ব্যাটারিচালিত রিকশা এবং প্যাডেল রিকশার মধ্যে কোনও বিভেদ করতে চাইলে তা প্রতিরোধের ঘোষণা দিয়েছে রিকশা ভ্যান ইজিবাইক শ্রমিক ইউনিয়ন।
রবিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে পূর্বঘোষিত সমাবেশ ও গণ অবস্থান কর্মসূচিতে এ ঘোষণা দেন সংগঠনটির উপদেষ্টা আবদুল্লাহ ক্বাফী রতন।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ২৪ জন রিকশাচালক নিহত হয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “ঢাকায় রিকশাচলকরাই ছিলেন সবচেয়ে বড় শক্তি। অথচ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পর সবচেয়ে বড় বৈষম্যটাও হল রিকশা চালকদের সঙ্গে।
“বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন করা রিকশা শ্রমিকদের উপর পুনরায় বৈষম্য চাপানো হলে শ্রমিকশ্রেণির অভ্যুত্থানের প্রস্তুতি নেওয়া ছাড়া অন্য কোনও উপায় থাকবে না।”
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির এই প্রেসিডিয়াম সদস্য আরও বলেন, “ব্যাটারিচালিত রিকশা এবং প্যাডেল রিকশার মধ্যে কোনও বিভেদ করতে চাইলে তা প্রতিরোধ করা হবে। আমাদের মূল পরিচয় আমরা হলাম শ্রমিক।”
সম্প্রতি বৃহত্তর ঢাকা সিটি করপোরেশন প্যাডেল চালিত রিকশা মালিক ঐক্যজোটের সভাপতি জহুরুল ইসলাম মাসুম ও সম্পাদক মো. মমিন আলী হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেন। রিটে ঢাকা মহানগর এলাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধের আবেদন জানানো হয়।
ওই রিটের শুনানির পর গত ১৯ নভেম্বর ঢাকা মহানগর এলাকায় তিন দিনের মধ্যে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধের নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট।
এই আদেশের প্রতিবাদেই মাঠে নামের ব্যাটারি রিকশা চালকরা। বৃহস্পতি ও শুক্রবার ঢাকার বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ, অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন তারা। এরপর লাইসেন্স এবং রুট পারমিটের দাবিতে গণসমাবেশ ও অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হয়।
কর্মসূচি শুরু হয় উদীচী ঢাকা মহানগরের কর্মীদের গণ সংগীত পরিবেশনার মধ্য দিয়ে। এ সময় তারা ‘পথে এবার নামো সাথী, পথেই হবে পথ চেনা’, ‘এই পতাকা শ্রমিকের রক্ত পতাকা’ সহ বিভিন্ন গণ সংগীত পরিবেশন করেন।
গণসমাবেশে অংশ নিতে ঢাকা শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ব্যাটারি রিকশা চালকরা মিছিলসহ প্রেসক্লাবে উপস্থিত হন। ব্যাটারিচালিত রিকশা চালকদের জমায়েত প্রেসক্লাব থেকে শুরু করে হাইকোর্টের কদম ফোয়ারা হয়ে গণপূর্ত ভবন পর্যন্ত পৌঁছে।
নিজের বক্তব্যে আবদুল্লাহ ক্বাফী রতন কথা বলেন প্রধান উপদেষ্টাকে উদ্দেশ্য করে।
তিনি বলেন, “ইউনূস সাহেব শ্রমজীবি মানুষের রক্তের উপর দিয়ে আপনি ক্ষমতায় বসেছেন। ফলে আপনার মাথায় রাখতে হবে আমরা ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার রক্তচক্ষু ভয় পাই নাই। এই সিদ্ধান্তও আমরা মানি না।
“আমরা অ্যাটর্নি জেনারেল এবং অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে দেখা করেছি। তারা এই অন্যায় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করবেন বলে আমাদের জানিয়েছেন। আজকেই করার কথা ছিল। কিন্তু একজন বিচারপতির মৃত্যুর কারণে আজকে হচ্ছে না। কাল শুনানি হবে।”
সোমবার সিদ্ধান্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত ব্যাটারি রিকশা শ্রমিকরা রাজপথে থাকবেন বলেও জানান এই নেতা। দাবি না মানলে শ্রমিকশ্রেণির অভ্যুত্থানের জন্য রাষ্ট্রকে প্রস্তুত হতে হবে বলে হুঁশিয়ারি করেন তিনি।
সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কুদ্দুস বলেন, “আমরা কেউ ভালো নাই। বলার দরকারও নাই কেন ভালো নাই। বাসায় ভাত নাই, বাচ্চারে খাওয়াইতে পারি না। ভালো কেমনে থাকব আমরা। আমাদের রুট পারমিট লাগবে, লাইসেন্স লাগবে। আমরা নিয়মমতো কাজ করতে চাই।”
রিকশা ভ্যান ইজিবাইক শ্রমিক ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক লিটন নন্দী বলেন, “গণ অভ্যুত্থান আমাদের রক্তের উপর দিয়ে হয়েছে। আমাদের ২৪ জন মারা গেছে। কিন্তু সবার আগে আক্রমণ এলো আমাদের উপর। চাল, ডালের দাম বাড়ে কিন্তু শুধুমাত্র আমাদের শ্রমিকের জীবনের দামই বাড়ল না।
“আমাদের রুট পারমিট এবং লাইসেন্স দিতে হবে। এই শহরে কার্ড ব্যবসায়ী এবং পুলিশের চাঁদাবাজির বিরুদ্ধেও আমরা লড়েছি। সামনের দিনে কেউ এগুলো করতে আসলে ওদের ঢাকা থেকেই বের করে দেওয়া হবে।”
সংগঠনের সহ সভাপতি আব্দুল হাকিম মাইজভাণ্ডারির সভাপতিত্বে এবং সহ সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলাম নাদিমের সঞ্চালনায় সভায় আরও বক্তব্য দেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, রিকশা ভ্যান ইজিবাইক শ্রমিক ইউনিয়নের উপদেষ্টা রাগীব আহসান মুন্না ও জলি তালুকদারসহ অন্যরা।
এসময় ১২ দফা দাবি তুলে ধরা হয়। দাবিগুলো হল- লাইসেন্স ও যৌক্তিক রুট পারমিট দেওয়া, চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়া এবং ব্যাটারিচালিত যানবাহন চলাচলে নীতিমালা প্রণয়ন।
এছাড়া শ্রমিক প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে সড়ক ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনা কমিটি গঠন, সড়কে লেন পদ্ধতি সচল ও সার্ভিস লেন নির্মাণ, আন্দোলনে আটক ও গ্রেপ্তারদের অবিলম্বে মুক্তি, ব্যাটারিচালিত যানবাহনকে গণপরিবহন ও শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি, জব্দ করা সব ব্যাটারিচালিত যানবাহন ও ব্যাটারি মালিকদের কাছে হস্তান্তর, নিলাম করা ব্যাটারির মালিকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া এবং চার্জিং স্টেশন নির্মাণ।
শ্রমিকদের ওপর সব ধরনের জুলুম-নির্যাতন-চাঁদাবাজি-হয়রানি বন্ধের দাবিও জানিয়েছেন শ্রমিকরা। তাদের দাবি, মানবিক বিবেচনায় ব্যাটারিচালিত যানবাহনের পুঁজিকে নিরাপদ করে পর্যায়ক্রমে প্যাডেলচালিত বাহনের ক্ষতিকর শ্রম থেকে চালকদের মুক্ত করতে হবে।
সমাবেশ শেষে একটি মিছিল নিয়ে শহীদ মিনারে যান শ্রমিক ও সংগঠনের সদস্যরা। সেখানেই কর্মসূচি সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়।