করা হচ্ছিল কমিটিতে উনাকে প্রধান উপদেষ্টা করা হবে। সেটা আঁচ করতে পেরেই আগে থেকে উনি নিজেই সরে গিয়েছেন।”

কেউ অখুশি নয়

রেজা কিবরিয়ার পদত্যাগকে স্বাভাবিকভাবে দেখছেন দলটির সদস্য সচিব ফারুক হাসান। তাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে পোস্ট দিচ্ছেন কেন্দ্রীয় অন্য নেতারাও।

ফারুক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “উনার এই পদত্যাগ নিঃসন্দেহে আমরা পজিটিভভাবে দেখছি। উনি জনগণের স্বার্থে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তার এই স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করার ব্যাপারটিই প্রমাণ করেন যে পদ আঁকড়ে ধরে থাকার মতো লোভী তিনি নন। আমরা এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই।”

দলের মধ্যে কোনো ধরনের জটিলতা নেই বলেও দাবি করেন তিনি।

কাজ করতে পারার সুযোগ থাকতেও তিনি দল থেকে সরে গেলেন কেন- এমন প্রশ্ন করলে ফারুক বলেন, “সামনে ভালো কিছু আসবে। আমরা এটাই বিশ্বাস করি। তিনি প্রতারক নন। তিনি কারও সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেননি।।”

এই পদত্যাগ দলে শূন্যতা সৃষ্টি করবে না দাবি করে ফারুক বলেন, “এটা আওয়ামী লীগ বা অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের মতো না যে একজন নেতা চলে গেলে নেতৃত্বশূন্য হয়ে যাবে। এটা নিয়ে বিচলিত হতে হবে।”

রেজার পদত্যাগের প্রতিক্রিয়ায় গণঅধিকার পরিষদের আরেক অংশের সদস্য সচিব নুরুল হক নুর সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “তিনি ভাবেন যে তিনি প্রধানমন্ত্রী হবেন। প্রথমে আমার নামে মিথ্যা অভিযোগ এনে আমাকে বিতর্কিত করে এই সংগঠনকে তিনি দুই ভাগে বিভক্ত করলেন। এখন সেখানেও টিকতে পারলেন না। যাদেরকে ভরসা দিয়ে সাথে নিয়ে গেলেন, তাদেরকে রেখে সরে গেলেন।”

রেজা কিবরিয়ার রাজনৈতিক সফর

অর্থনীতিবিদ রেজা কিবরিয়া আওয়ামী লীগের ১৯৯৬ সালের সরকারের অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়ার ছেলে। সংসদ সদস্য কিবরিয়া বিএনপি আমলে ২০০৫ সালে হবিগঞ্জে বোমা হামলায় নিহত হন।

বিদেশে থাকা রেজা ২০১৮ সালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ছেড়ে আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত রাজনীতিতে, তবে বাবার দলে নয়। তিনি বেছে নেন ড. কামাল হোসেনের দল গণফোরাম।

২০১৮ সালের ডিসেম্বরে একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে গণফোরামে যোগ দেওয়ার পর বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধে নির্বাচনে প্রার্থী হন রেজা। বাবা ছিলেন নৌকার এমপি, সেখানে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের হয়ে ধানের শীষ প্রতীকে ভোট করে পরাজিত হন তিনি।

পরে ২০১৯ গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক হন রেজা। তবে তা নিয়ে দলটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মোহসীন মন্টুর সঙ্গে প্রকাশ্যে দ্বন্দ্বের জেরে সেই দল ছাড়তে হয়েছিল তাকে।

গণফোরামে ভাঙনের পর কামালের অংশের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন রেজা। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পদত্যাগ করেন তিনি।

তার আট মাস পর গণঅধিকার পরিষদ নামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠিত হয় ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরের উদ্যোগে, তখন সেই দলে আহ্বায়ক হন রেজা।

গত বছরের জুনে রেজা ও নুরের দ্বন্দ্বে ভাঙনের মুখে পড়ে গণঅধিকার পরিষদ। আহ্বায়ক পদ থেকে রেজা কিবরিয়াকে বাদ দিয়ে দলের ১ নম্বর যুগ্ম আহ্বায়ক রাশেদ খানকে ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়কের দায়িত্ব দেন নুর।

তবে রেজাও তার সমমনা নেতাদের নিয়ে গণপরিষদের কার্যক্রম চালাতে থাকেন। এখন সেখান থেকেও নিজেকে সরিয়ে নিলেন তিনি।

পদত্যাগের সিদ্ধান্ত জানানোর সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তিনি লিখেছেন, “রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার পূর্বে আমি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সরকারি নীতি নিয়ে কাজ করি। এক পর্যায়ে আমার মনে হয়েছে যে, নিজ দেশের জনগণের জন্য কাজ করার সময় এসেছে।

“এ ধরনের সুযোগ হয়ত ভবিষ্যতে নাও আসতে পারে। কিন্তু আমি আমার বাবা শাহ এ এম এস কিবরিয়ার মতো জনগণের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখতে চাই। আশা করি, আগামী দিনগুলোতে আমরা দেশেমুক্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একযোগে কাজ করে যাব।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত